অরিঞ্জয় বোস: কেউ বলে দখিনা, কেউ বলে মাতাল বাতাস, আমি বলি আমার দীর্ঘশ্বাস…’ প্রহরশেষের আলোয় রাঙা সে কি কোনও অমোঘ চৈত্রমাস! আজ আর মনে নেই। হিসাবের খাতাও খুলতে চাই না। আর খোলা সম্ভবই বা কী করে! হৃদয়ের গহীনে জন্ম যে মুগ্ধ অক্ষরমালার, সে আর কবে হিসাবের কাছে নজরানা দিয়েছে। অতএব সে সব থাক। বরং সবুজ কোর্টে তিনি যখন এসে পড়লেন এক ঝলক বেহিসাবি বাতাস হয়ে, সেই হলুদ বসন্তের দিনটুকুই শুধু আজ জেগে থাকুক এই নতুন মধুমাসে। ভারতীয় ক্রিকেট তখন নতুন করে আচ্ছন্ন করেছে আমাদের প্রজন্মকে। হাতে হাতে উঠেছে ব্যাট আর বইয়ের ফাঁকে ফাঁকে তারকাদের ছবি। স্টাডির দেওয়াল থেকে ঝলমল চোখে কেউ কেউ বা উঁকি দিচ্ছেন। ঠিক সেই সময়েই সার্ভিসের জন্য যেদিন র্যাকেট হাতে তুলে নিয়ে তিনি দাঁড়ালেন কোর্টে, আর ক্যামেরাকে ছলনা করে প্রতিপক্ষ নয়, তাকালেন বুঝি আমারই দিকে, সেদিন ওই দৃষ্টির দিকশূন্যপুরে হারিয়ে যাওয়াই ছিল আমার অব্যর্থ নিয়তি। সেই শুরু। একটা প্রজন্ম সূচিত হয়ে গেল একজনের নামে। কেউ তাঁকে বলে টেনিসসুন্দরী, কেউ বলে কোর্টের সাম্রাজ্যে সম্রাটদের একচ্ছত্র আধিপত্যের ভিতর তিনি এসেছিলেন মাতাল দখিনা হয়ে। আমি আর আমার প্রজন্ম শুধু জানে, অন্যেরা তাঁকে যে ভাবেই চিনুক না কেন, তিনি আসলে একই সঙ্গে আমাদের স্বর্গ এবং সর্বনাশ।
‘আমি তো তাকে কোনও নামে ডাকিনি, সে যে আমার চোখেই জলোচ্ছ্বাস…’ ততদিনে তাঁর নাম তো জেনেছে গাঁয়ের আর পাঁচজনে। আমাদের সেই তাহার নামটি, না রঞ্জনা নয়, সানিয়া মির্জা (Sania Mirza)। বলা ভাল, সে এক ইন্দ্রজাল। স্টেফি গ্রাফ, মার্টিনা নাভ্রাতিলোভা কিংবা নিরুপমা বৈদ্যনাথনের যে ঐশ্বর্যময় যাত্রাপথ তার যতটুকু শোনা গল্প, ততটুকু দেখা নয়। অথচ সাধ তো জাগে যে-কোর্টের মায়াডোরে বাঁধা পড়ে গিয়েছি অল্প বয়সে, সেখানে আসুক আমাদের সময়ের নিশান। সেই সময়-নিশান হয়েই এলেন তিনি। আর বছর দশেকের এক বালক বিস্ময়ে খেয়াল করল গতিময়তা আর সৌন্দর্যের এক নেশাতুর আখ্যান চুম্বকটানে টানছে তাকে। ক্রিকেটারদের ছবি একটু সরিয়ে কবে যে দুনিয়া-জেতা সানিয়ার ঠাঁই করে নিল আমার স্ক্র্যাপবুকে, তার আর হিসাব মেলে না। ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদ অতি দ্রুত চিনে ফেলল তাঁকে। চিনে ফেলল দৃশ্য-শ্রাব্য মাধ্যমের বিজ্ঞাপন। সানিয়া ক্রমে হয়ে উঠলেন সময়ের সাফল্যের সেরা সংজ্ঞা, নিজের সাম্রাজ্য নিজে রচনার একান্ত বলিষ্ঠ বিবৃতি। মেয়েদের জন্য টেনিসের শীর্ষ ছোঁয়ার রাস্তা মসৃণও ছিল না। আর শুধু টেনিস কেন, মেয়েদের খেলাধুলার পরিসরই বা তখন আর কতটুকু! বড়জোর পাড়ার কোর্টে ব্যাডমিন্টনের এলেবেলে খেলা। সিরিয়াল-সিনেমার মুখরিত মহিলামহলের ছবিটাই যেন স্থায়ী হয়ে উঠছিল। সেই সময়ে সানিয়া যেন এক স্পর্ধা। চেনা ছবির কোলাজ ভেঙে গড়ে নিলেন নিজস্ব দুনিয়া। আর সেই ব্যাপ্ত মাস্তানির মধ্যেই এ দেশের অসংখ্য মেয়ে পেল স্বপ্নপূরণের আভাস। বহুদূর মফঃস্বলের কোনও তরুণীও জানত, সানিয়া পারলে জীবনের যুদ্ধে জিতে পারবে সে-ও। সানিয়া তাই শুধু টেনিস-সুন্দরী তো নন, সময়ের এক স্পর্ধিত মুখপত্র। জগৎ তাঁকে বরণ করেছে, স্মরণ করেছে, দিয়েছে বিজয়ের মালাখানি। আর বালক থেকে কিশোরবেলায় পা রাখতে রাখতে আবিষ্কার করলাম, দুনিয়াদারির সে পরিচয়পত্র আসলে ব্যর্থ। তৃষিত হৃদয়ে যে অমন করে আনন্দবীণ বাজিয়ে তুলতে পারে, সে আসলে আমার ছোট্টবেলার প্রেম, টেনিস-মেম। কৈশোরের আনচান দিনে প্রকৃত প্রস্তাবে সে-ই আমার চোখের জলোচ্ছ্বাস।
‘জোনাকির নাম নাকি আঁধারমানিক, আমি তো দেখি আগুন জ্বলে ধিকধিক…’ এই যে জোনাকজ্বলা দিবারাত্রির কাব্যটুকু, এর ভিতর কিন্তু আগুনও ছিল। যেমন আগুন থাকে শ্রাবণের বুকের ভিতর। বিশ্বায়ন-উত্তর পৃথিবী আমাদের সামনে প্রগতির জানালাগুলো খুলে দিয়েছিল ঠিকই, তবু পিছুডাকে বেঁধে রাখাও তো কম ছিল না। সানিয়া শুধু কোর্টের ভিতর বৈচিত্র আনলেন না। টেনিসের অভিজাত দুনিয়াকেই খেলা-ভাঙার-খেলায় রাঙিয়ে তুললেন না। বরং সানিয়া হয়ে উঠলেন আমার সময়ের একরকমের সামাজিক প্রতিবয়ান। যত দিন গেল ব্যক্তিজীবনের পদে পদে তিনি বোঝাতে শুরু করলেন তিনি এসেছেন নিজের শর্তে বাঁচার ইস্তাহার হয়ে। যেমন র্যাকেট হাতে দুনিয়া শাসন করতে পারেন, তেমনই সিদ্ধান্তের দৃঢ়তায় শাসন করতে পারেন সামাজিক চোখরাঙানিকেও। শোয়েব মালিককে বিয়ের পর শুনতে হয়েছিল ‘দেশদ্রোহী’ আখ্যাও। সানিয়া পরোয়া করেননি। দিনের পর দিন অসহিষ্ণু হাওয়া তাঁকে জ্বালিয়েছে, পুড়িয়েছে। তবু সেই অযুক্তির ছাই থেকেই ফিনিক্স হয়ে বেরিয়ে এসেছেন দৃঢ়চেতা। মা হওয়ার পরও সাহস দেখালেন কোর্টে নামার। সেরেনা পারেন, সানিয়াও পারেন, তফাত নেই শিরদাঁড়ায়। সানিয়া যেন সময়ের সমস্ত আবিলতাকেই সার্ভিস করে পাঠিয়ে দিলেন বিপক্ষের কোর্টে। ভাল তো বাসা যায় এই বহ্নিলতাটিকেই।
সেই সানিয়া র্যাকেট নামিয়ে রাখছেন। রাখলেন। নিয়মের খাতিরে এ সত্যি অস্বীকার করার তো কোনও জায়গা নেই। তবে নিয়ম ওই স্কোরবোর্ডের মতোই, সময়ের ক্রীড়াভূমিতে সে কখনও সখনও বেজায় নির্বোধ। সানিয়া অবসর নিতে পারেন। আমার আর আমাদেরও বেড়ে যেতে পারে বয়স। তবু সানিয়ার আবেদন আর অবদানের কোনও অবসর হয় না। সময়ের খাতায় সানিয়া নামক স্টেটমন্টের কোনও এক্সপায়ারি ডেট নেই, কেননা তা কালোত্তীর্ণ। টেনিস-দুনিয়া তাঁকে মনে রাখবে নিজদের হিসাবশাস্ত্রে। আর আমার মনে থাকবে বালক থেকে কৈশোরে উত্তীর্ণ হওয়ার পথে সে ছিল আমার গোপনচারিণী। সেদিন তাকে বলতে পারিনি, আজ বলি, এখনও গোপনে বসন্ত আসে সানিয়া-রঙেই। তাকে ‘কেউ বলে ফাল্গুন, কেউ বলে পলাশের মাস, আমি বলি আমার সর্বনাশ।’ আজও!
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.