অর্ডিন্যান্স করে সিবিআই ও ইডি অধিকর্তার পদের মেয়াদ পাঁচ বছর বাড়ানোর সিদ্ধান্তের পাশাপাশি মোদি সরকার জানিয়েছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব, প্রতিরক্ষা সচিব, র ও আইবির অধিকর্তার মেয়াদও সরকার চাইলে দু’বছর পর্যন্ত বাড়াতে পারবে। হঠাৎ কেন এই গুরুত্বপূর্ণ পদগুলির মেয়াদ বাড়াতে চাইছে মোদি সরকার? লিখছেন সুতীর্থ চক্রবর্তী
বিএসএফ-এর এলাকা-বৃদ্ধি নিয়ে বিতর্ক যখন তুঙ্গে, তখন নরেন্দ্র মোদি সরকারের আরও একটি প্রশাসনিক সংস্কার নানা প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। বিএসএফের ক্ষমতা-বৃদ্ধি যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় আঘাত বলে বিরোধীরা অভিযোগ করছে। কিছু কিছু আমলার মেয়াদ-বৃদ্ধির সিদ্ধান্তকে গণতন্ত্রের উপর মোদি সরকারের আরও বড় আঘাত বলে বিরোধীরা শাণিত আক্রমণ করছে। গত সাত বছরে মোদি সরকারের বিভিন্ন সংস্কারমূলক নীতি দেশে যে আলোড়ন ফেলেনি, তা নয়। আমরা মোদি সরকারের একের পর এক ধামাকা দেখে আসছি। সাম্প্রতিক মেয়াদ-বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত সেইরকম একটি ধামাকা।
অর্ডিন্যান্স করে সিবিআই ও ইডি অধিকর্তার পদের মেয়াদ পাঁচ বছর পর্যন্ত করার সিদ্ধান্তর ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই মোদি সরকার ফের বিধিতে পরিবর্তন এনে জানিয়ে দিয়েছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব, প্রতিরক্ষা সচিব, র ও আইবি-র অধিকর্তার মেয়াদও সরকার চাইলে দু’-বছর পর্যন্ত বাড়াতে পারবে। হঠাৎ কেন এই গুরুত্বপূর্ণ পদগুলির মেয়াদ বাড়াতে চাইছে মোদি সরকার? এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর পেতে হয়তো আরও কিছুদিন সময়ের প্রয়োজন হবে। আপাতত সরকারের তরফে ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে, সরকারি কাজের সুবিধার্থেই এই সিদ্ধান্ত। এসব গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা আমলা ও পুলিশকর্তাদের মেয়াদ বাড়ানো গেলে, বহু গুরুত্বপূর্ণ সরকারি কাজে ধারাবাহিকতা রক্ষা সম্ভব হয়। সিবিআই, ইডি, র, আইবি ইত্যাদি সংস্থার অধিকর্তাদের প্রয়োজনে চাকরির মেয়াদ বাড়ানো গেলে, তদন্তের কাজে সুবিধা হয়। কোনও কোনও ক্ষেত্রে মামলার সুবিধা হয়। স্বরাষ্ট্রসচিব ও প্রতিরক্ষাসচিবের ক্ষেত্রেও জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টি জড়িয়ে থাকে। তাই কখনও কখনও তাদের কাজের মেয়াদ বাড়ানোর প্রয়োজন থাকে। যেমন, সরকারের কোনও বড়সড় প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কেনাকাটার মাঝে যদি প্রতিরক্ষা সচিব অবসর নেন, তাহলে বিপাকে পড়ে সরকার। স্বরাষ্ট্রসচিবের ক্ষেত্রেও তেমনটা হতে পারে।
দিল্লি পুলিশের কমিশনার পদে রাকেশ আস্থানার নিয়োগ নিয়ে বিতর্ক এখনও খুব টাটকা। গুজরাট ক্যাডারের আইপিএস আস্থানাকে অবসরের মাত্র তিনদিন আগে কেন্দ্র দিল্লি পুলিশ কমিশনার পদে নিয়োগ করে। এরপরই তাঁর চাকরির মেয়াদ একবছর বাড়ানো হয়। সুপ্রিম কোর্ট ২০১৯ সালেই এক রায়ে জানিয়েছিল, পুলিশের ডিজি পদে এমন কাউকে বসাতে হবে, যাঁর চাকরির মেয়াদ অন্তত ছ’মাস রয়েছে। ইডি-র বর্তমান অধিকর্তা সঞ্জয়কুমার মিশ্রর ক্ষেত্রেও এক প্রশ্ন উঠেছে। গত বছর সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়ে বলেছিল, মিশ্রকে আর মাত্র এক বছরের জন্য এক্সটেনশন দেওয়া যেতে পারে। আগামী ১৭ নভেম্বর মিশ্রর অবসর।
সিবিআই, ইডি, র, আইবি ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ এজেন্সির শীর্ষকর্তার মেয়াদ বাড়িয়ে সরকার এই সংস্থাগুলিকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করবে- এই মর্মে প্রবল প্রতিবাদ শুরু করেছে বিরোধীরা। ইডি-কর্তাকে রেখে দিতেই কি অর্ডিন্যান্স জারি করে রাতারাতি এই সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে? সেই প্রশ্নও বড় করে সামনে এনেছে বিরোধীরা। কারণ, সংসদের শীতকালীন অধিবেশন দু’সপ্তাহ পর। তার আগে সংসদকে এইভাবে এড়িয়ে সিদ্ধান্তগ্রহণ যে হাজারো প্রশ্ন তুলবেই, তা অস্বীকার করা যায় না। দেশের নিরাপত্তার প্রশ্নটি এই পদগুলির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যেমন জড়িয়ে, তেমন বিরোধীদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎও জড়িয়ে এজেন্সিগুলির পরিচালনা কীভাবে হবে তার সঙ্গে। কেন্দ্রে যখনই যে সরকার থেকেছে, তাদের বিরুদ্ধেই কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলিকে রাজনৈতিক প্রয়োজনে ব্যবহারের অভিযোগ এসেছে। ফলে, এখন মোদি সরকারের বিরুদ্ধে যে-অভিযোগ উঠছে, তা নতুনও নয়, অভিনবও নয়। এখন কী প্রশাসনিক কারণে সরকার এই সিদ্ধান্ত নিল, তা দেখার জন্য অপেক্ষাই সার। কেন্দ্রীয় সরকারের ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ থেকেই হয়তো স্পষ্ট হতে পারে মেয়াদ বৃদ্ধি তাদের কী রাজনৈতিক স্বার্থ পূরণ করছে। বর্তমান সিবিআই কর্তার চাকরির মেয়াদ ২০২৩ পর্যন্ত। অর্ডিন্যান্সে বলা হয়েছে, এক বছর করে পরপর তিন বছর সিবিআই ও ইডি অধিকর্তার চাকরির মেয়াদ বাড়াতে পারবে সরকার। র, আইবি-র অধিকর্তা এবং বর্তমান স্বরাষ্ট্রসচিবও এক বছরের এক্সটেনশনে রয়েছেন।
বিএসএফের ক্ষমতার বৃদ্ধির ক্ষেত্রে যেমন সীমান্ত-থাকা রাজ্যগুলির প্রবল বিরোধিতা রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গই এই সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতা করেছে। আওয়াজ তুলেছে পাঞ্জাবও। বিএসএফ এতদিন পর্যন্ত সীমান্ত থেকে ১৫ কিলোমিটার পর্যন্ত এলাকায় কিছুটা হস্তক্ষেপ করতে পারত। মামলা, গ্রেফতার ইত্যাদি করতে পারত। এই এলাকা বাড়িয়ে ৫০ কিলোমিটার করা হচ্ছে। বিএসএফের এক্তিয়ার-বৃদ্ধি রাজ্যগুলি যুক্তরাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় গুরুত্বপূর্ণ হস্তক্ষেপ বলে মনে করা হচ্ছে। বিরোধীদের অভিমত, বিএসএফ বকলমে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক দ্বারাই পরিচালিত হয়। ফলে বিএসএফের মাধ্যমে রাজ্যের মধ্যে একটি বড় এলাকায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক নানাভাবে পুলিশের কাজে নাক গলাতে পারবে।
আমাদের সংবিধানে রাজ্যগুলিকে যে-ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, তা কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন নীতির ফলে যে ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে, তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। যেমন রাজ্যগুলির হাতে আর্থিক ক্ষমতা কমতে কমতে প্রায় প্রান্তিক জায়গায় এসে ঠেকেছে। রাজ্যগুলির ব্যয়ের দায়ভার এখনও বিশাল পরিমাণে রয়ে গেলেও তাদের আয়ের পথগুলি ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে। জিএসটি হওয়ার পর রাজ্যগুলির বিক্রয়-কর আদায়ের ক্ষমতা চলে গিয়েছে। রাজ্যগুলি যদি এইভাবে তাদের ক্ষমতা হারাতে থাকে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো একদিন কোথায় গিয়ে পৌঁছবে, তা বোঝাই যাচ্ছে। সরকারের প্রশাসনিক সংস্কারের লক্ষ্য যদি হয় নানাভাবে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করা, তাহলে তা দুর্ভাগ্যজনক। সময়ের দাবি মেনে প্রশাসনে বা আইনে সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু জনগণের স্বার্থের দোহাই দিয়ে বিতর্কহীনভাবে একতরফা সিদ্ধান্তগ্রহণ কখনওই কাম্য হতে পারে না। সংস্কার হোক, কিন্তু তার অাগে বিতর্ক হোক। সংবিধান, সংসদ, সুপ্রিম কোর্টকে অগ্রাহ্য করার প্রবণতা ‘বানানা রিপাবলিক’-কেই আহ্বান করে আনবে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.