Advertisement
Advertisement

Breaking News

Kolkata Book Fair

সৃজনে জ্বালো উন্মত্তের ধুনি

সংকীর্ণ মধ‌্যবিত্ততার ঊর্ধ্বে হলেই একমাত্র সম্ভব এসব বইয়ের আয়োজন।

These books are not available in Kolkata Book Fair। Sangbad Pratidin
Published by: Biswadip Dey
  • Posted:January 25, 2024 2:04 pm
  • Updated:January 25, 2024 2:04 pm  

‘লাভ লেটার্স অফ জেমস জয়েস টু হিজ ওয়াইফ নোরা’, ‘ক্রিয়েট ডেঞ্জারাসলি’, ‘দ‌্য হিস্ট্রি অফ সেক্সুয়ালিটি’। আরও আছে। দেখুন তো পান কি না কলকাতা বইমেলায়। এবার তো থিম কান্ট্রি ‘ব্রিটেন’। আমি নিশ্চিত, সেখানেও পাবেন না। সাহিত্যে, সংস্কৃতিতে, দর্শনে নীতি-আবদ্ধ সংকীর্ণ মধ‌্যবিত্ততার ঊর্ধ্বে হলেই একমাত্র সম্ভব এসব বইয়ের আয়োজন। কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা কি তেমন? লিখলেন রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

আমি নিশ্চিত, ভুবনের সেরা বইমেলাটি এই বছর আগস্টে দেখে এলাম প‌্যারিসে। সেই বইমেলা এক গ্রন্থবিপণি। যা একেবারেই, আপাতভাবে, সাজানো-গোছানো নয়। একটু ঠাহর করতেই বুঝলাম, এমন এক নবচেতনার বইমেলায় এসে পড়েছি, যা সচেতন প্রচেষ্টায় ঝেড়ে ফেলেছে, জর্জ অরওয়েলের বাড়তি-বর্জিত গদ্যের মতো, বাহার এবং চাউনি-বিন‌্যাস। পরিবর্তে এনেছে বিদগ্ধ বাছাই বইয়ের বিপুল সর্বগ্রাসী সমারোহ, যার সামনে আমি অন্তত কিছুক্ষণ বাক‌্যহীন বিহ্বলতায় স্ট‌্যাচু!

Advertisement

আমার বাক‌্যহারা বিহ্বল অবস্থার কারণ, কলকাতায় যেসব বই চিরকাল থেকে গিয়েছে মধ‌্যবিত্ত নাগালের বাইরে, কিংবা অপ্রত‌্যাশিত দুর্লভতায়, কিংবা ‘এখন আর পাওয়া যায় না’ বিভাগে– সেসব বই থরে থরে সাজানো আমার অবাক দৃষ্টির সামনে এই প‌্যারিস বইমেলায়, যা আসলে একটি গ্রন্থবিপণি, নাম ‘শেক্সপিয়র অ‌্যান্ড কোম্পানি’। বই-উন্মাদের মতে ‘শেক্সপিয়র অ‌্যান্ড কোম্পানি’-ই জগতের সেরা বইয়ের দোকান। এবং শ্রেষ্ঠ বইমেলাও বটে; যে-বইমেলা সাহিতে‌্য, সংস্কৃতিতে, দর্শনে নীতি-আবদ্ধ সংকীর্ণ মধ‌্যবিত্ততায় বিশ্বাস করে না। যে-বইমেলা বিশ্বাস করে বিদগ্ধ বিতর্কে, এবং ক্রমাগত পা ফেলতে চায় মধ‌্যমেধার বাইরে, পেরতে চায় চেনা ভাবনার গণ্ডি। এই বইমেলার একমাত্র ফোকাস বই, ভাবনা, চেনা ছকের বাইরে চাল দেওয়ার দুঃসাহস। আর কোনও বিনোদন-বিলাস নেই এই শুধুমাত্র বিদগ্ধ এবং বিতর্কিত সাহিতে‌্যর মহাসমুদ্রে।

[আরও পড়ুন: কুসংস্কারের বলি! ক্যানসার আক্রান্ত শিশুকে গঙ্গায় চোবালেন বাবা-মা, শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মৃত্যু]

এবং এখানেই চোখের সামনে সেই বইটির শিরদঁাড়া। বইটি হল, ‘লাভ লেটার্স অফ জেমস জয়েস টু হিজ ওয়াইফ নোরা’! কত খুঁজেছি এই বই কলকাতায়। পাইনি কোথাও। এই বছর কলকাতা বইমেলার থিম দেশ: ‘ব্রিটেন’। সুতরাং আশা করতেই পারি, বইটি পাব এ-বছরের বইমেলায়। কিন্তু আমি নিশ্চিত, বইটি পাওয়া যাবে না। কারণ, এই বইয়ের অভীক অশ্লীলতা ভারতীয় পাঠক, অন্তত অধিকাংশ ভারতীয় পাঠক, হয়তো হজম করতে পারবে না। কিন্তু জয়েসের অকুণ্ঠ রতিস্নাত এইসব চিঠির সাহিত‌্যমূল‌্য অপরিমেয়, তাতেও সন্দেহ নেই। জয়েস নিজেই লিখেছেন, স্ত্রী নোরার সঙ্গে তঁার অকপট সম্পর্কের বিছানা-ভাষাই তিনি ব‌্যবহার করেছেন তঁার জগৎবিখ‌্যাত উপন‌্যাস ‘ইউলিসিস’-এ। নারী-পুরুষের শরীরী মিলনের সময় খোলাখুলি ভাষা কোন পর্যায়ে যেতে পারে, তা আছে জয়েসের চিঠি এবং উপন‌্যাসে। এই কারণেই এই উপন‌্যাস সারা ইউরোপে একসময় কোনও প্রকাশক পায়নি। ‘ইউলিসিস’ শেষ পর্যন্ত প্রকাশিত হয় ‘শেক্সপিয়র অ‌্যান্ড কোম্পানি’ থেকেই। এবং ‘শেক্সপিয়র অ‌্যান্ড কোম্পানি’-র বইমেলায় ‘ইউলিসিস’-এর লেখকের ‘নিষিদ্ধ’ প্রেমপত্রগুচ্ছেরও দেখা পেলাম।

কেন এই পত্রগুচ্ছের দেখা পাওয়া যায় না কলকাতা বইমেলায়? স্ত্রীকে লেখা জয়েসের পত্রগুচ্ছের যে কোনও পাতা চিৎকার করে উঠছে সেই ভাষায়, যে-ভাষাকে ভয় পায় এদেশের, বিশেষ করে বাঙালির মধ‌্যবিত্ত, মধ‌্যমেধা বৈদগ্ধ‌। দু’-একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে সেই ভাব ও ভাষার, জয়েসের চিঠি থেকে। একটি চিঠিতে লিখেছেন তঁার স্ত্রীকে: It was you yourself, you naughty shameless girl who first led the way. It was you who slid your hand down inside my trousers and pulled by shirt softly and frigged me slowly…

[আরও পড়ুন: মমতা-কেজরির পর বেসুরো নীতীশ, মুখে মোদি-নাম, অন্ধকারে ‘ইন্ডিয়া’র ভবিষ্যৎ?]

অার-এক জায়গায় জয়েস স্ত্রী নোরাকে সরাসরি প্রশ্ন করছেন এক কিশোরের সঙ্গে নোরার সম্পর্ক নিয়ে: Did that boy you were fond of ever do it? Tell me now Nora, truth for truth, honesty for honesty. Darling, darling, tonight I have such a wild lust for your body! My Darling Nora, I am panting with eagerness to get your replies to these filthy letters of mine. I love your body, long for it, dream of it.

চিঠিগুলো যেন ইউলিসিসের পাতা থেকেই উঠে এসেছে। এবং জয়েসকে বুঝতে চিঠিগুলো পড়তেই হবে। জয়েস আর নোরার তীব্র এবং অশালীন সম্পর্কের ভিতরটা না বুঝতে পারলে ‘ইউলিসিস’ উপন‌্যাসের শঁাসের স্বাদ পাওয়া যাবে না। কিন্তু, কলকাতা বইমেলায় কবে পাওয়া যাবে জেমস জয়েসের প্রেমের চিঠি?

কলকাতা বইমেলা নিয়ে এই লেখাটা লিখতে বসে আলবে‌য়ার কামু-র একটি লেখার কথা বারবার মনে আসছে। সম্ভবত, এই লেখাটাই কামু পড়েছিলেন তঁার নোবেল পুরস্কার গ্রহণের ভাষণে। লেখাটি পরে ‘ক্রিয়েট ডেঞ্জারাসলি’ নামে প্রকাশিত হয়। খুঁজে দেখবেন তো কলকাতা বইমেলায় এই লেখার খেঁাজ পান কি না। আমার তো মনে হয়, ‘ক্রিয়েট ডেঞ্জারাসলি’ লেখার মতো দুঃসাহসের জন‌্যই কামুকে গাড়ি-দুর্ঘটনায় মরতে হল, যদিও ট্রেনেই সেদিন তঁার প‌্যারিসে ফেরার কথা ছিল এবং ট্রেনের টিকিটও ছিল তঁার পকেটে!

আমার প্রশ্ন হল, কলকাতা বইমেলা কি বিশ্বাস করে কামুর এই সৃজনদর্শনে, ‘ক্রিয়েট ডেঞ্জারাসলি’ কিংবা কলকাতা বইমেলা কি আদৌ কখনও ভেবেছে, কাকে বলে ‘ডেঞ্জারাস ক্রিয়েশন’? কামু এই প্রসঙ্গে কী বলছেন, সেই কথাগুলো কি কলকাতা বইমেলার সিংহদুয়ারে লেখা যায়? কামু লিখেছেন ‘We are adrift on the open sea’– আমরা সবাই ভাসছি মুক্ত সমুদ্রে। কে কোথায় কেন ভেসে যাচ্ছে, জানেই না। কিন্তু দিশাহারা হয়ে শিল্পীরা যেন না ভেসে যায়। ‘Artists must take up their oars by continuing to live and create and to create today means to create dangerously.’

এমনই বিপজ্জনক লেখা তিন খণ্ডের একটি বই, যা হুট করলেই কলকাতায় বইয়ের দোকানে পাওয়া যায় না। বইটা হল মিশেল ফুকোর ‘দ‌্য হিস্ট্রি অফ সেক্সুয়ালিটি’। একসময় এই ফরাসি দার্শনিক ও মহাপণ্ডিতকে আমরা গুরুর আসনে বসিয়েছিলাম। কিন্তু এখনকার আধুনিক-আধুনিকাদের মুখে আর ফুকোর নাম তেমন শুনতে পাই না। ফুকো কেন এমন জুড়িয়ে গেলেন, কে জানে। এমনকী, যেসব আধুনিক আড্ডায় বিপজ্জনকভাবেই ঘন হয়ে ওঠে সুরারঞ্জিত যৌনতা, সেই আলোচনাতেও ঢুকে পড়ে না ফুকোর তিনটি বইয়ের শরীরী উজান। আমার তো মনে হয়, এখনকার ছেলেমেয়েরা আর কলকাতার বইবাজারে নাগালই পায় না এই বিদগ্ধ বিপজ্জনক পর্নোগ্রাফির। কলকাতা বইমেলায় খুঁজে দেখতে পারেন ফুকোর এই তিন খণ্ডের সর্বনাশকে।

আগেই বলেছি, এ-বছর বইমেলার থিম কান্ট্রি, ‘ব্রিটেন’। এবং সে-কথা মনে রেখেই বলছি, একটি বিপজ্জনক বই আপনারা কিছুতেই খুঁজে পাবেন না এই বইমেলায়। এবং কলকাতার কোনও বইয়ের দোকানেও। বইটি আমি কিনি, ইংল‌্যান্ডের স্ট্র‌্যাটফোর্ড-আপন-এভন্‌-এর শেক্সপিয়রের বাড়িতেই যে হীরের মতো উজ্জ্বল ছোট্ট বইয়ের দোকানটি আছে, সেখানে।

বইটা সতি‌্যই বিপজ্জনক। জার্মেন গ্রিয়ের-এর লেখা, ব্লুমসবেরি প্রকাশিত, “শেক্সপিয়র’স ওয়াইফ”! স্বীকার করছি, এই বইয়ের দুঃসাহসী বিপজ্জনক স্বাদ না পেলে লিখতে পারতাম না আমার উপন‌্যাস ‘আমি রবিঠাকুরের বউ’। রবীন্দ্রনাথের দাম্পত‌্য জীবনের বিপন্ন বিষণ্ণতা এবং করুণ সমাপ্তির ছবিটিও থেকে যেত আমার ভাবনার নাগালের বাইরে, যদি না জার্মেন গ্রিয়েরের ডেঞ্জারাস বইটি শেক্সপিয়রের দাম্পত‌্য জীবনের নির্যাসটুকু অসীম দুঃসাহসে পৌঁছে দিত আমার মননে। সতি‌্যই পড়ার মতো বই। খুঁজে দেখতে পারেন বইটা এই বইমেলায় বা কলকাতার কোনও বইয়ের দোকানে, পেয়ে যান কি না বেপরোয়া দৈবযোগে!

কলকাতা বইমেলায় আরও একটি বই অবশ‌্যই খুঁজবেন, যদি মার্জার-ভাগে‌্য শিকে ছেঁড়ে। সন্দেহ নেই, বেশ বিপজ্জনক বই। এবং লেখক আরও বিপজ্জনক, স্বয়ং গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস! বইটার নাম ‘দ‌্য স্ক‌্যান্ডেল অফ দ‌্য সেঞ্চুরি’। ‘ক্রিয়েটিং ডেঞ্জারাসলি’-র এক ভয়াবহ উদাহরণ এই লেখা। এবং এই হল সেই লেখা, যার মুখোমুখি হতে আমরা ভয় পাই। এবং যে-লেখা আমাদের বইয়ের দোকান থেকে বইমেলা, সব্বাই এড়িয়ে চলে। অথচ, এই লেখা প্রতিটি সাংবাদিককে পড়তেই হবে। জার্নালিজম কোন মাপে ও মাত্রায় পৌঁছতে পারে, মার্কেস দেখিয়ে দিয়ে গিয়েছেন এই একটি লেখাতেই।

লেখাটা শুরু হচ্ছে এইভাবে, ‘১৯৫৩-র ৯ এপ্রিল। বৃহস্পতিবার। ছুতোর মিস্ত্রি রডোলফো মনতেসি তার বাড়ির দরজার দিকে উদ্‌গ্রীব উদ্বেগে তাকিয়ে। রাত সাড়ে আটটা। তার তরুণী মেয়ে সেই দুপুরবেলা বেরিয়ে গিয়েছে। তখনও বাড়ি ফেরেনি।’ এরপর শুরু হচ্ছে এই লেখার বীভৎস রস। এবং সেই রসের অনিবার্য রুদ্ধশ্বাস টান আমাদের নিয়ে যায় সেই বিন্দুতে যেখানে মনে হয়, এরপর যদি কেউ আর না-ই লেখে, তাতেই বা কী!

এই লেখাটা লিখতে লিখতে একটা অদ্ভুত ইচ্ছে জাগল মনে। লেখাটা শেষ করেই এই মেঘলা সন্ধেবেলায় আমাকে পড়তেই হবে ডিলেন টমাসের সেই বিপজ্জনক গল্প, ‘প‌্যাট্রিশিয়া, এডিথ, অ‌্যান্ড আর্নল্ড’। ধরুন, আপনাদের কারও কারও মনে এই ইচ্ছে জাগছে। কিন্তু কোথায় ছাপার অক্ষরে আপনার জন‌্য এই শহরে অপেক্ষায় এই অসাধারণ এবং বেশ বিপজ্জনক গল্পটা? কোন বইয়ের দোকানে? কিংবা বইমেলার কোন স্টলে? কোথায় খুঁজবেন তাকে এই শহরে– যে-শহরে কেউ বলে না, ‘ক্রিয়েট ডেঞ্জারাসলি’।

আমি ভাগ‌্যবান। আমার নাকের তলায়, ধূসরিত ধুলোয় অপেক্ষা করছে ডিলেন টমাসের ‘প‌্যাট্রিশিয়া, এডিথ অ‌্যান্ড আর্নল্ড’। কিন্তু তার আগে কি পড়ব টমাসের আরও বিপজ্জনক এবং ইঙ্গিতময় সেই রাতমেলার গল্প, যার নায়িকা এক কচি বেশ‌্যা, নায়ক এক পেল্লাই মোটা পালোয়ান, আর মাঝখানে বুকের দুধ-খাওয়া এক শিশু। বেশ‌্যার বুকে দুধ কোথায়? রাতের মেলায় বাচ্চা কঁাদছে দুধে মুখ রাখার বায়নায়। বেশ‌্যার শুকনো বুকটার দিকে তাকায় পালোয়ান… বালিকা বেশ‌্যা পিছন ফিরে ফ্রকের বোতামে হাত দেয়…।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement