Advertisement
Advertisement

Breaking News

Climate Change

পৃথিবীর তাপমাত্রা এক বছরে বেড়েছে ০.৮ ডিগ্রি! জলবায়ু সম্মেলন ঘিরে শুধুই হতাশা

২০২৪ ‘ইউনাইটেড নেশন্‌স ক্লাইমেট চেঞ্জ কনফারেন্স’-এর ৯ দিন পরেও স্পষ্ট রূপরেখা দেখা গেল না।

There is only despair surrounding the 2024 United Nations Climate Change Conference
Published by: Biswadip Dey
  • Posted:November 20, 2024 11:42 am
  • Updated:November 20, 2024 11:42 am  

২০২৪ ‘ইউনাইটেড নেশন্‌স ক্লাইমেট চেঞ্জ কনফারেন্স’-এ চিন জানিয়েছে, ২০৬০ সালের মধ্যে শূন‌্য নির্গমনের লক্ষ্যে পৌঁছনোর কথা। ট্রাম্পের ধারণা, জলবায়ু নিয়ে চিনের এই হিড়িকের লক্ষ‌্য– আমেরিকাকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়া। তবে এ-বছর বাকুর সবচেয়ে বড় বিস্ময় ভারতের ‘অনাগ্রহ’। লিখছেন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়

সত্যি বলতে কী, সাম্প্রতিকে কোনও জলবায়ু সম্মেলন এতটা হতাশাজনক হয়নি। বাকু-তে ‘কপ২৯’-এর শেষ পর্ব চলছে। অথচ এখনও কেউ জানে না, উন্নত বিশ্ব প্রতিশ্রুতিমতো দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশকে কার্বন নির্গমন কমাতে অর্থসাহায্য করবে কি না। কেউ জানে না কী হাল হবে। কারণ, জলবায়ু নিয়ে এত আন্দোলন ও হইচই সত্ত্বেও পৃথিবীর তাপমাত্রা এক বছরে ০.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গিয়েছে।

Advertisement

বাকু সম্মেলন শেষ হওয়ার কথা আগামী শুক্রবার। কানাঘুষো শোনা যাচ্ছে, টাকাকড়ি নিয়ে দর-কষাকষি নাকি তার পরের দিন দুয়েক চলতে পারে। এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলোর পাশাপাশি গোটা আফ্রিকা নাছোড়বান্দা। দাবি, ২০২৫ থেকে বছরে ১.৩ ট্রিলিয়ন ডলার চাই-ই-চাই, যা ঋণ নয়, হতে হবে অনুদান।

এমন বিপুল অর্থ অনুদান হিসাবে পাওয়া যে আকাশকুসুম কল্পনা, বিশ্ব রাজনীতিতে একজনের বিস্ময়কর উত্থান মোটামুটিভাবে তা বুঝিয়ে দিয়েছে। তিনি ডোনাল্ড ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্রের মসনদে তঁার আরোহণের খবর জলবায়ু আন্দোলনের নেতাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা-বাসনাকে সাপ-লুডোর ৮৪-র খোপ থেকে সড়সড়িয়ে ২৮-এ নামিয়ে দিয়েছে। সেখান থেকে আরও কয়েক ঘর নেমে এল দু’দিন আগে, যেদিন ট্রাম্প তঁার সরকারের জ্বালানি মন্ত্রী হিসাবে বেছে নিলেন ক্রিস রাইটকে। যুক্তরাষ্ট্রর জীবাশ্ম জ্বালানি ও প্রাকৃতিক গ্যাসের বিশাল কারবারি এই ক্রিস রাইট। ট্রাম্পের মতো তিনিও মনে করেন জলবায়ু আন্দোলন নিছক ভঁাওতাবাজি ছাড়া আর কিছু নয়। ওই ফঁাদে পা দেওয়া মানে দেশের সর্বনাশ। কাজেই তঁারা যথেচ্ছ তেল তুলবেন। গ্যাস তুলবেন। ট্র‍্যাডিশনাল শিল্পে বিনিয়োগ করবেন যাতে দেশের বেকাররা চাকরি পায়। অভিবাসীদের দরজা-জানালাগুলো যথাসম্ভব বন্ধ করে শ্বেতাঙ্গ মার্কিনদের জন্য আমেরিকাকে আবার ‘মহান’ করে তুলবেন।

নার্সিসিস্ট ক্ষীণদৃষ্টি মেগালোম্যানিয়াক শাসকেরা সবার ভবিষ্যৎ নিয়ে কখনও চিন্তামগ্ন হয় না। দ্বিতীয় দফায় ট্রাম্পের উদয় ‘কপ২৯’-এর হাল মিয়োনো মুড়ির মতো করে তুলবে সেই আন্দাজ রাষ্ট্র সংঘেরও কর্তারা সম্ভবত আগেই পেয়েছিলেন। সেই কারণে অদ্ভুত একটা কাণ্ড ঘটেছে। ক্রিস রাইটের নিযুক্তির দিনেই রাষ্ট্র সংঘের জলবায়ু পরিবর্তনের নির্বাহী সচিব সাইমন স্টিয়েল একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিয়েছেন। তিনি সরাসরি জানিয়ে দেন, জলবায়ু নিয়ে বৈশ্বিক লড়াইয়ের নেতৃত্ব চিনকেই দিতে হবে। ট্রাম্পের মোকাবিলায় শি জিনপিংয়ের চিনকে নেতৃত্ব দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে সাইমন স্টিয়েল বলেছেন, চিন আরও কিছুটা এগিয়ে আসুক। নেতৃত্ব দিক। জলবায়ুর স্বার্থে তার নিজস্ব লক্ষ্যস্থির করে শক্তিশালী এক নতুন পরিকল্পনা (‘ন্যাশনালি ডিটারমাইন্ড কন্ট্রিবিউশন্‌স’ বা ‘এনডিসি’) পেশ করুক– যা উষ্ণায়ন প্রশমনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে।

ট্রাম্পের আমেরিকার সঙ্গে শি জিনপিংয়ের চিনের সম্পর্ক কতখানি ‘মধুর’, তা কারও অজানা নয়। ট্রাম্পের ধারণা, জলবায়ু নিয়ে এই হিড়িকের পিছনে চিনের ইন্ধন রয়েছে। লক্ষ্য, আমেরিকাকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়া। কাজেই ‘কপ২৯’-এর সাম্প্রতিক কানাকানি– সাইমন স্টিয়েল যা করতে চাইছেন তা কঁাটা দিয়ে কঁাটা তোলার মতো কি না!

জলবায়ুর ক্ষেত্রে ট্রাম্পের মতো শি জিনপিং নেতিবাচক নন। চিন ইতিমধ্যেই জানিয়েছে, ২০৬০ সালের মধ্যে তারা শূন‌্য নির্গমনের লক্ষ্যে পৌঁছবে। তবে আন্তর্জাতিক বিশ্বের চাহিদা, ২০৩৫ সালের মধ্যে তারা কার্বন নিঃসরণ অন্তত ৩০ শতাংশ কমিয়ে ফেলার ঘোষণা করুক। রাষ্ট্র সংঘের এই খেলার পরিণতি কী হয় সেই আগ্রহ জমা হচ্ছে।

বাকুর আর একটা বিস্ময় ভারতের ‘অনাগ্রহ’ ঘিরে। গ্লোবাল সাউথের নেতৃত্ব দিচ্ছে যে, দক্ষিণ এশিয়ায় কার্বন প্রশমন ও অভিযোজন বরাদ্দর সবচেয়ে বড় দাবিদার সেই ভারতের ভূমিকায় এবার সবার ভুরু কুঁচকেছে। নরেন্দ্র মোদি এলেন না। পরিবেশমন্ত্রী ভূপেন্দ্র যাদবও নন! পাঠানো হল প্রতিমন্ত্রী কীর্তি বর্ধন সিং-কে। তিনি এতটাই পালকের মতো হালকা যে, তঁার উপস্থিতিই অদৃশ্য রইল।

ভারত অবশ্য সরকারিভাবে বলছে, বাকুর আলোচ্য সূচি টাকাকড়ি-সংক্রান্ত। তাই রাষ্ট্রীয় স্তরের রাজনৈতিক নেতাদের উপস্থিতির প্রয়োজন নেই। দর-কষাকষির জন্য বিশেষজ্ঞরা এসেছেন। তঁারাই যতটুকু করার করছেন। তঁাদের দাবি, জলবায়ু বদলাতে তঁাদের বাৎসরিক অনুদান দিতে হবে ৬০০ বিলিয়ন ডলার। এক-এক দেশের এই ধরনের দাবি কতটা মিটবে, অর্থায়নের কতটা ঋণ হবে কতটাই বা অনুদান, সেসব পরের কথা। বাকুতে দেখলাম সবার মনে একটাই প্রশ্ন, ভারত একটা প্যাভিলিয়ন পর্যন্ত দিল না? এতটা অনাগ্রহ? জলবায়ু আন্দোলনে আন্তর্জাতিক স্তরের অন্যতম ভারতীয় মুখ হরজিৎ সিং পর্যন্ত বলে ফেললেন, এমনটা কখনও হয়নি। ‘কপ’-এ ভারত আছে অথচ তাদের একটাও প্যাভিলিয়ন নেই, ভাবতেই পারছি না! বলতে দ্বিধা নেই, একটু লজ্জাই লাগছে।

আজারবাইজানের মতো দেশে জলবায়ু সম্মেলন করা নিয়ে বিতর্কও থামছে না। গ্রেটা থুনবার্গ এই বিতর্ক অন্যভাবে উসকে দিয়েছেন। ২০১৯ সালে ‘টাইম’ ম্যাগাজিনের বর্ষসেরা এই ব্যক্তিত্ব বাকুতে সম্মেলনের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে বলেছেন, কোনও স্বৈরাচারী দেশে জলবায়ু সম্মেলন করা উচিত নয়। যে-দেশে গণতান্ত্রিক আবহ-ই নেই, মানবাধিকারের লেশমাত্র নেই, যেখানে সরকারের সামান্য সমালোচনা করলেও জেলে যেতে হয়, সেখানে এই ধরনের সম্মেলনের অর্থ স্বৈরাচারী প্রবণতায় বাতাস দেওয়া।

থুনবার্গ এই কথাটা বলেন আজারবাইজানের পাশের দেশ জর্জিয়ায় বসে। সম্মেলন শুরুর সময়ই। জর্জিয়ার রাজধানী টিবিলিসি থেকে বাকুর দূরত্ব সড়কপথে মাত্র ৬০০ কিলোমিটার। থুনবার্গ চেয়েছিলেন সড়কপথে বাকু আসতে। ‘কপ২৯’-এর আসরে উপস্থিত থাকতে। অল্প বয়সেই তিনি পরিবেশ নিয়ে চিন্তামগ্ন হয়েছিলেন। একটা সময় পরিবেশ রক্ষার স্বার্থে তিনি পরিবারের প্রত্যেককে ‘ভিগান’ হতে উদ্বুদ্ধ করে তোলেন। শুধু তা-ই নয়, পরিবেশের স্বার্থে গ্রেটা ও তঁার পরিবারের কেউ বিমানে চাপেন না। এহেন একজন সমালোচকের বাকু প্রবেশ ঠেকাতে আজারবাইজানের ‘স্বৈরাচারী’ প্রেসিডেন্ট ইলহাম হেইদার ওগলু আলিয়েভ ফরমান জারি করেন, ‘কপ২৯’-এ আসতে গেলে আকাশপথেই বাকু আসতে হবে। সড়ক বা সমুদ্রপথে নয়। থুনবার্গের বাকু-প্রবেশের ইতি ঘটে ওখানেই।

প্রেসিডেন্ট ইলহাম খুব-ই কড়া ধাতের শাসক। তেল ও গ্যাসের প্রাচুর্য তঁাকে অহংকারী করে তুলেছে। এতটাই যে, রাষ্ট্র সংঘের সেক্রেটারি জেনারেল আন্তোনিও গুতেরেসকে পাশে বসিয়ে সম্মেলনের উদ্বোধনী ভাষণে নাম না-করে আমেরিকা, কানাডা ও ইউরোপকে তুলোধোনা করেছেন। বলেছেন, তঁার দেশ যে পরিমাণ তেল ও গ্যাস তোলে, তা অন্যদের তুলনায় কিঞ্চিৎমাত্র। অতএব জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমাতে অন্যদের তারা যেন জ্ঞান না দেয়।

এখানেই শেষ নয়। সম্মেলন শুরু হতেই ইলহাম একহাত নেন ফ্রান্সকেও। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাক্রঁ বাকু আসবেন না আগেই জানিয়েছিলেন। পাঠাচ্ছিলেন তঁার পরিবেশমন্ত্রীকে। আর্মেনিয়ার সঙ্গে আজারবাইজানের যুদ্ধে ফ্রান্স গোপনে আর্মেনিয়াকে সমর্থন করেছিল বলে ইলহামের বিশ্বাস। সেই রাগ উগড়ে সম্মেলন চলাকালীন তিনি বলেন, ঔপনিবেশিক চরিত্রের দেশগুলো তাদের ছড়িয়ে থাকা কলোনিগুলির পরিবেশ নিয়ে মোটেই চিন্তিত নয়। কলোনিগুলোর উপর তারা নির্বিচারে ছড়ি ঘোরায়। ওরা-ই প্রকৃত অত্যাচারী। শোনামাত্র ফ্রান্সের পরিবেশমন্ত্রীও বাকু যাত্রা বাতিল করেন।

জলবায়ুর স্বার্থে দাতা দেশ আমেরিকা, রাশিয়া, চিন, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্সের পাশাপাশি ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়ার মতো গ্রহীতা দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব কেন বাকুতে গরহাজির থাকল, তার উত্তর কারও কাছে নেই। সম্মেলন তাই যেন মণিহারা ফণী। সম্মেলন শেষে কী ঘোষণা হবে, এখনও অজানা। কত অর্থ দিতে উন্নত বিশ্ব রাজি হবে, তাতে প্রয়োজন কতটা মিটবে, সেই ইঙ্গিত ছাড়াই বাকু ছাড়ছি। দেশে ফিরছেন আফ্রিকার পরিবেশ আন্দোলনকর্মী মহম্মদ আদুও। হতাশা না-লুকিয়ে তিনি তো বলেই দিলেন, ১৫ বছর ধরে কপ সম্মেলনে আসছি। আমার অভিজ্ঞতায় এটা সবচেয়ে খারাপ প্রথম সপ্তাহ। ৯ দিন পরেও স্পষ্ট রূপরেখা দেখছি না।
(মতামত নিজস্ব)

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement