Advertisement
Advertisement
International Mother Language Day

যৌথ পরিবার ভেঙে যাওয়ার মতোই হারিয়ে যাচ্ছে বহু বাংলা শব্দও

শব্দের যেমন অনুপ্রবেশ ভাষার মধ্যে ঘটে, তেমন সামাজিক কারণে অনেক শব্দ হারিয়ে যায়।

There is no need for controversy in case of Pani and Dawat's use in Bengali language। Sangbad Pratidin
Published by: Biswadip Dey
  • Posted:February 20, 2024 10:30 am
  • Updated:February 20, 2024 4:09 pm  

শব্দের যেমন অনুপ্রবেশ ভাষার মধ্যে ঘটে, তেমন সামাজিক কারণে অনেক শব্দ হারিয়ে যায়। বৈদ্যুতিক আলোর জন্য সমাজে ‘লণ্ঠন’-এর প্রয়োজনীয়তা হারিয়ে গিয়েছে। দুই জেনারেশনের পর কেউ লণ্ঠনকে মনেও রাখবে না। ঠিক সেভাবেই যৌথ পরিবার ভেঙে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে ‘ভাঁড়ার ঘর’, ‘ইঁদারা’, ‘জামবাটি’, ‘ইজিচেয়ার’ ইত্যাদি বহু শব্দ। লিখলেন কিংশুক প্রামাণিক

‘পানি’ কথাটি ‘পানীয়’ তথা ‘পান’-এর সঙ্গে সম্পর্কিত। নিখাদ ভারতীয় শব্দ। বাংলা বললেও অত্যুক্তি হয় না। পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া দেশের অধিকাংশ মানুষ জলকে ‘পানি’-ই বলে। কিন্তু ‘দাওয়াত’ শব্দটি বাংলা নয়। ভারতীয়ও নয়। এটি আরবি। আরও ভাল করে বললে, ইসলামি তমুদ্দুনের শব্দ। বাংলাদেশের মুসলিমরা ‘দাওয়াত’ বলে। শব্দটি পদ্মাপারের সমাজে এত ব্যবহার করা হয় যে, ক্ষেত্র বিশেষে হিন্দুরাও কখনও কখনও কাউকে নিমন্ত্রণ করে খাওয়ানোকে ‘দাওয়াত’ বলতে শুরু করেছে।

Advertisement

সে বলতেই পারে। তৃষ্ণা মেটাতে কে ‘জল’ বলবে, আর কে ‘পানি’ বলবে, কে বলবে ‘ওয়াটার’, সেটা তার নিজের ব্যাপার। তেমনই ‘দাওয়াত’ বলা যদি কারও অভ্যাস হয়, সেটা সে বলতেই পারে। গত বছর এই শব্দদ্বয় নিয়ে হঠাৎ বিতর্ক তৈরি করেছিলেন অতি পরিচিত বুদ্ধিজীবী শুভাপ্রসন্ন ভট্টাচার্য। বয়স্ক, অভিজ্ঞ হয়েও এমন ভাষ্য কেন তিনি দিলেন সেটা নিজেই বলতে পারবেন।

[আরও পড়ুন:  যাবে না চাকরি, বরং তৈরি হবে নতুন সুযোগ, কৃত্রিম মেধার প্রসার নিয়ে দাবি IBM কর্তার]

২০২৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি দেশপ্রিয় পার্কে ভাষা দিবসের মঞ্চে প্রবীণ চিত্রকর হঠাৎ এই দু’টি শব্দ উল্লেখ করে বাংলা ভাষার ‘গেল-গেল’ রব তোলেন। খুব স্বাভাবিক ভাবেই নানা দিক থেকে তীক্ষ্ণ সমালোচনা হজম করতে হয় তঁাকে। এমনকী, রাজনৈতিক বিতর্কেও জড়িয়ে পড়েন শ্রীভট্টাচার্য। তঁার বক্তব্য সমর্থন করেনি শাসক নেতৃত্বও। আসলে শুভাপ্রসন্নবাবু যে তাচ্ছিল্যের ঢঙে শব্দ দু’টির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন, তা শুনে মনে হতেই পারে বাঙালির মুখনিঃসৃত শব্দসমূহ সৃষ্টির আদিকাল থেকে চলে আসছে, এখানে আর কিছুর অনুপ্রবেশ ঘটেনি। অন্য দেশ, অন্য জনজাতি, অন্য রাজ্যের ভাষা বাংলায় মিশে যায়নি। আমাদের ভাষা পুরোদস্তুর ভার্জিন ও স্বতন্ত্র। লালন ফকির, চণ্ডীদাস, মাইকেল, বঙ্কিমচন্দ্র থেকে রবীন্দ্রনাথ– সুবিশাল বাংলা সাহিত্যে কবিতা গানে কথায় শুধু বাংলা শব্দই রয়েছে, কোনও বিজাতীয় শব্দ নেই।

মহাশয়, ইতিহাস কিন্তু তা বলে না। উক্তি করার আগে সেই ইতিহাসে একটু প্রসন্ন দৃষ্টি দেওয়া যেত। ভাষার বিবর্তন চিরন্তন। বিশেষ করে ভারতের মতো দেশে পঁাচ হাজার বছর ধরে ভাষার নব নব রূপান্তর ঘটেছে। নানা ভাষাভাষী মানুষ বহুকাল ধরে বাস করে। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী, সোমনাথ থেকে শিলং, পাহাড়, জঙ্গল, মালভূমি, কৃষিক্ষেত্র, গ্রাম থেকে নগর রচনা করেছে অসংখ্য জাত-ধর্ম-বর্ণ। বিচিত্র সংস্কৃতি, কৃষ্টির সঙ্গে আলাদা আলাদা ভাষা। আছে উপভাষা। সব মেলালে ভারতীয় ভাষার সংখ্যা কম করে দেড় হাজার। নানা সময়ে বিদেশি শাসকরা যখন এই দেশ দখল করে শয়ে শয়ে বছর রাজত্ব করল, তখন তাদের ব্যবহার করা সাধারণ শব্দগুলি মিশে গেল ভারতীয় সমাজে। হিন্দির মধে্য উর্দু, বাংলার মধ্যে অারবি। ব্রিটিশরা দিল ইংরেজি। কালক্রমে সেই শব্দগুলি ব্যবহারের ঢেউয়ে হয়ে উঠল অপরিহার্য।

[আরও পড়ুন: ‘কাঞ্চন আমাকে ভালো সামলাবে’, ৫৩-র তারকা বিধায়ককে বিয়ে করেই ট্রোলের জবাব শ্রীময়ীর]

কী ভাষায় সে কথা বলবে সেই অভ্যাস নিয়ে শিশু জন্মায় না। ‘মা’ যে ভাষা তাকে শেখায়, সেটাই তার ভাষা হয়। সেই জন্যই ‘মাতৃভাষা’ কথাটি। যা মাতৃদুগ্ধের মতো খাঁটি। সেই প্রেক্ষিতে ভাষা সম্পর্কে সরল উক্তিটি হল– গঙ্গার মতো এ-ও এক বহতা নদী। দু’হাজার কিলোমিটার যাত্রাপথে ভাগীরথীতে মিশেছে ছোট-বড় বহু স্রোত। সব জলে পুষ্ট হয়ে গঙ্গা গিয়েছে সাগরে। গোমুখ থেকে গঙ্গাসাগর, তৈরি হয়েছে নব নব সভ্যতা।

ভাষাও ঠিক তেমন। সময় যত গড়ায়, সৃষ্টি যত আদি হয়, অসভ্যতার অন্ধকার থেকে সভ্যতা যত আলো দেখায়, তত মানব জীবনের অভ্যাসের বদল হতে থাকে। তেমন বদল হয় ভাষাও। নতুন শব্দ জায়গা নেয়। জোর করে এই অভ্যাস তৈরি করা যায় না। মানুষ তার দৈনন্দিন কাজের মধ্য থেকে নতুন শব্দ খুঁজে নেয়। ‘কম্পিউটার’ শব্দটি বাংলা নয়। এই তো সেদিন কম্পিউটার অাবিষ্কার হল। আমরা কি তাহলে কম্পিউটারের বঙ্গীকরণ খুঁজতে যাব? ঠিক একইভাবে বাংলা ভাষার মধ্যে যুগে যুগে প্রবেশ করেছে নানা দেশের শব্দ।

১২০০ সালের অাগে বাংলা ভাষার অাগাপাশতলা শুধুমাত্র সংস্কৃতের প্রাচীন স্রোতেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্য থেকে বখ্‌তিয়ার খিলজি ভারতে অাসার পর– বাংলা ভাষায় অারবি শব্দ, আরও ভাল করে বললে, ইসলামি ভাবাবেগমাখা শব্দ ঢুকতে লাগল। দীর্ঘ সুলতানি, মোগল অামলে সেই শব্দগুলিই বাংলা ভাষায় ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যায়। একইভাবে ১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধে সিরাজের পরাজয়ের পর একদিকে যেমন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মধ্য দিয়ে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠা হয়, তেমনই গঙ্গার পার দিয়ে ফরাসি, ডাচ, ওলন্দাজ, পর্তুগিজদের উপনিবেশ স্থাপনের জেরে ‘মিনি ইউরোপ’ গড়ে ওঠে হুগলিতে। বিদেশিরা বসতি গড়ে বাংলা রপ্ত করার চেষ্টা করে। আবার তাদের ব্যবহার করা শব্দগুলি ঢুকে পড়ে বঙ্গসমাজে।

সেই দীর্ঘকালীন স্রোতে যে-শব্দগুলি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যায়, সেগুলির একাংশে চোখ বোলানো যাক। আজকের বাঙালি ব্যবহার করে বহু আরবি শব্দ। মাত্র তিনটি বলছি: ‘কলম’, ‘মালিক’, ‘মুনাফা’। বাঙালির ব্যবহৃত অতি পরিচিত ফরাসি শব্দ হল ‘আইন’, ‘কানুন’, ‘চশমা’, ‘রসদ’। ব্রিটিশদের ২০০ বছর রাজত্বের কারণে বঙ্গ সমাজে শয়ে-শয়ে ইংরেজি শব্দ ঢুকে গিয়েছে। তারা যে পরিকাঠামো উন্নয়ন করেছিল তার ইংরেজি নামকরণগুলি চলতি রূপ নেয়। যেমন, ‘ইউনিয়ন’, ‘স্কুল, ‘অফিস’, ‘ইউনিভার্সিটি’-র মতো শব্দ। ‘এজেন্ট’, ‘গ্লাস’, ‘ডায়েরি’, ‘ফুটবল’ ইত্যাদি আমাদের প্রভূত ব্যবহৃত শব্দ ইংরেজি। পর্তুগিজদের কাছ থেকে বঙ্গজাতি নিয়েছে ‘অানারস’, ‘অালপিন’, ‘অালকাতরা’, ‘অাচার’। ওলন্দাজরা দিয়ে গিয়েছে তাসের ‘রুইতন’, ‘হরতন’, ‘টেক্কা’। তুর্কি শব্দ থেকে আসা ‘উজবুক’, ‘কঁাচি’, ‘দারোগা’, ‘লাশ’। গ্রিক শব্দ থেকে ‘কেন্দ্র’, ‘সুড়ঙ্গ’। বহু দেশীয় শব্দও বাংলার সঙ্গে মিশে গিয়েছে। যেমন– হিন্দু শব্দ ‘চানাচুর’, ‘বার্তা’, ‘মিঠাই’, ‘টহল’ ইত্যাদি। গুজরাতি শব্দ ‘হরতাল’ কখন ঢুকে গিয়ে বাঙালির মনে।

শব্দের যেমন অনুপ্রবেশ ভাষার মধ্যে ঘটে, তেমন সামাজিক কারণে অনেক শব্দ হারিয়ে যায়। বৈদ্যুতিক আলোর জন্য সমাজে ‘লণ্ঠন’-এর প্রয়োজনীয়তা হারিয়ে গিয়েছে। দুই জেনারেশনের পর কেউ লণ্ঠনকে মনেও রাখবে না। ঠিক সেভাবেই যৌথ পরিবার ভেঙে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে ‘ভাঁড়ার ঘর’, ‘ইঁদারা’, ‘জামবাটি’, ‘ইজিচেয়ার’ ইত্যাদি বহু শব্দ। আর একটি সারসত্য হল: কুড়ি-পঁচিশ বছর পর বাঙালির মুখ থেকে ‘কাকা’, ‘কাকিমা’, ‘জেঠা’ ‘জেঠিমা’, ‘মাসি’, ‘মেসো’, ‘পিসি’, ‘পিসেমশাই’, ‘ভাই’, ‘বোন’ ইত্যাদি শব্দও হারিয়ে যেতে থাকবে। কারণ, এখন সবারই প্রায় এক সন্তান। যদি কারও দাদা না থাকে বোন না থাকে, তাহলে পরের জেনারেশনের জেঠু কে হবে? কে-ই বা হবে পিসি-মাসি?

রবীন্দ্রনাথের গল্পে ‘ঠাকুরপো’, ‘বটঠাকুর’, ‘বউঠান’, ইত্যাদি সম্বোধন রয়েছে। এখন এমন সম্বোধন কেউ করে না। কালে কালে হারিয়ে যাবে। বন্ধুর মাকে ‘কাকিমা’, ‘মাসিমা’, বলতাম আমরা। বাবাকে ‘কাকু’, ‘জেঠু’। এখন ‘অান্টি’ এবং ‘অাঙ্কল’। গোবলয়ের হিন্দিভাষীদের এই ডাক বাঙালির নিজের করে নিয়েছে।

বিশ্বে প্রায় ৫৯০৯টির মতো ভাষা আছে। তার মধ্যে ২৭ কোটি মানুষ বাংলায় কথা বলে। বাঙালিই একমাত্র জাতি যারা ভাষার জন্য অান্দোলন করে প্রাণ দিয়েছিল। পরে তাদের সেই লড়াই স্বীকৃতিতেই ২১ ফেব্রুয়ারি হয়েছে ‘অান্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’। বাংলা ভাষার উচ্চারণও সর্বত্র এক নয়। বঁাকুড়ার বাংলা ও চট্টগ্রামের বাংলার প্রকাশ আকাশপাতাল। তবে উচ্চারণ যা-ই হোক, হরফে বাংলা ভাষা তার স্বাতন্ত্র‌্য ধরে রেখেছে।

একটা সময় ছিল সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে পরিব্রাজকরা এলে জানা যেত ভিনদেশের ভাষা-কৃষ্টি-সংস্কৃতি। এখন সবকিছু মানুষের হাতের মুঠোয়। মুঠোফান এবং ইন্টারনেটের দৌলতে দুয়ারে বিশ্ব। কমিনিউকেশনের এই বিপ্লবে ভাষার দ্রুত বিবর্তন অবশ‌্যম্ভাবী। উগান্ডার ভূমিপুত্ররা কোন ভাষায় কথা বলে, অথবা ব্রিটিশ ও মার্কিন ইংরেজির উচ্চারণে অমিল কোথায়, আজকের শিশুরা জানে। স্বভাবতই শুভাপ্রসন্নবাবু অযথা বিতর্কে জড়ালেন। তবে এ-ও সত্য যে, বাংলা ভাষার বিদেশি শব্দ ঢুকলেও বাঙালিয়ানার সমস্যা নেই। আমরা যেন বিদ্যাসাগরকে ভুলে না যাই। অ-আ-ক-খ হারিয়ে গেলে বাঙালির অগস্ত‌্য যাত্রা নিশ্চিত হয়ে উঠবে। সেই দুর্দিন যেন কখনও না আসে!

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement