ফাইল ছবি
আমরা’-‘ওরা’ করা ঠিক নয়। তাতে সমাজের বুনিয়াদ ক্ষয়ে যায়। কিন্তু ‘অভয়া’-উত্তর ঘটনার প্রবাহ যেভাবে এগচ্ছে, তাতে সাধারণের মনে তৈরি হয়েছে পুলিশের
বিরুদ্ধে প্রবল উষ্মা। করোনার দিনগুলিতে ডাক্তার ও পুলিশ একযোগে আমাদের নিরাপত্তা দিয়েছিল। এখন সেই যৌথ ভেঙেচুরে দ। লিখছেন শ্রীপর্ণা দত্ত।
োটবেলায় ‘ইন্দ্রজিৎ’ বলে একটি বাংলা ছায়াছবি দেখেছিলাম। রঞ্জিত মল্লিক ‘সৎ’ পুলিশ অফিসারের ভূমিকায়। সামাজিক নানা অন্যায়ে দূষিত হয়ে যাওয়া সিস্টেমের বিরুদ্ধে জানকবুল লড়াই করছিলেন তিনি। দর্শকরা কোথাও যেন ‘এক’ হয়ে গিয়েছিলেন সেই সৎ পুলিশ অফিসারের একক লড়াই ও পথচলার সঙ্গে। এহ বাহ্য আগে কহ আর– কী আর বলব কত্তা– এ তো সিনেমা!
অথচ, বাস্তবে ‘পুলিশ’ সম্পর্কে সাধারণের মনে কিছু ধারণা বদ্ধমূল– পুলিশ মানেই ঘুষখোর, কোরাপ্ট সিস্টেমের সবচেয়ে বিশ্বস্ত সঙ্গী। নবারুণ ভট্টাচার্য লিখেছিলেন, ‘পুলিশ করে মানুষ শিকার’। যে-রাজনৈতিক কালবেলার প্রতিবেশে নবারুণ এই কবিতা লিখেছিলেন, সেসব অতীত করে পৃথিবীর বয়স বেড়েছে ঢের। সবুজ পাতা ক্রমে হলুদ হয়ে হেমন্তের অরণ্যে ডাক দিয়েছে পোস্টম্যানকে। এককালের ঊর্বশী এখন নামি এসকর্ট সার্ভিসের মালকিন। কাশবনের ঢেউ তুলে দূরে রেলগাড়ি দেখার সময় নেই। অপু বুলেট ট্রেনে ঘোরে। অ্যান্টেনা, আকাশ, ছেঁড়া ঘুড়ি, অফিস টাইম– সব বদলে গেল– শুধু সময়ের সঙ্গে বদল হল না পুলিশের। সাধারণের চোখে পুলিশ এখনও কোরাপ্ট সিস্টেমের সঙ্গী– ঘৃণীত সামাজিক জীব। সম্প্রতি, সবচেয়ে আলোচিত আর. জি. কর হাসপাতালে কর্তব্যরত মহিলা চিকিৎসকের ভয়াবহ ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের হাড়হিম করা ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। এই ঘটনায় সম্ভাব্য অভিযুক্ত হিসাবে উঠে এসেছে এক সিভিক ভলেন্টিয়ারের নাম, যে-ঘটনার বারো ঘণ্টার মধ্যেই গ্রেফতার হয়েছে। এই সংযুক্তি কোথাও একটা পুলিশের সামগ্রিক ভাবমূর্তিকে কলুষিত করেছে।
আর. জি. করে কর্তব্যরত মহিলা চিকিৎসকের ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ড নিয়ে সরব সাধারণ মানুষ, এর সঙ্গে আছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অবস্থান। ঘটনার শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ কখনও-কখনও রাজনৈতিক দুরভিসন্ধিতে রীতিমতো তাণ্ডবে পরিণত হয়েছে। সেই তাণ্ডবের ফলস্বরূপ, সংবাদমাধ্যমে দেখা গিয়েছে আহত বহু পুলিশকর্মীর ছবি।
না, সেসব রক্তাক্ত ছবি আমাদের বিষাদ, করুণা, অনুকম্পা কোনওটাই পায়নি, বরং বিদ্রুপ ও শ্লেষ পেয়েছে কিছুটা। কলকাতা পুলিশের এক সার্জেন্ট দেবাশিস চক্রবর্তী সারা জীবনের মতো হারিয়েছেন একটি চোখের দৃষ্টিশক্তি। তিনি সরকারি কাজে, অর্থাৎ আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখতে গিয়ে আহত হলেন, দৃষ্টি হারালেন, অথচ তিনি হয়তো ‘পুলিশ’ বলেই আমাদের তত মনোযোগ ও সহানুভূতি পেলেন না। ঠিক একইভাবে ১৪ অাগস্ট রাতে, একদিকে যখন ‘রিক্লেম দ্য নাইট’ চলছে, আর. জি. কর হাসাপাতালে দুষ্কৃতীদের আক্রমণ থেকে হাসপাতালের রোগী, চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী ও প্রতিবাদী জনগণকে রক্ষা করতে গিয়ে যঁারা আহত হয়েছিলেন, সেই রক্তাক্ত পুলিশকর্মীদের প্রতিও আমরা উদাসীন।
আর. জি. কর হত্যাকাণ্ডে প্রাথমিকভাবে অভিযুক্ত সিভিক ভলেন্টিয়ারের সূত্রেই আমরা পাবলিক ডোমেইনে সিভিক ভলেন্টিয়ারদের বিরুদ্ধে সার্বিক ক্ষোভ উগড়ে দিয়েছি। কোথাও সিভিক পুলিশদের দাদাগিরি, কোথাও বেআইনি কাজে মদত, কোথাও-বা দুর্ব্যবহার ইত্যাদি নানা নেতিবাচক বিষয়ে অভিযোগ রেখেছে মানুষ, প্রতিবাদীও হয়েছে। আর, এক্ষেত্রেও, যথারীতি আড়ালে থেকে গিয়েছেন আলি নওয়াজের মতো কেউ-কেউ। তিনি, পেশায় সিভিক ভলেন্টিয়ার, ৩১ আগস্ট রাত্রে কর্তব্যরত থাকাকালীন বাইক দুর্ঘটনায় ভয়াবহভাবে আহত বাইক আরোহীকে কোলে তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন হাসপাতালে, সময় নষ্ট করেননি অ্যাম্বুলেন্স আসা পর্যন্ত। এই নওয়াজ আলিরা সবসময় আড়ালে থেকে যান, তঁাদের জন্য কোনও সম্মান সমাজ দেখায় না। ওরা পুলিশ, আমরা মানুষ– ঠিক এই বিভাজনে সম্মান সচরাচর আমরা দেখাই না এই সমাজ-বন্ধুদের। আমরা ভুলতে বসেছি, পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ৮০ হাজার কর্তব্যরত পুলিশকর্মী আছেন, তঁারা সহনাগরিক। ন্যূনতম নাগরিক সম্মান তঁাদের প্রাপ্য। ২০২২ সালের পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, প্রতি পঁাচ হাজারে (মহিলা) প্রতি একজন করে মহিলা পুলিশ অফিসার রয়েছেন। সারা দেশের ১৫,৭৮৯ থানার মধ্যে ৬১৩ থানা মহিলা পরিচালিত, মহিলাদের আইনি সুরক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে।
কোভিড অতিমারীর সময় চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা যেমন অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন, পুলিশকর্মীরাও ঠিক একইভাবে নিরলস খেটেছেন, আমাদের ভাল রাখতে। কোভিডের প্রবল সংক্রমণের মুখে প্রথম সারিতে দঁাড়িয়ে সামাজিক পরিষেবা দিতে গিয়ে বাংলায় প্রায় ৭,৯৬৩ পুলিশকর্মী কোভিডে সংক্রমিত হয়েছিলেন, এবং ২৪ জন মারণ ভাইরাসে প্রাণ হারিয়েছেন।
এখন ‘ডাক্তার’ বনাম ‘পুলিশ’ হয়ে সেসব তথ্য ভুলতে বসেছি। পুলিশ তুমি কার? বিভিন্ন রাষ্ট্রনেতার সঙ্গে পুলিশের অঁাতঁাত গঠন করে, প্রশাসনের রাজনৈতিক পরিচয়ের সঙ্গে তা মিলিয়ে, সহজেই গুলিয়ে দেওয়া যায় পুলিশের কর্তব্যবোধকে। পুলিশ যেহেতু প্রশাসন পরিচালনার অন্যতম শক্তি, তাই চট করে এই ভেদভাবকে সহনীয়ও করা যায় না। তাই কখনও শুনতে হয়– ‘পুলিশের বন্দুকে কি নিরোধ পরানো আছে’, কখনও শুনতে হয় ‘পুলিশ তো চটিচাটা দলদাস’, তো কখনও ধ্বনিত হয় ‘পুলিশ তুমি চিন্তা করো/ তোমার মেয়েও হচ্ছে বড়’। ধর্ষণের প্রতিবাদে যৌন ইঙ্গিতবাহী এমন থ্রেট সত্যি বিরল!
মতামত নিজস্ব
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.