ভারতীয় সংবিধান কোনওভাবেই রাজ্যপাল বা লেফটেন্যান্ট গভর্নরকে নাগরিক দ্বারা নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে যাওয়ার ক্ষমতা প্রদান করছে না, করেনি। কিন্তু সম্প্রতি দেশজুড়ে বিভিন্ন রাজ্যে, মূলত অ-বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে সরকারের উলটো দিকে মোতায়েন করা হয়েছে এমন সব রাজ্যপালকে, যাঁরা সংবিধানকে উল্লঙ্ঘন করে রাজ্য সরকারের বিরোধিতায় মগ্ন। দিল্লি থেকে কেরল, পশ্চিমবঙ্গ থেকে পাঞ্জাব- সর্বত্র। এবং এই সমস্ত রাজ্যপালই বিজেপি তথা কেন্দ্রীয় সরকার ঘনিষ্ঠ। নেহাতই কাকতাল? কলমে রাজদীপ সরদেশাই
দেশের রাজধানী সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ভিভিআইপি-র ঠিকানা। প্রশ্ন জাগতে পারে দিল্লির ‘বিগ বস’ কে? কার অঙ্গুলিহেলনে দিল্লি শাসনাধীন? দিল্লির কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল যাদের অধীন, সেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের? নাকি, লেফটেন্যান্ট গভর্নরের, যিনি কেন্দ্রের প্রতিনিধি হিসাবে কর্তৃপক্ষের শীর্ষে? নাকি রাজধানীর মুখ্যমন্ত্রী, যাঁর শাসনে দিল্লি শহরটা চলছে? আইনি অস্বচ্ছতা এবং ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক সংঘাতের জাঁতাকলে কে যে কার পক্ষ নেবে, তার খেলা মেতে উঠেছে। বিশেষত, অ-নির্বাচিত সংসদীয় ও সাংবিধানিক ব্যক্তিবর্গ তথা রাজ্যপালদের মধ্যে, যাঁরা দেশজুড়ে বিলাসবহুল রাজভবনগুলিতে ঘাঁটি গেড়ে বসে আছেন।
সাম্প্রতিকতম উদাহরণ, দিল্লিরই ঘটনা। এবং তা লেফটেন্যান্ট গভর্নর ভি কে সাক্সেনা এবং মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের মধ্যে। বিবাদের বিষয় কে হবেন শহরের মেয়র, সেই সংক্রান্ত নির্বাচন। গভর্নর তো একরোখাভাবে রাজ্য সরকারের মতামত অগ্রাহ্য করে তঁার নিজের পছন্দের ‘অ্যাল্ডারমেন’ তথা নগরপালের নাম মনোনীত করে প্রিসাইডিং অফিসার হিসাবে বসিয়ে দিলেন ‘মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন অফ দিল্লি’ (এমসিডি)-র দায়িত্বে। ব্যস, আর কী। মহা হট্টগোল বেঁধে গেল পুরসভার অন্তর্গত আমআদমি পার্টি ও বিজেপি-র কাউন্সিলরদের মধ্যে। পরিণতি মেয়র নির্বাচন আপাতত স্থগিত।
দুই তরফেই অভিযোগের বন্যা বইছে এখন। কিন্তু সবচেয়ে বড় অভিযোগটি হল, স্বাভাবিকভাবেই লেফটেন্যান্ট গভর্নরের ভূমিকাটি তাহলে কী? তিনি একজন নিরপেক্ষ নির্ধারক, নাকি প্রতিদ্বন্দ্বী দু’টি রাজনৈতিক দলের মধে্য একটির দ্বাদশ ব্যক্তি হয়ে নির্বাচিত সরকারের ক্ষমতাকে পেরিয়ে যেতে চাইছেন? তঁার ভাবভঙ্গিমা এমনই যে, যেন-বা কেজরিওয়ালের সরকার তঁার কাছে অপ্রয়োজনীয় না হলেও, অপ্রাসঙ্গিক তো বটেই! কিন্তু ‘গভর্নমেন্ট অফ ন্যাশনাল ক্যাপিটাল টেরিটরি অফ দিল্লি (জিএনসিটিডি) অ্যাক্ট, ১৯৯২’ তো বলছে অন্য কথা। লেফটেন্যান্ট গভর্নরের কাজ রাজে্যর মন্ত্রিসভাকে গুরুত্বপূর্ণ মতামত দেওয়া, সহায়তা করা বা ‘এইড অ্যান্ড অ্যাডভাইস’ প্রদান (পুলিশি ব্যবস্থা, জনাদেশ এবং জমিজমা সংক্রান্ত বিষয় ব্যতিরেকে)। এবং, এর মানে কিন্তু মোটেও এমন নয় যে, সেসব প্রয়োগ করার ক্ষমতাও তঁার হাতে। মতামত গ্রহণ করবে কি না, এবং চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নির্বাচিত সরকারের হাতেই ন্যস্ত। এর অন্য কোনও মানে তৈরি করলেই তা সংবিধানের উল্লঙ্ঘন।
যদিও, ২০২১-এর মার্চ মাসে, বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠতায় চালিত সংসদ ‘জিএনসিটিডি অ্যাক্ট’-এ পরিমার্জন নিয়ে চলে এসেছে, যার মধ্য দিয়ে রাজ্য সরকারের ক্ষমতা অনেকখানি শিথিল করে দেওয়া হয়েছে এবং রাজ্যপালের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে প্রায় সমস্ত ক্ষমতা ও আধিপত্য, যার মাধ্যমে সেই রাজে্যর ক্যাবিনেট মিটিংয়ে নির্ধারিত সিদ্ধান্তের উপর যেমন-ইচ্ছা ছুরি-কঁাচি চালাতে পারবেন, এবং দিতেও পারবেন ইচ্ছামতো তাপ্পি! এই অ্যামেন্ডমেন্টেই ঘোষিত হল, রাজধানীর কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের প্রশাসক তথা রাজ্যপালকে ‘লেফটেন্যান্ট গভর্নর-অ্যাডমিনিস্ট্রেটর’ হিসাবে ঘোষিত হবেন। আর এই নতুন আখ্যায়নের মধ্য দিয়ে বোঝাই যাচ্ছে, এই প্রশাসকের হাতে সমস্ত ক্ষমতা ন্যস্ত, যা দিয়ে রাজ্য সরকারের সিদ্ধান্ত মুচড়ে ফেলা যায়।
আর গত বছরের মে মাস থেকে সেটাই হয়ে আসছে, যবে সাক্সেনা সাহেব লেফটেন্যান্ট গভর্নর পদে নিযুক্ত হলেন। প্রায় প্রতে্যকটি বিষয়ে তিনি জনসমক্ষে কেজরিওয়াল সরকারের বিপরীতে নাক গলিয়েছেন এবং দ্বন্দ্বে গিয়েছেন। আর যেন সেভাবেই হরেদরে দিল্লির শাসন কায়েম করে ফেলেছেন। হালে, জানা যাচ্ছে, আমলারা নাকি মুখ্যমন্ত্রী ও তঁার ক্যাবিনেট পাশ কাটিয়ে সরাসরি এখন লেফটেন্যান্ট গভর্নরের অফিসে ঢুকে পড়েন। ভাবা যায় না, তিন-তিনবার নির্বাচিত একজন মুখ্যমন্ত্রী– যার মধে্য দু’বার তো তাবৎ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়লাভ করা– এমন একজন ব্যক্তি ও তঁার সরকারকে কিনা অ-নির্বাচিত এক সরকারি প্রতিনিধির কাছে মাথা নত করে থাকতে হচ্ছে! এটা সাংবিধানিক গণতন্ত্রের নিরিখে হাস্যকর, লজ্জাজনক। কেন্দ্রের মন্ত্রীমশাইরা ভেবে দেখেছেন, কাল যদি রাতারাতি কেন্দ্রকে অগ্রাহ্য করে দেশের রাষ্ট্রপতি দেশটা চালাতে শুরু করেন, তাহলে তঁাদের কেমন লাগবে? নির্বাচনী প্রচারাভিযানে যে যে প্রতিশ্রুতি কেজরিওয়াল রেখেছিলেন, সেসব পরিপূর্ণ না হতে পারলে তঁার সরকারকে দোষ দিয়ে কী লাভ? তঁার মন্ত্রীদেরই তো ক্ষমতাহীন করে রেখে দেওয়া হয়েছে!
দুর্ভাগে্যর বিষয়, গত আট বছর ধরে, দিল্লির নাগরিকরা কেন্দ্রের আধিপত্যবাদী মোদি সরকার এবং তার বিরোধী কেজরিওয়াল সরকারের রাজনৈতিক দড়ি টানাটানির মাঝে আটকা পড়ে নাজেহাল। রাজ্য এবং পুরসভা নির্বাচনের ফলাফলে দেখাই গিয়েছে, কেজরিওয়াল হলেন দিল্লির নেতা নম্বর ওয়ান। দিল্লির পাড়া-মহল্লায় ‘আপ’ পার্টির পৌঁছ দারুণ। আপ পার্টির ভাবধারা এবং তাদের কার্যকারণ নিয়ে তর্ক থাকতে পারে, কিন্তু তাদের জনপ্রিয়তা তর্কাতীত। দিল্লিতে কেজরিওয়ালের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য বিজেপি বারবার ঘুঁটি বদল করেছে, বিভিন্ন ধরনের ব্যক্তিত্বকে নিয়ে এসেছে, কিন্তু হারাতে পারেনি। আর তাই, কেজরিওয়ালকে টাইট দেওয়ার জন্য লেফটেন্যান্ট গভর্নর পদ যেন বা হয়ে উঠেছে তাদের শেষ আশ্রয়!
সরকারি কর্মকর্তাদের এভাবে অনৈতিক ও অসাংবিধানিকভাবে কাজে লাগানো যদিও নতুন কিছু নয়। কিন্তু এই ব্যাপারটা অভিনব পদ্ধতি, যা প্রচণ্ডভাবে নির্বাচিত সরকার ও গণতন্ত্রের ধারণার কাছে অশুভ লক্ষণ। দেখুনই না, দেশজুড়ে যেখানে যেখানে কেন্দ্র-বিরোধী রাজ্য সরকার, সেখানে সেখানে সেই সরকার ও রাজ্যপালের মধে্য কেমন অসন্তোষ! যেন রাজভবনে আসীন ব্যক্তিটি নিজেই একটি দল হয়ে উঠেছে এবং সরকারের বিরুদ্ধে নেমে পড়েছে। অথচ, সেই ব্যক্তির সংবিধানের নিরিখে সরকারের নিরপেক্ষ অভিভাবক হওয়ার কথা।
রাজ্যপাল পদের প্রতি কর্তব্যহীনতার নজির আরও আছে। সম্প্রতি তামিলনাড়ুর রাজ্যপাল আর. এন. রবি যেমন একটা ভাষণ দেওয়ার সময় নিজের বক্তব্য থেকে বিচু্যত হয়ে আচমকাই বিধানসভা থেকে বেরিয়ে গেলেন। এটা তো সাংবিধানের অপমান। অদ্ভুত এই রাজ্যপাল! রাজ্যর বিভিন্ন বিল নিয়ে তরজা করছেন, ভারী ভারী রাজনৈতিক মন্তব্য ছুড়ছেন যেখানে সেখানে, এমনকী ‘তামিলনাড়ু’ নাম পরিবর্তনের ধুয়ো তুলছেন!
শুধু ইনি-ই নন, কেরলের রাজ্যপালও কিছু কম যান না। সেখানের রীতিমতো হাই প্রোফাইল রাজ্যপাল আরিফ মহম্মদ খান তো যখন-তখন খোলা তরজায় লেগে পড়েন মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়নের সঙ্গে। পাঞ্জাবের রাজ্যপালও আছেন। তিনি বিধানসভায় একটি বিশেষ অধিবেশনের ডাক দিতে অস্বীকার করেন। মহারাষ্ট্রের রাজ্যপালও বা কী কম যান। রাজ্যপাল বি এস কোশিয়ারি– উত্তরাখণ্ডের প্রাক্তন বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী। তঁার নামে তো শিবসেনা দলের প্রতি বিদ্রোহী মন্ত্রী ও বিধায়কদের একজোট করে, এমনকী সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অমান্য করে নতুন সরকার গঠনে প্ররোচিত করার অভিযোগ রয়েছে। ওদিকে তেলেঙ্গানাতেও মুখ্যমন্ত্রী কে. চন্দ্রশেখর রাও এবং সেখানকার রাজ্যপাল তামিলসাই সৌন্দরাজনের মধে্য বিতণ্ডার অন্ত নেই। এই সৌন্দরাজনও আর-এক বিজেপি রাজনীতিকের দৃষ্টান্ত, যঁার এখন রাজভবনে বাস।
বিজেপি একসময় অভিযোগ করত, বিগত কেন্দ্রীয় সরকার, অর্থাৎ কংগ্রেস শাসিত সরকার নাকি রাজভবন তথা রাজ্যপালের ক্ষমতাকে অপব্যবহার করেছে। কিন্তু, সেই অভিযোগ করার স্পর্ধা তাদের আর থাকা উচিত নয়। কারণ, তারাও সেটাই করছে। রাবার স্ট্যাম্প অবধি যে সরকারি প্রতিনিধির দৌড়, সেই প্রতিনিধি বেমক্কা রাজ্য সরকার উৎখাত করে দিচ্ছে– কংগ্রেসের জমানায় এসব ঘটনার অভিযোগ টেনে বর্তমান পরিস্থিতিকে জায়েজ করে ফেলা যাবে না। বিশেষ করে, যেখানে রাজনৈতিক অভিসন্ধি ভয়ংকরভাবে যুক্ত। সংবিধানের ১৫৪ (২) (ক) ধারায় লেখা আছে– ‘এই অনুচ্ছেদের কোনও বক্তব্যই রাজ্যপালের কাছে বিদ্যমান আইন বা অন্য কোনও কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রদত্ত কোনও কার্যাবলির হস্তান্তর বলে গণ্য হবে না।’ মোদ্দা কথা, ভারতীয় সংবিধান কোনওভাবেই রাজ্যপাল বা লেফটেন্যান্ট গভর্নরকে নাগরিক দ্বারা নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে যাওয়ার ক্ষমতা প্রদান করছে না, করেনি। একরোখা মোদি সরকার যদি সংবিধানের এই ক্ষমতার ব্যবধানকে বুঝতে ও গ্রহণ করতে অসমর্থ বা অনিচ্ছুক হয়, তাহলে সুপ্রিম কোর্টের আবশি্যকভাবে উচিত তা মনে করিয়ে দেওয়া। এবং তার জন্য বেশি দেরি না করাই বাঞ্ছনীয়।
পুনশ্চ: ২০১৯ এবং ২০২২-এর মধে্য, জগদীপ ধনকড় ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল। সেখানে তিনি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দে্যাপাধ্যায়ের সঙ্গে বারবার, একাধিকবার দ্বন্দ্বে রত হয়েছিলেন। গত বছরের আগস্ট মাসে, ধনকড় সাহেবকে কলকাতা থেকে স্থানান্তরিত করে দেশের উপ-রাষ্ট্রপতি করা হয়েছে। আর এই বিষয়ে টিভির একটি বিতর্কসভায় ডিএমকে-র এক মুখপাত্র দারুণ হেঁয়ালি করেছিলেন– ‘মোটামুটি দৃষ্টান্ত তৈরি করা হয়েই গিয়েছে– অ-বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে তোপ দাগতে থাকাই হল একজন রাজ্যপালের কৃতিত্ব। আর ঠিকঠাক কাজে লাগলে যথোপযুক্ত পুরস্কারও আছে!’
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.