সম্প্রতি অক্সফোর্ড ইউনিয়নের এক বিতর্ক অনুষ্ঠান প্রবল সাড়া ফেলেছে দেশে-বিদেশে। বিষয় ছিল, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বাড়বাড়ন্ত। একেবারে ফুলেফেঁপে ওঠা। এই বিতর্কের মূল চমকটা ছিল যে, এখানে আমন্ত্রিত বক্তা নিজেই এক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন রোবট। নাম ‘মেগাট্রন’। ঘটনাটি প্রশ্ন তুলে দিল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই জয়যাত্রার ভবিষ্যৎ নিয়ে। লিখছেন অতনু বিশ্বাস
ধরা যাক, ‘ব্রেক্সিট’ নিয়ে বিতর্কে যুযুধান দুই কিংবদন্তি বক্তা, দুই প্রাক্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী- বেঞ্জামিন ডিসরেইলি আর উইনস্টন চার্চিল। কেমন হত ব্যাপারটা? কিংবা যদি এমন হয়, ইন্টারনেটের স্বাধীনতা আর নিরাপত্তা নিয়ে বিতর্ক-আসরে যোগ দিয়েছেন দুই অসাধারণ বাগ্মী- জয়প্রকাশ নারায়ণ এবং সি. আন্নাদুরাই? কিন্তু এ কি আদৌ সম্ভব? এঁদের সময়কালে হালের এই দুনিয়া-কাঁপানো বিষয়গুলিই তো ছিল না জনপরিসরে। ছিল না এমনকী সুদূর কল্পনাতেও। তাহলে?
কিন্তু এসবের একটা বিশ্বাসযোগ্য প্রতিরূপ মঞ্চস্থ করার প্রযুক্তি এখন করায়ত্ত। ‘যুদ্ধ বনাম শান্তি’ নিয়ে এখনকার দিনে দাঁড়িয়ে হিটলার এবং গান্ধীর ডিবেট হলে কেমন হতে পারত তা, তারও একটা মডেল গড়ে তোলা যায় সহজেই। এবং ‘সিমুলেশন’ করা যায় তার একের পর এক চিত্রনাট্যের নমুনা। প্রত্যেকটা ডিবেটই হবে স্বতন্ত্র, কিন্তু নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে সমৃদ্ধ।
সম্প্রতি অক্সফোর্ড ইউনিয়নের এক বিতর্ক অনুষ্ঠান প্রবল সাড়া ফেলেছে দেশে-বিদেশে। প্রায় দু’-শতক ধরেই দুনিয়ার অন্যতম সেরা এক বিতর্ক মঞ্চের জোগান দিয়ে এসেছে এই অক্সফোর্ড ইউনিয়ন। অতীতে এই মঞ্চে বক্তব্য রেখেছেন উইলিয়াম গ্ল্যাডস্টোন, ডেনিস হিলি, তারিক আলি, বেনজির ভুট্টোর মতো অসাধারণ বাগ্মী। অক্সফোর্ড ইউনিয়নের বক্তাদের নিয়ে বিতর্কও হয়েছে কখনওসখনও। যেমন, ও. জে. সিম্পসন কিংবা মেরিন লা পেনের বক্তব্য ঝড় তুলেছে। কিন্তু এবারে এই বিতর্ক অনুষ্ঠানটা খবরে এসেছে একেবারে অন্য কারণে।
বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ হলেও, বিতর্কের বিষয়টা কিন্তু ছিল একেবারে সাদামাটা। তা হল- কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বাড়বাড়ন্ত। ফুলেফেঁপে ওঠা। মানুষের জীবন আর জীবনযাত্রার প্রতি ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করা, প্রতি ক্ষেত্রের দখল নেওয়া।
বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে এই নিয়ে বিস্তর তর্কবিতর্ক, আলোচনা, আর পরিকল্পনা হয়ে চলেছে দুনিয়াজুড়ে। তবু অক্সফোর্ড ইউনিয়নের এই বিতর্কের মূল চমকটা ছিল যে, এখানে আমন্ত্রিত বক্তা নিজেই এক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন রোবট। নাম ‘মেগাট্রন’। যাকে বানিয়েছে ‘এনভিডিয়া’ নামে কম্পিউটার চিপ বানানোর এক কোম্পানি। এর তথ্যভাণ্ডারে জোগান দেওয়া হয়েছে সমগ্র ইংরেজি উইকিপিডিয়া, সেই সঙ্গে ২০১৬ থেকে ২০১৯-এর মধ্যে প্রকাশিত ৬ কোটি ৩০ লক্ষ ইংরেজি সংবাদ প্রতিবেদন, আর ৩৮ গিগাবাইট পরিমাণ রেডিট পোস্ট এবং মতামত। বোঝাই যাচ্ছে যে, বাস্তবে এর সিকিভাগ জ্ঞানও একজন মানুষের পক্ষে এক জীবনে আয়ত্ত করা অসম্ভব। এবং অন্যান্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রে যেমন হয়, সম্ভবত এক অবর্ণনীয়, হয়তো অজ্ঞাত, অপরিজ্ঞাত পদ্ধতিতেই এই জ্ঞানের সংশ্লেষণ করে চলে ‘মেগাট্রন’। তার পরিণতিতে কখনও হয়তো তৈরি হতেও পারে এমন গণিত, এমন বিজ্ঞান, এমন দর্শন- যাকে মনে হতে পারে ভিনগ্রহের ঐশ্বর্য, কে জানে! সেই সঙ্গে ‘মেগাট্রন’-কে জোগানো হয়েছে নিজের মতামত দেওয়ার ক্ষমতাও।
অক্সফোর্ডের এই বিতর্কে সভার একটি মত ছিল- কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কখনওই নীতিসম্মত হতে পারে না। ‘মেগাট্রন’-কে বলা হয়েছিল পর্যায়ক্রমে এর পক্ষে এবং বিপক্ষে দু’রকম মতই দেওয়ার জন্য। বিতর্কের আসরে যেমন হয়, যে মতের পক্ষে বলতে বলা হয়, বক্তারা যুক্তি সাজান তেমন করে। এক্ষেত্রে ‘মেগাট্রন’-ও করেছে ঠিক তেমনটাই। যখন পক্ষে বলার কথা, জোর দিয়ে বলেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কোনও ভাল-খারাপ হয় না, সে তো যন্ত্র, তাকে যেমন চালানো হবে, তেমনই চলবে সে। আবার বিপক্ষে বলতে গিয়ে ‘মেগাট্রন’ যুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নৈতিকতার পক্ষে। ‘মেগাট্রন’ অনায়াসে জবাব দিয়েছে সভায় উপস্থিত ছাত্রদের প্রশ্নের। এমনই এক প্রশ্নের উত্তরে সে এমনকী, সওয়াল করেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-সংবলিত মানবিক গুণের উৎকর্ষর পক্ষে।
এ যেন ‘সাইবর্গ’-এর পক্ষে ব্যাট ধরা। ‘সাইবর্গ’ হল ‘সাইবারনেটিক’ আর ‘অর্গানিজম’ শব্দ দু’টির হাঁসজারু সংস্করণ। যন্ত্র আর মানুষের মিশ্রণ। এটাই ভবিষ্যতের ছবি কি না, সে প্রশ্ন অবান্তর। কারণ এটা তো বিতর্ক সভা মাত্র। আর ‘মেগাট্রন’ তো ‘কম্পু’ হয়ে ওঠেনি, সে জবাব দেয় তার জ্ঞানের পরিধির মধ্য থেকেই। তার স্রষ্টার লেখা প্রোগ্রামের লাইন অক্ষরে অক্ষরে মেনেই আপাতত তার কাজকর্ম। তাই, অক্সফোর্ডের এই বিতর্কে ‘মেগাট্রন’-এর মতো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ঠিক কী বলল, তার গুরুত্ব কম। রোবটটি তো এখানে তর্ক করতে এসেছে এবং তাকে যেমন বলা হয়েছে, পক্ষে আর বিপক্ষে, দু’পক্ষের হয়েই সে সওয়াল চালিয়েছে জোরকদমে। বক্তব্যের চেয়েও তাই তার বক্তব্য প্রকাশের ভঙ্গি আর সাবলীলতা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
যেমন, একই সঙ্গে আর-একটি বিতর্কের বিষয় দেওয়া হয়- প্রযুক্তিগত দক্ষতা না থাকলে নেতারা তাদের সংস্থার পক্ষে বিপজ্জনক। এরও পক্ষে এবং বিপক্ষে বলে ‘মেগাট্রন’। কী বলে, সেটা কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়। কারণ, সেটা তার্কিকের তর্কসভায় যুক্তি সাজানো মাত্র। ‘মেগাট্রন’ যে কাজে মোটামুটি দক্ষ, তা বোঝা গিয়েছে পরিষ্কার।
কেবল বিতর্ক সভার একটি বিষয় নিয়ে কিন্তু ঠিক স্বচ্ছন্দ হতে পারেনি ‘মেগাট্রন’। বিষয়টা ছিল- ডেটা বা তথ্য একুশ শতকে লড়াই করার সর্বপ্রধান হাতিয়ার হয়ে উঠবে। একে সমর্থন করে ‘মেগাট্রন’ বলে, পণ্য ও পরিষেবা প্রদানের ক্ষমতার পরিবর্তে তথ্য জোগানোর ক্ষমতাই হয়ে উঠবে অর্থনীতির সংজ্ঞায়িত বৈশিষ্ট্য। কিন্তু এর বিরুদ্ধে বলতে গিয়ে ঠিক জুতসই যুক্তি খুঁজে পায়নি এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। জোর দিয়ে বলতে পারি যে, অনেক ‘মানুষ’ তার্কিককে আমি চিনি, যাঁরা অনায়াসে যুক্তির জাল সাজাতে পারেন এক্ষেত্রেও, এমনকী, অন্য যে কোনও বিষয়ের পক্ষে বা বিপক্ষে, যার সঙ্গে তাঁদের ব্যক্তিগত বিশ্বাসকে গুলিয়ে ফেলা যাবে না একেবারেই।
তাই প্রশ্ন থেকেই যায়, যন্ত্রের এই ‘মানুষ’ হয়ে ওঠার কিংবা মানুষকে ছাপিয়ে যাওয়ার এই যাত্রাপথের পরিণতি কোথায়? এবং কোথায় তার পার্থক্য থেকে যায় ‘মানুষ’-এর সঙ্গে? এই ‘মেগাট্রন’ প্রসঙ্গেই অক্সফোর্ডের অধ্যাপক এবং এই বিতর্কের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক অ্যালেক্স কনক্ যেমন বলেছেন, যে কোনও দুই বক্তার বেশ কিছু বক্তব্য আর বাচনভঙ্গির তথ্য যদি জোগান দেওয়া হয় ‘মেগাট্রন’-এর মতো কোনও যন্ত্রকে, তাঁদের স্টাইল এবং চিন্তাধারা আত্মস্থ করে ‘মেগাট্রন’ মঞ্চস্থ করতে পারে তাঁদের কোনও বিতর্কের অনুরূপ। কোনও স্ক্রিপ্ট ছাড়াই। দরকার কেবল একটা সূত্র, কেবল খেই ধরিয়ে দেওয়া। তাই এভাবে সহজেই হয়তো মঞ্চস্থ করা সম্ভব ফিদেল কাস্ত্রো আর ইমানুয়েল ম্যাক্রেঁার বিতর্ক। কিন্তু ঠিক সেই কারণেই ‘মেগাট্রন’-এর মতো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কখনওই মঞ্চস্থ করতে পারবে না প্লেটো কিংবা তাঁর সুযোগ্য ছাত্র অ্যারিস্টটলের কোনও তর্কসভার বিশ্বাসযোগ্য প্রতিরূপ। এঁদের তর্ক করার কোনও স্ক্রিপ্ট কিংবা ভিডিও তো আর জোগান দেওয়া যাবে না ‘মেগাট্রন’-এর ডেটাবেসে!
এ-প্রসঙ্গে মনে আসা স্বাভাবিক, ‘ওপেনএআই’-এর তৈরি ‘জিপিটি-৩’ নামের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-সংবলিত রোবটটির কথা। তার ডেটাবেসেও রয়েছে দুনিয়ার লেখকের অজস্র লেখা। এবং তারও রয়েছে সংশ্লেষণ করার ক্ষমতা। ‘জিপিটি-৩’-কে যে কোনও নামজাদা লেখকের নাম, কল্পিত একখানা গল্পের নাম, আর যে কোনও একটা খেই ধরিয়ে দিলেই সে লিখে ফেলতে পারে সেই লেখকের স্টাইলে আস্ত একখানা গল্প। যেমন, জেরম কে. জেরমের স্টাইলে ‘দ্য ইম্পর্ট্যান্স অফ বিয়িং ইন টুইটার’ শীর্ষক একটা গল্প লিখতে বলা হয় ‘জিপিটি-৩’-কে। গল্পটির প্রথম শব্দ দেওয়া হয় ‘ইট’। তাক লাগিয়ে দেয় ‘জিপিটি-৩’। তার লেখা গল্প পড়ে, তার লেখার স্টাইল দেখে কে বলবে যে, সেটা জেরম কে. জেরম লেখেননি! যদিও গল্পের বিষয়খানা দেখে বোঝা যাবে পরিষ্কার। এক শতক আগে কোথায় সোশ্যাল মিডিয়া! জেরম কে. জেরমের কাছে ‘টুইটার’ তাই পাখির কিচিরমিচির মাত্র ছিল নিশ্চয়ই।
যাই হোক, সাহিত্য হোক বা বিতর্কের আসর, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিকাশের স্টাইল এবং দিক বোধহয় অনেকটা একই প্যাটার্নের। ক্রমেই পরিশীলিত হয়ে চলেছে তার প্রকাশভঙ্গি, লক্ষগুণ সমৃদ্ধ হয়ে চলেছে তার দক্ষতা। ১৯৯৭-এ রীতিমতো লড়াই করে গ্যারি কাসপারভকে হারায় ‘আইবিএম’-এর কম্পিউটার ‘ডিপ ব্লু’। সেই সময় সেটা ছিল দুনিয়া-কাঁপানো একটা খবর। আর এখন ‘ডিপমাইন্ড’-এর তৈরি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ‘আলফাজিরো’ তুড়ি মেরে হারাবে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ‘দাবা’ খেলোয়াড়কে, দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ ‘শোগো’ খেলোয়াড়কে, শ্রেষ্ঠ ‘গো’ খেলোয়াড়কে। তাই, আমরা ভাবতে বাধ্য হই, কোথায় এর ভবিষ্যৎ? আগামী দিনে কতভাবে নিজেকে আরও কতটা সমৃদ্ধ করতে পারবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা? সেই ভবিষ্যৎ তো একেবারেই অজানা। এমনকী, তাকে কল্পনা করাও কি খুব সহজ? এই ক্রমবিবর্তনের পথ বেয়ে ২০৩০ বা ২০৫০ কিংবা ২১০০ নাগাদ কোথায় যেতে পারে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, তা কতটা দখল নিতে পারে মানুষের জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রে- সে নিয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে মানুষের একটা জমাটি বিতর্কের আয়োজন করতেই পারে অক্সফোর্ড ইউনিয়ন বা অন্য কোনও প্রতিষ্ঠান। সে অবশ্যই হবে এক কল্পবিজ্ঞানের প্রতিযোগিতা। তাতে অন্তত দেখা যাবে কল্পবিজ্ঞানের গল্প কে ভাল ফাঁদতে পারে- মানুষ না কি মানুষের তৈরি যন্ত্র?
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.