সম্প্রতি শীর্ষ আদালত কেন্দ্রীয় সরকারকে হিংসাত্মক বচন, যাকে বলা হয় ‘হেট স্পিচ’, তার জন্য মৃদু ভর্ৎসনা করেছে। প্রধান বিচারপতি এন. ভি. রামানা বলেছেন, টেলিভিশন চ্যানেলে বিষোদ্গার নিয়ন্ত্রণে সরকার কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে না কেন? ‘বাক স্বাধীনতা’ ও ‘হেট স্পিচ’-এর সূক্ষ্ম আলপথটি চিহ্নিত করবে কে? কলমে জয়ন্ত ঘোষাল
আপনি ঘৃণা কিনতে চান? না, ভালবাসা? বাজারে ঘৃণার বিক্রি বেশি। ভালবাসার খদ্দের কম। টেলিভিশনের পর্দায়, ইউটিউবে, ডিজিটাল বা সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘৃণার বাজার দেখা যাচ্ছে অনেক বেশি। অর্থনীতির মৌল নীতি- চাহিদা ও জোগান। অতএব, ঘৃণাভরা বাকচাতুর্যের প্রতিযোগিতামূলক বাজার-অর্থনীতি।
অধুনা মহামান্য শীর্ষ আদালত কেন্দ্রীয় সরকারকে হিংসাত্মক বচন, যাকে বলা হয় ‘হেট স্পিচ’, তার জন্য মৃদু ভর্ৎসনা করেছে। প্রধান বিচারপতি এন. ভি. রামানা বলেছেন, টেলিভিশন চ্যানেলে হিংসাত্মক কথা চালাচালির নিয়ন্ত্রণে সরকার কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে না কেন? কেন চ্যানেলের অ্যাঙ্করদের এ ব্যাপারে কোনও আচরণবিধি থাকবে না? কেন তাঁরা অনেকেই হিংসা ও ঘৃণার উন্নতিকল্পে কায়মনোবাক্যে পেশাদারি শ্রম দান করবেন?
২০২২ সালের ২১ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্ট এই নির্দেশ জারি করে। এ ব্যাপারে অতীতেও নানা দলের নানা মামলা হয়েছে। কিন্তু বাজারে ‘ঘৃণা-ব্যবসায়ী’দের দমন করা যাচ্ছে না। ২১ সেপ্টেম্বরের মামলার আইনজীবী কপিল সিবাল উত্থাপন করেন একটি সংবেদনশীল ঘটনার। হরিদ্বারে ধর্ম সংসদে হিন্দু যুববাহিনী প্রকাশ্যে ঘোষণা করে- বিশেষ একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বিনাশ চাই। তাদের মেরে ফেলতে পারলে ভারতে ধর্মীয় সংহতি সম্ভব হবে। এই ঘৃণাভরা হত্যার প্রকাশ্য হুমকি ভারতীয় চ্যানেলগুলিতে মহাসমারোহে প্রচার করাও হয়েছে। কপিল সিবাল বললেন, যাঁরা এই ধরনের বক্তৃতা দিয়েছেন তাঁদের কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। উলটে উত্তরপ্রদেশের বর্ষীয়ান কিছু বিজেপি নেতা এই বক্তব্যের সমর্থনে এগিয়ে এসেছেন! প্রধান বিচারপতি এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক, দিল্লি ও উত্তরাখণ্ডের পুলিশ প্রধানকে নোটিস পাঠিয়েছেন। সুপ্রিম কোর্ট বলছে, অ্যাঙ্কররা যেভাবে বিদ্বেষ-বক্তব্যকে প্রাধান্য দিচ্ছেন, তাতে সরকার কেন নিয়ন্ত্রণ আনছে না? অতএব, বিষয়টির দু’টি দিক উন্মোচিত।
প্রথমত, রাজনৈতিক দল ও নেতারা এমন সব কথা বলছেন, তা হিংসা ছড়ায়। ঘৃণাকে সজীব করে তোলে সমাজ-মানসে। অন্যদিকটি হল, এই হেট স্পিচ ঘিরে চ্যানেলে-চ্যানেলে বিতর্ক। দীর্ঘ সময়ের আলোচনা। এর ফলে এটি আরও ‘টক অফ দ্য টাউন’ হয়ে ওঠে। লক্ষণীয় বিষয়, বহু ক্ষেত্রেই অ্যাঙ্কররা এ ধরনের হেট স্পিচের তীব্র নিন্দা করছেন। বারবার বলছেন- আপনারা এ ধরনের মন্তব্য করবেন না। আমরা আলোচনাকে সিরিয়াস স্তরে রাখতে চাই। তাঁরা বলেছেন, আমাদের সম্পাদকীয় নীতি এই হেট স্পিচের বিরুদ্ধে।
এ-কথা বললেও তর্ক চলতেই থাকে। দুই যুযুধান রাজনৈতিক নেতা ভয়াবহ ভাষায় চিৎকার করে কথা বলে যাচ্ছেন। ঘৃণার মিসাইল ছুড়ে দিচ্ছেন একজন আর-একজনের দিকে। আর, অ্যাঙ্কর- তা সে পুরুষই হোন বা নারী, গালে হাত দিয়ে সেই তরজা শুনছেন। ফুটেজ চলতেই থাকে। তা সেন্সর হয় না। মাঝে মাঝে দুই মল্লযোদ্ধার মাঝখানে একটা ‘বনাম’ বা ‘ভার্সাস’ এই চিহ্ন দেখানো হয় পুরো পর্দাজুড়ে। বেশ কিছুক্ষণ পর অ্যাঙ্কর ঝগড়ায় অংশ নেন এবং আরও চিৎকার করে, আারও শিরা ফুলিয়ে বলেন- এ ধরনের বিতর্ক পারস্পরিক ঘৃণা ও বিদ্বেষ বাড়াচ্ছে। এটা কাম্য নয়। ততক্ষণে ওই ঝগড়ার ‘টিআরপি’ বা দর্শকসংখ্যা কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছে। খবরের কাগজে বলা হত, ‘সার্কুলেশন’ বা গ্রাহক সংখ্যা, টিভিতে বলা হয় ‘টিআরপি’, ডিজিটালে বলা হয় ‘হিট’- ভাল ট্রাকশন, ইউটিউবে ‘ভিউয়ারশিপ’।
রাজনৈতিক দল ও সংবাদমাধ্যমের মধ্যে এই চাহিদা ও জোগানের এক অলিখিত বোঝাপড়া থাকতে পারে। হরিদ্বারের পর এবার ধর্মসংসদ হবে কুরুক্ষেত্র, উন্নাও, দসনা। তারপর আলিগড় ভোট যতই এগিয়ে আসবে, ততই এই হেট স্পিচ বাড়বে। সংবাদমাধ্যম বলবে- এ ধরনের মন্তব্য গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দল বা নেতা করলে আমরাও তা দেখাতে বাধ্য।
এর আগে ভোটের মুখে ‘মব লিঞ্চিং’-এর বহু ঘটনা হিন্দি বলয়ে আমরা দেখেছি। এখন ভোট যত এগিয়ে আসছে, তত নানা স্থান চিহ্নিত করে হেট স্পিচও বাড়ছে। মব লিঞ্চিং-ও প্রচার পেত, হেট স্পিচও পায়। যত প্রচার ততই রাজনৈতিক ও ধর্মীয় মেরুকরণ বাড়ে। সুপ্রিম কোর্ট বলছে, সংবাদমাধ্যমকেও সচেতনভাবে সংযত হতে হবে। তা না হলে ঘৃণার বক্তৃতার একটা বাস্তুতন্ত্র গড়ে উঠছে সমাজজুড়ে। সমস্যা হচ্ছে, বেসরকারি সংবাদমাধ্যমের উপর আনুষ্ঠানিকভাবে কোনও নিয়ন্ত্রণ সরকারের থাকে না। সংবিধানে ১৯ নম্বর অনুচ্ছেদে ব্যক্তি স্বাধীনতার মৌলিক অধিকার তো সাংবাদিক-অ্যাঙ্করদেরও আছে। সরকার যদি সুপ্রিম কোর্টের কথায় অ্যাঙ্করদের আচরণবিধি তৈরি করে, তবে তো এই সমালোচনা হবে যে সরকার সেন্সর করছে। অঘোষিত জরুরি অবস্থা! মৌলিক অধিকারে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ হবে। গুজরাত দাঙ্গায় অভিযুক্তরা জেল থেকে ছাড়া পেলে তাদের বিজেপি-কর্মীরা জেলের সামনে মালা পরিয়ে বীরের সম্মান দেন কেন?
তিস্তা শেতলবাদকে সুপ্রিম কোর্ট জামিন দেওয়ায় তিনি ছাড়া পাওয়ার পর কী প্রতিক্রিয়া দেখেছিলাম আমরা? সোশ্যাল মিডিয়ায় সংগঠিতভাবে তাঁর বিরুদ্ধে হেট স্পিচের বন্যা বইতে শুরু করে। গুজরাত ষড়যন্ত্রে তাঁকে ‘খলনায়িকা’-র ভাবমূর্তি দেওয়াই বিজেপির রাজনৈতিক রণকৌশল। ঘৃণা-ভরা বক্তৃতা বন্ধ করার ব্যাপারে অতীতে আইন কমিশনও একটি রিপোর্ট দেয়। আইন কমিশনের ২৬৭তম রিপোর্টে এই ঘৃণা-ভরা বক্তৃতা দমনে আইন করার কথা বলা হয়।
সংবিধানের ২১তম অনুচ্ছেদে স্বাধীনভাবে বক্তৃতা দেওয়ার কথা বলা হয়। কিন্তু কমিশনের রিপোর্টে বলা হয়, ভারতের মতো এক বিশাল দেশে যেখানে এত ধর্ম, এত জাতপাত, এত পরিচিতি সত্তার সংঘাত, সেখানে বিষোদ্গার দমনে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। রাষ্ট্র সংঘের কৌশল ও কর্মসূচিতেও এই প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, ভারতীয় দণ্ডবিধি অনুসারে হেট স্পিচের মামলা ২০১৪ সালে ছিল ৩২৩। ২০২০-তে তা দাঁড়িয়েছে ১৮০৪। এটা সরকারি তথ্য। আবার এসব ঘটনায় অভিযুক্তদের দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে মাত্র শতকরা ২০ ভাগ ক্ষেত্রে। হেট স্পিচের ক্ষেত্রে কনভিকশন রেট অন্য সব অপরাধের তুলনায় সবচেয়ে কম। তার মানে এই নয় যে, এখন হিংসামূলক বক্তৃতা দমনে কোনও আইন নেই।
১৮৬০ সালের ভারতীয় দণ্ডবিধি থেকে ১৯৫১ সালে জনপ্রতিনিধি আইন, ১৯৫২ সালে সিনেমাটোগ্রাফ আইন, ১৯৫৫-তে নাগরিক অধিকার রক্ষার আইন, ১৯৭৩-এর ‘কোড অফ ক্রিমিনাল প্রসিডিওর’ অাইন, ১৯৮৮ সালে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে অপব্যবহার রোধের আইন, ১৯৯৫ সালে কেবল টিভি নেটওয়ার্ক (নিয়ন্ত্রণ) আইন। বহু আইন।
সমস্যা হচ্ছে বিড়ালের গলায় ঘন্টিটা বাঁধবে কে?
আমি বলছি না বিজেপি দলই একা বিদ্বেষবাণী ছড়াচ্ছে। মোদির বিরুদ্ধে খোদ রাহুল গান্ধী ‘হেট স্পিচ’ দিয়েছেন- এমনও অভিযোগ উঠে এসেছে। কিন্তু ২০২০ সালে অনুরাগ ঠাকুরের বিরুদ্ধে হেট স্পিচের মামলা দিল্লি হাই কোর্ট খারিজ করে দেয়। যোগী আদিত্যনাথের বিরুদ্ধেও হেট স্পিচের মামলা আদালত খারিজ করে দিয়েছে। উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ উঠেছে।
আইনের অভাব নেই, কিন্তু কোনটি হেট স্পিচ আর কোনটি নয়- বিচার করবে কে? আদালতের নির্দেশে এখন যদি সংবাদমাধ্যমের ও অ্যাঙ্করদের জন্য আচরণবিধি তৈরি করা হয়, তবে কেন্দ্র তো আরও শক্তিশালী হবে। কোনটি হেট স্পিচ আর কোনটি হেট স্পিচ নয়, তা-ও ঠিক করবে কেন্দ্র।
বিরোধী দলগুলি একত্র হয়ে হেট স্পিচের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানায়। এ ব্যাপারে নরেন্দ্র মোদি কোনও সর্বদলীয় বৈঠক ডেকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করবেন এমনও তো শুনিনি। উলটে তথ্য ও প্রচারমন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর বলেছেন, হেট স্পিচের অভিযোগের ভিত্তিতে শাস্তি দেওয়ার কোনও সাংবিধানিক ক্ষমতা কেন্দ্রীয় সরকারের নেই।
তবে তো কোনও সমাধানই নেই। সংবাদমাধ্যমের তরফে যদি আত্মনিয়ন্ত্রণের চেষ্টা শুরু হয়, সেটাই বোধহয় একমাত্র কাঙ্ক্ষিত রাস্তা হতে পারে। প্রয়াত স্পিকার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় একবার বলেছিলেন- লোকসভা অধিবেশনের সময় সকালে আপনারা থাকেন। তখন আলোচনা নয়, সাংসদেরা সবচেয়ে বেশি মারামারি করেন। কারণ তা সংবাদমাধ্যমে প্রচার পায়। সংসদের সেকেন্ড হাফে মধ্যাহ্নভোজনের পর প্রেস গ্যালারি ফাঁকা হয়ে যায় তখন সাংসদেরা বক্তৃতা দেন, মারামারি করেন না। কারণ তখন আপনারা থাকেন না।
এ প্রশ্নের জবাব সেদিন দিতে পারিনি ওঁকে। সত্যি, জানি না রাজনীতিকরা এমন করেন, তাই আমরা তা দেখাই? না কি আমরা চাই ওই প্রচার, তাই প্রচারের জন্য রাজনেতারা এটা করেন? মুরগি আগে? না, ডিম?
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.