১৮ থেকে ২২ সেপ্টেম্বর লোকসভার বিশেষ অভিবেশন। কী-কী বিষয় আলোচিত হবে, স্পষ্ট নয়। জল্পনা চলছে- এই বিশেষ অধিবেশনে কি ভবিষ্যৎ ভারতের গণতন্ত্রর নতুন ছবি ক্যানভাসে আঁকা হতে চলেছে? কলমে সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়
এমন চনমনে সেপ্টেম্বর শেষ কবে এসেছে ভাবছি। শেষ কবে একটা মাস এমন ঘটনাবহুল এবং সেই সঙ্গে নানাবিধ রাজনৈতিক জল্পনা, উত্তেজনা ও উৎকণ্ঠা সৃষ্টি করেছে জানা নেই। এই সাসপেন্সের কৃতিত্ব দিতে হলে অবশ্যই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মুখটা ভেসে উঠবে। চমক সৃষ্টিতে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। আস্তিনে লুকনো তুরুপের তাস যে তিনি কখন ফেলেন, সেই আন্দাজ কেউ করতে পারে না। যেমন এখন কেউ বুঝতে পারছে না মাসের মাঝামাঝি ঠিক কোন চমক অপেক্ষায় রয়েছে।
সেপ্টেম্বরের শুরুটা অবশ্যই ‘ইন্ডিয়া’ জোটের। বিজেপি-বিরোধী জোটের পালে যে হাওয়ার টান লেগেছে, কষ্ট করে নৌকোর দাঁড় আর বাইতে হচ্ছে না, ‘ইন্ডিয়া’-র কুশীলবরা সেটা মুম্বইয়ে দেখিয়ে দিলেন। ভোটের এত আগে এমন কোমর কষে বিরোধীরা কখনও নামেওনি।
পাটনা ও বেঙ্গালুরুর পর মুম্বইয়ের অগ্রগতি বুঝিয়ে দিল ‘ইন্ডিয়া’-র জন্ম, এবার অন্তত, অকালে খসে পড়ার জন্য হয়নি। জোটবদ্ধ না হলে সবাই যে ভেসে যাবে সেই বোধটুকু অন্তত বিরোধীদের মধ্যে এসেছে। এটা যতটা ‘ইন্ডিয়া’-র ক্ষেত্রে উৎসাহজনক, ততটাই চিন্তাজনক বিজেপির কাছেও।
শুধু চিন্তা-ই নয়, কোনও কোনও ক্ষেত্রে এই জোটবদ্ধতা বিজেপির কাছে দুশ্চিন্তাজনকও। তার সর্বশেষ প্রমাণ: জি২০ নেতাদের কাছে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর আমন্ত্রণপত্র। তিনি যে ‘ভারত’-এর রাষ্ট্রপতি, ‘ইন্ডিয়া’ (I.N.D.I.A)-র নন, সেই জাহির কৌতূহল সৃষ্টি করেছে। তবে কি ‘ইন্ডিয়া’ মুছে ‘ভারত’-ই হতে চলেছে দেশের একমাত্র পরিচয়? উত্তর যাই হোক, মোদির গা ঝাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা সেপ্টেম্বরকে চনমনে করে তুলেছে।
তা কী কী করলেন তিনি?
প্রথমে ঘোষণা করলেন পার্লামেন্টের পাঁচদিনের বিশেষ অধিবেশনের কথা। কিন্তু ১৮ থেকে ২২ সেপ্টেম্বর কী-কী বিষয় আলোচিত হবে, তা বললেন না। ফলে একটা সাসপেন্স তৈরি হল। এই ঘোষণা ও সাসপেন্স ঝুপ করে অনেকটাই কেড়ে নিল ‘ইন্ডিয়া’-র আলো। বিরোধীরা কতটা সফল ‘চ্যালেঞ্জার’ হতে চলেছে, তা থেকে নজর ঘুরে গেল সংসদীয় জল্পনায়। শুধু তাই নয়, ব্রিটেনের ‘দ্য গার্ডিয়ান’ ও ‘দ্য ফিনানশিয়াল টাইম্স’ আদানি গোষ্ঠীর দুর্নীতির নতুন ফিরিস্তি পেশ করে প্রধানমন্ত্রী মোদিকে সরাসরি কাঠগড়ায় তুললেও রাজনীতিতে তা সেভাবে ঢেউ তুলতে পারল না।
লোহা গরম থাকতে থাকতেই ঘা মারতে হয়। মোদি তা জানেন। সংসদের বিশেষ অধিবেশনের সঙ্গে তাই তিনি ভাসিয়ে দিলেন ‘এক দেশ এক ভোট’-এর ফানুস। আপাতত কেল্লা ফতে। দেশজুড়ে জল্পনা, তা হলে কি ১৮ থেকে ২২ তারিখের মধ্যে ভবিষ্যৎ ভারতের গণতন্ত্রর নতুন ছবি ক্যানভাসে আঁকা হতে চলেছে? জল্পনার তালিকার শেষ চমক রাষ্ট্রপতির আমন্ত্রণপত্র!
চায়ের কাপে নবতম তুফান!
জল্পনা, আলোচনা ও চমক অবশ্য অন্তহীন। ভারতের কোনও প্রাক্তন রাষ্ট্রপতিকে কোনও প্রধানমন্ত্রী সরকারি নীতি রূপায়ণের ক্ষেত্রে এভাবে সরাসরি নিযুক্ত করেননি। কোনও প্রাক্তন রাষ্ট্রপতিও রাজনীতির হাঁড়িকাঠে এভাবে মাথা দেননি। অবসরের পর রাষ্ট্রপতিরা মার্গদর্শকের ভূমিকা গ্রহণ করেন। বই লেখেন। সুধী সমাবেশে ভাষণ দেন। সমাজসেবীদের উৎসাহিত করেন। দেশ গড়ার কাজে ব্রতী হন। ঠিক-ভুলের পার্থক্য বোঝান। পছন্দমতো গঠনমূলক কাজে যুক্ত হন। কখনও দলীয় বা সরকারি কাজের অঙ্গ হন না।
অথচ দেশহিতৈষীর চাদর মুড়িয়ে রামনাথ কোবিন্দকে অবিমিশ্র দলীয় রাজনীতিতে নামিয়ে আনলেন নরেন্দ্র মোদি। ‘এক দেশ এক ভোট’ রূপায়ণ কমিটির চেয়ারম্যান করে কোবিন্দকে তিনি শুধু ‘খেলো’-ই করলেন না, এটাও বুঝিয়ে দিলেন, তাঁর জমানায় প্রাক্তন রাষ্ট্রপতিও স্রেফ দলের বোড়ে। দলের প্রতি আনুগত্য প্রথম ও শেষকথা।
অবশ্য, এর চেয়েও বেশি অসম্মান তিনি রাষ্ট্রপতি কোবিন্দকে করেছিলেন আড়াই বছর আগে। যেমন এ বছর দ্রৌপদী মুর্মুকেও করলেন। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাষ্ট্রপতি কোবিন্দকে দিয়ে তিনি গুজরাতের আহমেদাবাদে সর্দার প্যাটেল স্টেডিয়ামের নামকরণ করিয়েছিলেন নিজের নামে। এই বছর দ্রৌপদী মুর্মুকে উপেক্ষা করে নতুন সংসদ ভবনের উদ্বোধনও তিনি-ই করলেন। অথচ কে না জানে, রাষ্ট্রপতির নামেই সংসদের অধিবেশন ডাকা হয়। তাঁর ভাষণ দিয়েই প্রতি বছর শুরু হয় সংসদের উভয় কক্ষের যৌথ অধিবেশন।
এটা ঠিক, রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন রামনাথ কোবিন্দ ‘এক দেশ এক ভোট’ নীতির পক্ষে ভাষণ দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই ভাষণের রচয়িতা ছিল সরকার। ওই কথা উপ-প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন লালকৃষ্ণ আদবানিও বলেছেন। বিজেপির নির্বাচনী ইস্তাহারেও রয়েছে। ইদানীং এটা একান্তভাবেই বিজেপির নিজস্ব দাবি বা চাহিদা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবসর গ্রহণের পর ওই কমিটির প্রস্তাব আসা মাত্র কোবিন্দের উচিত ছিল সবিনয়ে তা প্রত্যাখ্যান করা। কারণ, বিজেপি ছাড়া আর কোনও দলই দৃঢ়ভাবে ওই নীতির পক্ষে নয়। অন্যদের কাছে বিষয়টি প্রাসঙ্গিকও নয়। কংগ্রেস তো এই উদ্যোগকে ‘যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর প্রতি আঘাত’ বলেছে। কমিটির সদস্য তালিকাতেও কোবিন্দ নিশ্চয়ই চোখ বুলিয়ে বুঝেছিলেন তা সর্বদলীয় নয়। অধীর চৌধুরী সরে দাঁড়ানোয় ওই উদ্যোগ একান্তভাবেই বিজেপির নিজস্ব মতবাদের আখড়া হয়ে দঁাড়িয়েছে। কোবিন্দ তবু কী করে তা মেনে নিলেন সেই বিস্ময়ের ঘোর কাটছে না।
মোদি যতটা প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির মর্যাদাহানির দায়ে অপরাধী, কোবিন্দ নিজেও ততটাই। কমিটির নিয়োগকর্তা কেন্দ্রীয় আইন মন্ত্রক। চেয়ারম্যান হিসাবে কমিটির সুপারিশ কোবিন্দ আইন মন্ত্রকের কাছে পেশ করবেন। একবার ভেবে দেখুন অবস্থাটা। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি সরকারের তৈরি কমিটির চেয়ারম্যান হিসাবে সুপারিশপত্র পেশ করছেন দেশের আইনমন্ত্রীকে, এক সময় যাঁর নিয়োগকর্তা ছিলেন তিনিই!
সমকালীন রাজনীতিতে ‘এক দেশ এক ভোট’ নীতির ভাল-মন্দ, সুবিধে-অসুবিধে দুটোই রয়েছে। পক্ষে-বিপক্ষের পাল্লা সমান। ভারতের মতো দেশে এই বিষয়ে স্থির সিদ্ধান্তে আসতে গেলে সবার আগে প্রয়োজন ঐকমত্যে। সেজন্য দরকার গ্রহণযোগ্য কমিটি গঠন। অথচ কারও সঙ্গে কথা না বলে খেয়াল খুশিমতো তৈরি এই কমিটি সরকারের অভিসন্ধি স্পষ্ট করে দিচ্ছে। বুলডোজার নীতি কিন্তু সর্বনেশে।
কোবিন্দ কমিটি এই ক’দিনের মধ্যে ঐকমত্যের ভিত্তিতে চূড়ান্ত রিপোর্ট পেশ করবে এবং
১৮ থেকে ২২ সেপ্টেম্বর পার্লামেন্ট তা আলোচনা করবে, এটা আমি বিশ্বাস করি না। বিশেষ অধিবেশনের উদ্দেশ্য অবশ্যই অন্য কিছু যা মোদি এখনও টের পেতে দিচ্ছেন না।
‘ইন্ডিয়া’ পরিহার করে ‘ভারত’-এর আবাহন কি সেই চমক?
চমকের অবসান ‘জি২০’ শীর্ষ সম্মেলন শেষ হওয়ার আগে নিশ্চিতই ঘটবে না। মোদির ধ্যানজ্ঞান এখন জি২০। ব্যাপারটা যদিও শ্বেতহস্তী পোষার মতো। শুধু বাজেট বরাদ্দই ৯৯০ কোটি টাকা! ২৮টি রাজ্য ও ৮টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের বাড়তি খরচ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে জানা নেই। ২৪ বছরে এই গোষ্ঠীভুক্ত কোনও দেশ খরচের এই বিলাসিতা দেখায়নি। প্রয়োজন থাকুক না থাকুক, লাভ হোক না হোক, প্রচারের ঢাক পেটানোর বিরাম নেই। বোঝানো হচ্ছে, মোদিই পৃথিবীর আলোকবর্তিকা। তিনি ‘বিশ্বগুরু’। তিনিই ত্রাতা।
নিট রেজাল্ট?
শি জিনপিং এবং ভ্লাদিমির পুতিনের অনুপস্থিতি। ইউক্রেন-রাশিয়া সংকট অপরিবর্তিত। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অভ্যন্তরীণ বিভাজন, যথা পূর্বং তথা পরং। অথচ প্রচারে ভারতের ভাবমূর্তি এভারেস্ট ছুঁয়েছে। সত্য-মিথ্যার বিতর্ক পাশে ঠেলে যুক্তরাষ্ট্রের ‘পিউ রিসার্চ সেন্টার’-এর সর্বশেষ সমীক্ষা তুলে দিই। তারা দেখাচ্ছে- বিদেশে, বিশেষ করে ইউরোপে, ভারত সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা দ্রুত কমছে। গত ১৫ বছরে ভারত সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা কমেছে ৩১ শতাংশ!
সাত মন তেল পুড়িয়েও রাধা না-নাচলে ‘বিশ্বগুরু’ কাকে দোষ দেবেন? কিংবা কোবিন্দ কমিটি মূষিকপ্রসব করলে? ঘটনাবহুল সেপ্টেম্বরের সেরা চমক কি তবে ‘ইন্ডিয়া’ ছেঁটে ‘ভারত’?
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.