পশ্চিমবঙ্গের ভোট নির্ঘণ্ট করার সময় কি কমিশন কর্তারা আবহাওয়া খোঁজ রাখেন না? এই রাজ্যে উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গে গরম অথবা শীত দুয়ের চরিত্র আলাদা। উত্তরবঙ্গে যে সময় ভোট হল সেই সময় সেখানে মনোরম পরিবেশ। দক্ষিণবঙ্গেও দহনজ্বালা ছিল না। স্বাভাবিকভাবে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্বে দক্ষিণবঙ্গে ভোট হলে মানুষের এই দুর্দশা হত না। আবার এখন যখন দক্ষিণবঙ্গ পুড়ছে তখন তুলনায় অনেক ভালো আবহাওয়া উত্তরে। এই সময় উত্তরবঙ্গে ভোট হতে পারত। কলমে কিংশুক প্রামাণিক
মুর্শিদাবাদ জেলার খড়গ্রামে কৃষক বাজারের মাঠে দাঁড়িয়ে আছি। কিছুক্ষণ পর মুখ্যমন্ত্রী আসবেন। তৃষ্ণা মেটাতে রোদের মধ্যে জল খেলেও বিপদ। ওআরএস গুলে নিয়েছি সঙ্গে। এত গরম সত্ত্বেও পিলপিল করে লোক আসছে। তীব্র দাবদাহে কলকাতার মানুষ যখন একটু ঠান্ডা পেতে এসি ঘরে বন্দি, তখন গ্রামের মানুষের ভ্রুক্ষেপ নেই। লু বইলেও তাদের কিছু যায়-আসে না। মাথার উপর আগুনের গোলা মনে হচ্ছে সূর্যকে। যেন পুড়িয়ে মেরে দেবে! সবাই আশ্রয় নিচ্ছে অস্থায়ী ছাউনির নিচে। কখন দিন গড়িয়ে বিকেল হবে; একটু শান্তি মিলবে। বৃষ্টির আশা নেই।
আগে গ্রামবাংলায় বেশি গরম পড়লেই দিনের শেষে কালবৈশাখী হত। সহসা পশ্চিম আকাশ থেকে ছুটে আসত নিকষ কালো মেঘ। বিদ্যুৎ, বাজ, সঙ্গে এলোপাথাড়ি ঝড়, সবশেষে অঝোর বৃষ্টি। তার মধ্যে গ্রামের ছেলেরা আম কুড়তে দৌড়ত বাগানে। ভয় নেই, ডর নেই। সেই স্বস্তির ধারাপাতে মুছে যেত দহনজ্বালা। তপ্ত মাটি শান্ত হত। জীবনের তৃষ্ণা মিটত। ধানের শীষ দুলে উঠত। গাছের পাতায় জমা ধুলো বৃষ্টিধারায় ধুয়ে যেত। শুষ্কতা মুছে পুকুরে টলটল করত জল। ডানা ঝাঁপটে বৃষ্টি মাখত বিহঙ্গকুল। পৃথিবী আবার শান্ত হত।
দিন বদলেছে। সব আর আগের মতো নেই। বিশ্বজুড়ে উষ্ণায়নে প্রকৃতি ভারসাম্য হারিয়েছে। বেশি গরম পড়লে আর বৃষ্টি হয় না। কালবৈশাখী এবার হল কই? বর্ষা এবং শীতের আসার সময় বদলেছে। বৃষ্টি কমে গিয়েছে। হিমালয়ে বরফ কম পড়ছে। হিমবাহ গলে যাচ্ছে। বাংলার গ্রাম থেকে হারিয়ে যাচ্ছে বৈশাখের ঝড়-বৃষ্টি। খড়গ্রাম পুড়ে যায়, পুড়ে খাক হয়।
এখন তাপমাত্রা কত হবে? ৪৪ না ৪৫!
মনে হয়, আরও বেশি। ভোটের খবর নিতে একমাস বাংলার পথে-পথে ঘুরছি। রোজই ভরদুপুরে মুখ্যমন্ত্রীর মিটিং। সূর্যকে এমন অসহনীয় কখনও মনে হয়নি। সত্যি আজ কষ্ট হচ্ছে। মনে হচ্ছে মরুভূমিতে রয়েছি। গরম তো এ-বছর প্রথম পড়ল না। কিন্তু এমন অবস্থা আগে অনুভব করিনি। গরমে ভোট ‘কভার’ করছি প্রায় তিন দশক। রাজ্যের বাইরে গিয়েছি কতবার! এখন রোজ রোজ যেন অস্বস্তি বাড়ছে। রোদ থেকে বাঁচতে গাছ অথবা ছাউনির নিচে আশ্রয় নিয়ে লাভ হচ্ছে না। গরম হওয়া পুড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে।
এখানে আকাশটা বিশাল। বহু দূর চোখ চলে যায়। দূরে-দূরে গ্রাম। আজকাল বাংলার গ্রামকে চেনা যায় না। সবই পাকা, কাঁচা বলে কিছু নেই। আধুনিকতার সব আয়োজন সেখানে মজুত। নামেই ‘গ্রাম’। তবে এখনও এদিকে অনেক মাটির বাড়ি। একতলা, দোতলা। পরিপাটি করে গড়া। এ-ই বাড়িই হল প্রাচীন কালের প্রথম এয়ার কন্ডিশন্ড রুম। গরমে ভিতরে ঠান্ডা, শীতকালে মনোরম।
গ্রামগুলোর পুকুরপাড়ে ইতিউতি ছড়িয়ে তালগাছ। পুকুর শুকিয়ে কাঠ। পানীয় জলের সমস্যা খুবই। এখান থেকে কর্ণসুবর্ণ খুব বেশি দূর নয়। রাজা শশাঙ্কর রাজধানী। এখনও তার ভগ্নস্তূপ রয়েছে। সেই আমলে রাজামশাই এখানে কেন রাজধানী স্থাপন করলেন? কীভাবে বসবাস করতেন? তখন কি আকাশ বাতাসের এত উত্তাপ ছিল না? লক্ষ করছি, গ্রামের মানুষ প্রখর রোদ তাপ উপেক্ষা করে মিছিলে হাঁটছে। স্লোগান দিতে-দিতে আসছে। বাচ্চা কোলে নিয়ে আসছে। এইভাবেই তারা মাঠে ধান কাটে। এই অভ্যাস গ্রাম-শহরকে আলাদা করেছে।
আরও এক মাস ভোট চলবে। ইতিমধ্যে ‘রেড অ্যালার্ট’ জারি হয়েছে। আবহাওয়া দপ্তর জানিয়েছে, জুনের মাঝামাঝি বর্ষা আসার আগে গরম আরও বাড়বে। এই সময় পথে নামা বারণ। স্কুলে গরমের ছুটি পড়ে গিয়েছে। ভোটপ্রার্থীদের নাজেহাল অবস্থা। কর্মীরা গলদঘর্ম। তবে এবার ভোটের উত্তাপ কম। গ্রামে-গ্রামে পাড়ায় পাড়ায় উৎসবের পরিবেশ অনুপস্থিত। দেওয়াল লেখার চল কমছে। তীব্র গরম ভোটের উত্তাপ কমিয়েছে। তেমন উত্তেজনা এবং অপ্রীতিকর ঘটনা এবার এখনও পর্যন্ত নেই বললেই চলে।
আমাদের দেশে ফি-বছর এই সময় ভোট হয়। এবার আড়াই মাস ধরে নির্ঘণ্ট। সাত দফা। প্রতি দফায় বাংলায় ভোট। এই নিয়ে প্রতিদিনই নির্বাচনী সভায় সরব হতে দেখা যাচ্ছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। তিনি বলেছেন, ‘নির্বাচন কমিশনের কর্তাদের অনুরোধ করছি পারলে একবার দুপুরবেলা বাঁকুড়া, পুরুলিয়া বীরভূম, মুর্শিদাবাদের মাটিতে এসে দাঁড়ান। একবার অনুভব করুন প্রখর গ্রীষ্ম কাকে বলে। তিন মাস ধরে ভোট করার খুব কি প্রয়োজন ছিল? মানুষ এই রোদে লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দেবে কী করে?’
খুব ভুল বলেননি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। গরমের মধ্যে ভোট হয় কেন? বর্ষাকে এড়ানো হয়। গ্রীষ্মকেও এড়ানো দরকার। গোটা দেশে এবার ভোট কম পড়ছে। কোনও কোনও রাজ্যে গত বারের চেয়ে দশ শতাংশ কম। শেষ দু’-দফায় বিহার, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশে ভোটকেন্দ্রের করুণ ছবি।
পশ্চিমবঙ্গের ভোট নির্ঘণ্ট করার সময় কি কমিশন কর্তারা আবহাওয়া খোঁজ রাখেন না? এই রাজ্যে উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গে গরম অথবা শীত দুয়েরই রকমসকম আলাদা। উত্তরবঙ্গে যে-সময় ভোট হল সেই সময় সেখানে মনোরম পরিবেশ। দক্ষিণবঙ্গেও দহনজ্বালা ছিল না। স্বাভাবিকভাবে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্বে দক্ষিণবঙ্গে ভোট হলে মানুষের এই দুর্দশা হত না। আবার এখন যখন দক্ষিণবঙ্গ পুড়ছে তখন তুলনায় অনেক ভালো আবহাওয়া উত্তরে। এই সময় উত্তরবঙ্গে ভোট হতে পারত। কিন্তু তা হয়নি। যারা ভোটের দিন ঠিক করে, তারা পরীক্ষা
উৎসব পরব দেখে নেয়। আবহাওয়াটা দেখে নেয় না কেন?
ভারত বিচিত্র দেশ! এখানে যখন গরম, তখন হিমালয়ে বরফ। মালভূমিতে সন্ধ্যার পর
ঠান্ডা। সেই বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য স্থাপন করেই নির্ঘণ্ট করা যেতে পারত। বাংলায় ৪২টি
আসন। প্রথম তিন দফায় ১০ আসনে ভোট হল। ৩, ৩, ৪ তিন পর্বে ১০ আসনে ভোট করতে এক মাস চলে গেল। বাকি এক মাসে ৩২ আসন। অদ্ভুত ব্যবস্থাপনা!
এ-কথা সত্যি যে, নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ স্বাধীন সংস্থা হলেও তাকে কেন্দ্রীয় সরকারের উপর নির্ভর করে চলতে হয়। কেন্দ্র যখন চাইবে তখন ভোট হবে। যেভাবে চাইবে সেভাবে হবে। যত দফা চাইবে তত দফা হবে। তাই তৃণমূল নেত্রী যখন অভিযোগ করেন– নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহদের প্রচারের ‘সময়’ করে দিতেই বাংলায় ভোট নির্ঘণ্ট নির্দিষ্ট হয়, তখন তা মান্যতা পেয়ে যায়।
গুজরাট, তামিলনাড়ুর অনেক রাজ্যে একদিনে ভোট। পশ্চিমবঙ্গে সাত-আট দফা যেন নিয়ম হয়ে গিয়েছে। কমিশন মনে করে– পশ্চিমবঙ্গে যেহেতু ভোট নিয়ে আগ্রহ, উত্তেজনা ও রাজনৈতিক হিংসা বেশি, সেইজন্য দফায় দফায় ভোট দরকার। এই যুক্তির বিরুদ্ধ মত হল, যদি সেটাই ইস্যু হয় তাহলে যথেষ্ট সংখ্যক বাহিনী দিয়ে একদিনে ভোট করে নেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ। তাহলে আড়াই মাস ধরে দহনজ্বালা মানুষকে সহ্য করতে হত না। বাস্তবে কিন্তু এটাই ঠিক! যত ভোট দফাওয়াড়ি হয়, তত পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। রাজনৈতিক আকচাআকচি বাড়তে থাকে। রাজনৈতিক দলগুলো এক জায়গার লোক অন্য দিকে জড়ো করে। একদিনে অথবা দুই দিনে ভোট হলে এই অবস্থা এড়ানো সম্ভব। কিন্তু কে শুনবে! কমিশনকে দিল্লির শাসক দলের সিদ্ধান্ত মানতে হয়।
গরমের জেরে সব রাজ্যে ভোটদানের হার কম। ভোট কম পড়লে শাসকের লাভ, না, ক্ষতি? না কি একটা প্রবাহ ভাঙার পরিবেশ, রাজনৈতিক কালবৈশাখীর ইঙ্গিত! সময় উত্তর দেবে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.