১০ হাজার বছরের আগু-পিছু কোনও সময়ে মানুষ চাষ-আবাদের প্রয়োজনে দলবদ্ধ হয়ে থাকা শুরু করে। সেই সময় থেকেই মশাদের সেলিব্রেশন শুরু। জনঘনত্ব বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই রেডিমেড ব্লাড ব্যাংক হাজির মশাদের ডানার নাগালে। প্রতি বছর অন্তত ৫ লাখ মানুষ মশার কামড়ে কুপোকাত হয়। উপায় কী? লিখছেন সুমন প্রতিহার
অতিষ্ঠ মানুষের প্রশ্ন করার খেয়াল ছিল না হয়তো, বিজ্ঞানীরা তবুও সে-কাজ ফেলে রাখেননি- পৃথিবীতে কত মশা আছে? মশা-শুমারির শেষে জানা গেল, একের পিঠে ১৪টা শূন্য বসালে সংখ্যাটা যত হয়, তত। ম্যালেরিয়া থেকে জাইকা, ফাইলেরিয়া হোক বা ডেঙ্গি, রোগবণ্টনে পৃথিবীর সর্বোত্তম ব্র্যান্ড মশা। মানব ভবের লীলাসাঙ্গে মশার কামড়ের স্কোর ঐতিহাসিকভাবেই স্থিতিশীল, এখনও প্রতি বছর অন্তত ৫ লাখ মানুষ মশার কামড়ে কুপোকাত। মানুষের দম্ভের গ্রাফের শম্বুকগতি ঘটিয়ে ছেড়েছে মশারা। ইঞ্চিতে অর্ধেক আর দু’মিলিগ্রাম ওজনের মশার সবথেকে পুরনো ফসিল মিলেছিল আলাস্কায়, বয়স ৮ কোটি বছর। তবে বিজ্ঞানীদের ধারণা, অন্তত ২৫ কোটি বছর আগে থেকেই মশাদের মস্তানি চলছে।
জলজ প্রাণীর খাদ্য সংস্থান ও পরাগসংযোগের জন্যই সম্ভবত মশাদের আবির্ভাব, তবে মশারা যে-সমস্ত উদ্ভিদের পরাগসংযোগী হিসাবে বুক ফোলায়, মানুষের লাভের খাতায় তাদের নাম নেই। ‘ন্যাশনাল জিওগ্রাফি’-র সমীক্ষায় জানা যায়, প্রায় ৩৫০০ প্রজাতির মশার কথা। মশাদের এই বাড় ১০ হাজার বছর আগেও ছিল না। ১০ হাজার বছরের আগু-পিছু কোনও সময়ে মানুষ চাষ-আবাদের প্রয়োজনে দলবদ্ধ হয়ে থাকা শুরু করে। সেই সময় থেকেই মশাদের সেলিব্রেশন শুরু। জনঘনত্ব বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই রেডিমেড ব্লাড ব্যাংক হাজির মশাদের ডানার নাগালে। মশা জলে ডিম পাড়ে আর মানুষের জল জমানোর অভ্যাসে মশারা শুধুই মুচকি হেসেছিল। সেই সময় থেকেই অষ্টম প্রহর মশাদের ঝালাপালা গানের রেওয়াজ শুরু। মশকী গান অশ্রুত এমন কান কই?
‘মস্কুইটো’ শব্দটার উৎপত্তি হয় স্প্যানিশ নয়তো পর্তুগিজ, যার অর্থ ‘ছোট ফ্লাই’। তবে, আমেরিকার মূলবাসীরা মশার নাম দিয়েছে ‘জানকুডোস’, স্প্যানিশে যার অর্থ ‘লম্বা পা’। ‘মস্কুইটো’ শব্দটা ছড়িয়েছে উত্তর আমেরিকা থেকে, সময়টা ১৫৮৩। মশারা নাকি কাউকে কাউকে আবার বেশি কামড়ায়! মশারা কি বোঝে রক্তের স্বাদ? উত্তরের আভাস নিয়ে বিজ্ঞানীদের একটা দল বহুমাত্রিক আলোচনায় চমকে দিলেন। গবেষণা প্রকাশ হল ২০২০ অক্টোবরে, জার্নাল ‘নিউরন’-এ।
মশাদের জীবনের কিস্সায় পুরুষ-মশারা নিতান্ত নিরীহ, ডালপালা আঁকড়ে অনায়াসে বেঁচেবর্তে থাকে। এমনিতে মধু খেয়ে বেড়ে ওঠা স্ত্রী-মশারা স্বাদ বদলে রক্তের খোঁজে উড়ান নেয়, ডিম পাড়ার তাগিদে। স্তন্যপায়ী প্রাণীদের রক্তের প্রোটিন প্রয়োজন তাদের ডিম তৈরিতে। বিজ্ঞান চোখ মেলে দেখিয়ে দিল, মশারাও বুঝতে পারে, রক্ত আর মধুর স্বাদ। শুধু তা-ই নয়, করতে পারে পার্থক্যও। মানব-রক্ত চুষে নেওয়ার জন্য মশকীদের অনেক বেশি পরিশ্রান্ত হতে হয়, মধু টানতে ততটা নয়। ডেঙ্গির ডিস্ট্রিবিউটর এডিসের চোষক নলে রয়েছে বিশেষ স্নায়ু, যা তাদের মধু আর রক্তের ভেদটা বুঝিয়ে দেয়। দ্বিধা নিরসনে বিজ্ঞানের মোক্ষম হাতিয়ার পরীক্ষাগার।
মশার মস্তিষ্কে মেরেকেটে দু’লক্ষ কুড়ি হাজার স্নায়ু! তার অর্ধেকের বেশি দেখার কাজে ব্যবহৃত হয়। মতলবি বিজ্ঞানীরা বেশ পরিকল্পনা করেই মশার স্বাদ স্নায়ুতে লাগিয়ে দিলেন বিভিন্ন ধরনের আলো। প্ল্যানটা এরকম- মশারা কিছু খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুললেই জ্বলে উঠবে আলো, দেখবে বিজ্ঞান। নুন-জল খাওয়ানো হল, এমনকী চিনি-জলেও হল না। নুন ও চিনি মিশিয়ে- না, তাতেও জলল না আলো। মেশানো হল কার্বন ডাইঅক্সাইড, উষ্ণতাও যোগ করা হল- আলো জ্বলছে না। শেষমেশ গবেষণা দেখাল- চিনি, সোডিয়াম কার্বনেট, সোডিয়াম ক্লোরাইড এবং ‘এটিপি’- এই চার উপাদানের নির্দিষ্ট মিশ্রণ মশাদের স্বাদ স্নায়ুগুলোকে অভ্রান্তভাবে উত্তেজিত করে, তৃপ্তিতে নিমেষে জ্বলে ওঠে আলো। শুধু গ্লুকোজ দিলে তো জ্বলবে না, চাই ৪টি উপাদানের বিশেষ মিশ্রণ। এই উপাদানগুলো রক্তে মেলে। স্ত্রী মশারা তাই সহজেই বুঝতে পারে ব্লাড ব্যাংকের উপস্থিতি। শুধু তা-ই নয়, মশাগুলো বেশ লোভীও। নিজের ওজনের তিনগুণ বেশি রক্ত খেয়ে প্রায়শই হাঁসফাঁস করে। মশাদের চোষক নলে রয়েছে কার্বন ডাইঅক্সাইড পরিমাপ করার ক্ষমতা। কার্বন ডাইঅক্সাইড প্রাণের উপস্থিতির স্মারক। এই গবেষণা পথ দেখাবে, মশাদের টেস্ট বদলে ফেলতে পারলেই কেল্লা ফতে। মুক্তি মিলবে কামড় থেকে। গবেষক লেসলি ভোস্যাল ভবিষ্যৎ মশাদের কামড় থেকে মানব প্রজাতিকে বাঁচাতে তৎপর। ভবিষ্যতে জনঘনত্ব বেড়ে যাওয়ার সঙ্গেই মশাদের স্বাদ-স্নায়ুগুলো ছটফট করবে অনেক বেশি, কামড়গুলো মানুষের রক্তের স্বাদ ও গন্ধের উপর নির্ভরশীল হয়ে উঠবে। তাই গবেষকদের কাজ, মশাদের স্বাদ-স্নায়ুগুলোকে বিভ্রান্ত করে মানুষের রক্তের স্বাদ ভুলিয়ে দেওয়া।
গবেষকদের অন্য একটা দল আবার মশাদের নিদ্রা নিয়ে অনিদ্রায় আছে। সেটাও চমৎকার গবেষণা। ২০২২-এ ‘জার্নাল অফ এক্সপেরিমেন্টাল বায়োলজি’-তে প্রকাশ হল মশাদের ঘুমের ধরনধারণ। ঝিমোতে থাকা মৌমাছিরা যেমন নাচতে ভুলে যায়, তন্দ্রাচ্ছন্নতায় মাছিরা যেমন স্মৃতিবিভ্রাটে ভোগে, ঠিক তেমনই মশারাও টেনে ঘুময়, মানুষের রক্তের গন্ধ পেলেও ভাঙে না সেই ঘুম। তিন ধরনের মশা প্রজাতি নিয়ে অভিনব একটা বহুমাত্রিক পরীক্ষা চালানো হয়েছিল। অ্যানোফিলিস- যারা মূলত রাতে জাগে। কিউলেক্স- যারা আবার সন্ধেয় ছটফট করে। আর এডিস- যারা কিনা দিবাচর। তিন ধরনের মশাকে একটা ঘরে বদ্ধ করে অত্যাধুনিক ক্যামেরা লাগিয়ে দেখা গিয়েছিল ঘণ্টা দুয়েক পর কিউলেক্স আর অ্যানোফিলিস গভীর ঘুমে কাদা, পেট মাটিতে রেখে, পিছনের পা দুটো থেবড়ে টেনে ঘুমচ্ছে। সেই সময় মানুষের রক্তের গন্ধ আর উষ্ণতাও, তাদের টেনে তুলতে ব্যর্থ। তবে জেগে থাকলে মানুষের রক্তের গন্ধে টনক নড়ে মুহূর্তে। মশাদের ঘুম তো মানুষের কাছে স্বস্তি।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.