কিংশুক বন্দ্যোপাধ্যায়: উগ্র জাতীয়তাবাদী তাস খেলতেই কি চিন হিমালয় জুড়ে রণাঙ্গন রচনার মতলবে আছে? হংকংয়ে গণতন্ত্রের টুঁটি টিপে ধরা আর লাদাখে হামলা কি আসলে সেই উগ্র জাতীয়তাবাদের জিগির তুলে ফায়দা তোলার বৃহত্তর পরিকল্পনার দু’টি অংশ মাত্র?
পশ্চিমে যখন লাদাখে তুমুল উত্তেজনা, তখন সুদূর পূর্বের অরুণাচলেও ধিকিধিকি আগুন জ্বলছে। ভুটানের ডোকলামেও রয়েছে চাপা অস্থিরতা। এমনকী, পশ্চিম নেপাল সীমান্তে লিপুলেখে ও কাঠমান্ডু যে অতিসক্রিয় হয়ে উঠেছে তার নেপথ্যেও বেজিংয়ের মদত রয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে। এককথায় ভারত-চিন সীমান্তের হাজার চারেক কিলোমিটার জুড়েই অস্থিরতার জাল বোনা শুরু হয়েছে।
কিন্তু কেন? উত্তরটা হয়তো লুকিয়ে রয়েছে উনিশ শতকের চারের দশকের পর থেকে চিনা ইতিহাসের কয়েকটা সামরিক সংঘাত আর তার পরবর্তী পরিস্থিতির মধ্যে। উনিশ শতকের মধ্যভাগে চিনে আফিম রপ্তানি আর বিক্রিকে কেন্দ্র করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে তৎকালীন শিং সম্রাটের সামরিক সংঘাত শুরু হয়। ১৮৪০-’৪২ এই বছর দুই ধরে চলা মূলত নৌ-যুদ্ধে ব্রিটিশ নৌবহরের সঙ্গে চিনা নৌশক্তি মোটেই পেরে ওঠেনি। ইতিহাসে ‘প্রথম আফিম যুদ্ধ’ নামাঙ্কিত এই সামরিক সংঘাতের শেষে ১৮৪২ সালের ২৯ আগস্ট অষ্টম শিং সম্রাট ডাওগোয়াঙের দুই প্রতিনিধি নানকিং শহরের অনতিদূরে ইয়াংসি নদীতে নোঙর করা ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজ এইচএমএস কর্নওয়ালিসে ইংরেজদের সঙ্গে এক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। ইতিহাসে যা ‘নানকিং চুক্তি’ নামে পরিচিত। চুক্তির ১৩টি শর্তের মধ্যে অন্যতম ছিল হংকং দ্বীপের কর্তৃত্ব ইংরেজের হাতে চলে যাওয়া। নানকিং চুক্তির এসব অপমানজনক শর্ত চিন মন থেকে মানতে পারেনি।
এ তো গেল ইতিহাসের কথা! মাও জে দং জমানার অবসানে দেং জমানায় চিনা অর্থনীতিতে পুঁজিবাদের দমকা হাওয়ায় আগের সমাজতন্ত্র উড়ে যাওয়ার পর বেজিংয়ের সামনে অন্য সমস্যা দেখা দিল। ‘গ্লাসনস্ত’, ‘পেরেস্ত্রৈকা’ যখন ক্রেমলিন থেকে লাল পতাকা ফেলে দিল, তখন দেওয়াল লিখন পড়তে চিনের লাল নেতাদের বেশি সময় লাগেনি। মানে, ক্ষমতার মসনদে টিকে থাকতে গেলে যে ‘মতাদর্শ’-কে প্রাধান্য দিলে নিজভূমেই পরবাসী হতে হবে সেটা অধুনা প্রাক্তন সোভিয়েত নেতাদের দশা দেখে বুঝে যান তঁারা। তাই নব্য পুঁজিবাদের কমরেড হল উগ্র জাতীয়তাবাদ। যদিও জিয়াং জেমিন, হু জিনতাওয়ের আমলে তার রুদ্ররূপ তেমনভাবে প্রকট হয়নি।
ওয়াকিবহাল মহলের মত, ২০১২ সালে শি জিনপিং জমানা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই চিনা বিদেশনীতিতে আমূল বদল আসে। বিশ্ব সচকিত হয়ে দেখল, চিন ক্রমে শুধু যে তার পড়শিদের সঙ্গেই সীমান্ত বিবাদে জড়িয়ে পড়ছে তা-ই নয়, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতেও প্রভাব বিস্তার করতে চাইছে, করছে। শি-এর পাশাপাশি, নিজেকে মাওয়ের স্তরে নিয়ে যাওয়ারও চেষ্টা করছেন। দেং-এর আমলের নিয়ম পালটে আজীবন ক্ষমতার মসনদে থাকার রাস্তা পরিষ্কার করেছেন। পশ্চিমি গণমাধ্যম তো তাঁকে ‘মাও ২.০’ উপাধি দিয়েই ফেলেছে।
সমগ্র দক্ষিণ চিন সাগরই তাদের– এই দাবি করেছে বেজিং। এরপরই তাদের চোখ পড়ে দক্ষিণের সীমানা হিমালয়ের উপর। অরুণাচলকে তিব্বতের অংশ বলে যে শোরগোল শুরু হল, ক্রমে তা এখন ডোকলাম, সিকিম হয়ে উত্তর লাদাখে গিয়ে পৌঁছেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইতিহাসের যুদ্ধবাজ একনায়করা সবসময়ই দেশের অন্য সমস্যা থেকে নজর ঘোরানোর জন্য সমরকে হাতিয়ার করেন। এক্ষেত্রে শি নিঃসন্দেহে মাওয়ের প্রকৃষ্ট উত্তরসূরি হয়ে উঠছেন। এশিয়া বিশেষজ্ঞ তথা সাংবাদিক বার্টিল লিন্টার তাঁর ‘চায়নাস ইন্ডিয়া ওয়ার’ বইয়ে স্পষ্ট দেখিয়েছেন, চিনের অর্থনীতির হাল ফেরাতে মাও ১৯৫৮ সালে যে ‘গ্রেট লিপ ফরওয়ার্ড’ প্রকল্প চালু করেন, বছর ঘুরতে না ঘুরতে তা মুখ থুবড়ে পড়ে। বছর তিনেক পরে দেখা যায়, ভ্রান্ত এই প্রকল্পের জেরে অনাহারে সাড়ে চার কোটি মানুষের প্রাণ গিয়েছে। এর জেরে মাওয়ের গদি তখন টলোমলো।
অতএব, যেনতেন প্রকারে গদি বাঁচাতে যুদ্ধকেই আকঁড়ে ধরেন মাও। ১৯৬২ সালের অক্টোবর মাসে ভারত-চিন সীমান্ত বরাবর সেনা সমাবেশ শুরু করে বেজিং। ১৯ অক্টোবর সীমান্ত বরাবর গোলাবর্ষণ শুরু করে চিনা সেনাবাহিনী। পরদিনই লাদাখ আর অরুণাচলে ভারতীয় সেনা অবস্থানে হামলা চালায় ‘পিপল্স লিবারেশন আর্মি’। পুরোদস্তুর যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।
ঠিক সেই পথই বেছে নেননি তো শি? সুদূর অতীতে চিনের সঙ্গে অন্যায় হয়েছে– এই ভ্রান্ত জিগির তুলে তার থেকে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার চেষ্টা করছেন না তো? হংকংয়ের সঙ্গে চিনের সাম্প্রতিক ব্যবহারে কিন্তু তারই ইঙ্গিত স্পষ্ট।
কিন্তু এই উগ্র জাতীয়তাবাদী তাস খেলার দরকারই বা পড়ল কেন বেজিংয়ের? পশ্চিমি গণমাধ্যমে শি যতই নিজেকে মাওয়ের একবিংশ শতকের সংস্করণ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করুন না কেন, আদতে সময়টা তঁার মোটেই ভাল যাচ্ছে না। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইতিমধ্যেই ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নাম দিয়ে এই তাস খেলে ওভাল অফিসে জঁাকিয়ে বসেছেন। আর বসেই আমজনতার ভোটব্যাঙ্ক অক্ষুণ্ণ রেখে দ্বিতীয়বার বৈতরণি পার হওয়ার জন্য এমন সব কাজ করছেন যা শি-এর গোড়া থেকেই না-পসন্দ। ফলে, বিশেষজ্ঞদের মত, দু’পক্ষের ধুন্ধুমার বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু হওয়া ছিল স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। আর, তা শুরুও হয়ে গিয়েছে।
এই বাণিজ্য সংঘাতের প্রথম দিকে বেজিং কিন্তু ভালই যুঝছিল। করোনা এসে সব অঙ্ক ভেস্তে দেয়। দেশে সংক্রমণের প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে পুকুরচুরির অভিযোগকে তেমন আমল না দিলেও ইউহানের ভাইরোলজি গবেষণাগার থেকেই যে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে– এই অভিযোগে এখন নাস্তানাবুদ বেজিং। কাজেই রাতারাতি বিশ্বের কাঠগড়ায় বেজিং। যে শি ভাবছিলেন সাড়ে ১২ হাজার কোটি ডলারের পাঁচ মহাদেশব্যাপী ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ পরিকাঠামো প্রকল্পের মাধ্যমে সারা বিশ্বে বেজিং রাজ করবে আর তিনি অবিসংবাদী বিশ্বনেতা হবেন, সেখানে এই ধাক্কা শুধু যে মারাত্মক তা-ই নয়, দেশের মানুষের কাছেও তঁার ভাবমূ্র্তি বিনষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। অন্যদিকে, বাণিজ্যযুদ্ধে রক্তক্ষরণের পাশাপাশি করোনার প্রকোপে দুনিয়ার দরবারে ‘বিশ্বের কারখানা’ তকমা নিয়ে টানাটানি পড়তে পারে। একের পর এক বহুজাতিক সংস্থা চিন থেকে কারখানা গোটানোর কথা বলছে। যে ‘ইয়ান’-কে ডলার-পাউন্ডের চ্যালেঞ্জার হিসাবে তুলে ধরতে বেজিং এত মরিয়া, বিশ্ববাজারে তার সেই ঠাটবাট তলানিতে এসে ঠেকেছে। ফলে ৬০ বছর আগে মাওয়ের মতোই আজ তাঁর উত্তরসূরি উগ্র জাতীয়তাবাদের পিঠে সওয়ারি হয়ে বাঁচার চেষ্টা করছেন।
এই প্রসঙ্গে চিনা সরকারপন্থী দৈনিক ‘ওয়েনউইপো’-তে বছর সাতেকের পুরনো এক নিবন্ধের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। ‘আগামী ৫০ বছরে চিনকে যে ৬টি যুদ্ধ করতেই হবে’ নামের এই প্রবন্ধে বেজিং কীভাবে যুদ্ধকে ব্যবহার করে পরাশক্তি হবে, তারই রূপরেখা দেওয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল, অরুণাচল-কে (চিনের ভাষায় ‘দক্ষিণ তিব্বত’) নিয়ে ২০৩৫-’৪০ সালে ‘তৃতীয় যুদ্ধ’ হবে ভারতের সঙ্গে। কী কৌশল নেওয়া হবে তা-ও বলা হয়েছিল। চিন একা হামলা করে যদি সুবিধা না করতে পারে, তাহলে কাশ্মীরে পাকিস্তানও দোসর হয়ে হামলা চালাবে। এই দ্বিমুখী আক্রমণ দিল্লি সামলাতে পারবে না বলেই বিশ্বাস নিবন্ধকারের। চিনের তরফে ইচ্ছাকৃতভাবে সীমান্ত উত্তেজনা জিইয়ে রাখা সেই আসন্ন বিপদের অশনি সংকেত নয় তো?
(মতামত নিজস্ব)
লেখক সাংবাদিক
[email protected]
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.