প্রধানমন্ত্রিত্বর দশ বছর কাবার হওয়ার মুখে রিপোর্ট কার্ড মেলে ধরে দেখছি, প্রতিশ্রুতি পূরণ না হলেও নতুন স্বপ্ন দেখাতে তিনি কুণ্ঠিত নন। এবারের লালকেল্লার ভাষণ তাঁর লেটেস্ট স্বপ্নগুচ্ছ। কলমে সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়
নরেন্দ্র মোদি তিনটে স্বপ্ন ফেরি করে সাধারণ মানুষের আস্থা ও ভরসায় ভেসে ক্ষমতায় বসেছিলেন। এক) বেকারত্ব দূর করে বছরে দু’-কোটি মানুষকে চাকরি দিয়ে দেশের অর্থনীতিকে অগ্রগণ্য করে তুলবেন। দুই) দুর্নীতি উৎপাটন ও দুর্নীতিগ্রস্তদের শাস্তি দিয়ে আইনের শাসন ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করবেন। তাঁর স্লোগান ছিল- ‘না খাউঙ্গা, না খানে দুঙ্গা।’ তিন) সন্ত্রাসবাদ ও বিচ্ছিন্নতাবাদের মূল উপড়ে দেশের সীমান্ত সুরক্ষিত করবেন। প্রধানমন্ত্রিত্বর দশ বছর কাবার হওয়ার মুখে রিপোর্ট কার্ড মেলে ধরে দেখছি, প্রতিশ্রুতি পূরণ না হলেও নতুন স্বপ্ন দেখাতে তিনি কুণ্ঠিত নন।
আগে পাঁচ বছর, দশ বছরের কথা বলেছেন। ২০৪৭ সালে স্বাধীনতার শতবর্ষ পূর্তিতে হ্যান করেঙ্গা, ত্যান করেঙ্গার কথা শুনিয়েছেন। এখন একলপ্তে এক হাজার বছরের স্বপ্ন দেখিয়ে বলছেন, ‘জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ আসন’ ভারত প্রায় পেয়েই গিয়েছে। স্বীকৃতিদানের ঘোষণাটুকু স্রেফ বাকি!
এবারের লালকেল্লার ভাষণ তাঁর লেটেস্ট স্বপ্নগুচ্ছ। ভোট আসছে, তাই বুক চাপড়ে বলেছেন, পাঁচ বছরের মধ্যে দেশ হবে তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। মোদির গ্যারান্টি। গ্যারান্টির দশা শেষমেশ কী হবে, অন্য কথা! কত গ্যারান্টি দশ বছরে আলোর মুখই দেখল না! তালিকা প্রকাশ অনর্থক। সাধারণের অভিজ্ঞতা সরকারি পরিসংখ্যানের তুলনায় অনেক দামি। তবে এবার তিনি ভাবের ঘরে সিঁধ কেটে চুরিটা করতে চেয়েছেন চমৎকারভাবে! ভারতের বাজার ও অর্থনীতি আড়ে-বহরে এতটাই স্ফীত যে, মোট বাৎসরিক উৎপাদন, সহজভাবে যা আমরা ‘জিডিপি’ বলে জানি, এমনিতেই তা গড়গড়িয়ে আগামী দিনে জাপান ও জার্মানিকে টপকে যাবে। যুক্তরাষ্ট্র ও চিনের পরেই পাতা হবে ভারতের আসন। সেজন্য মোদির গ্যারান্টির প্রয়োজন-ই নেই। হেঁয়ালিটাও এখানেই।
অর্থনীতির সামান্য জ্ঞানগম্যি থাকা শিশুরাও তিনটি বিষয় জানে। প্রথমত, এ-দেশের সরকারি পরিসংখ্যানের সঙ্গে বাস্তবের অমিল চাঁদেরর সঙ্গে চাঁদমালার মতো। দ্বিতীয়ত, অর্থনীতির বণ্টন-বৈষম্যর দরুন সামনের সারির ১০ শতাংশের সঙ্গে শেষের ৬০-৬৫ শতাংশ জনতার কোনও তুলনাই টানা যায় না। পার্থক্যটা আশমান-জমিনের। এ-দেশের জনসংখ্যার এক শতাংশ যে মোট সম্পদের ৫০ শতাংশ ভোগ করে, সেই হিসাব শিশুদেরও ঠোঁটস্থ! তৃতীয় বিষয়, জিডিপি বৃদ্ধির সঙ্গে মাথাপিছু আয় বাড়ার কোনও সম্পর্কই নেই। আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার, বিশ্ব ব্যাংক ও জাতিসংঘর হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বের ১৯০টি দেশের মধ্যে মাথাপিছু আয়ের নিরিখে ভারতের অবস্থান ১৪০-এর উপর-নিচে ঘুরঘুর করছে। যাদের টপকে ভারত একাদশ থেকে পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতিতে পৌঁছেছে এবং যাদের ডিঙিয়ে তৃতীয় স্থানে পৌঁছনোর গ্যারান্টি দিয়ে মোদি কোমর কষছেন, তাদের মাথাপিছু আয়ের ধারে-কাছেও নেই ভারত! দেশের মানুষ আর্থিক দিক থেকে বলশালী এবং তারা সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাস করছে, সেই দাবি এই পরিসংখ্যান থেকে প্রতিফলিত হয় না।
বছরে দু’-কোটি মানুষকে চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতির সঙ্গে দুধে-আমের মতো মিশে রয়েছে এই মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির বিষয়টি। দশ বছরের সাফল্য-ব্যর্থতার খতিয়ান যাঁরা করবেন, প্রধানমন্ত্রীর এই প্রতিশ্রুতির পাশে তাঁরা অবশ্যই লাল কালির ক্রস আঁকবেন।
মোদির দ্বিতীয় প্রতিশ্রুতি ছিল দুর্নীতি দূর করা। দশ বছরের মাথায় দুই সংস্থার একগাদা রিপোর্ট সেই প্রতিশ্রুতিকে পরিহাসে পরিণত করেছে। ছোটখাটো দুর্নীতির পাশাপাশি পাহাড় প্রমাণ কেলেঙ্কারি হড়পা বানের মতো আচম্বিতে যেন ভাসিয়ে দিল মোদি সরকারের গরিমা। ভিজিলেন্স কমিশনের বার্ষিক রিপোর্ট দেখাচ্ছে, ২০২২ সালে সব কেন্দ্রীয় মন্ত্রকে দুর্নীতির অভিযোগ জমা পড়েছে ১ লাখ ১৫ হাজারেরও বেশি। তালিকায় সবার উপরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। তারপর অভিযোগ বেশি রেলওয়ে ও ব্যাংকে।
দুর্নীতির বাস্তুঘুঘুদের বাসা ভাঙতে দেশের ‘প্রধান সেবক’ ও অনুগতরা কত সচেষ্ট, সেই বিতর্ক পাশে ঠেলে হিমশৈলর চূড়ার মতো মাথা তুলেছে ‘কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল’-এর (সিএজি) রিপোর্ট। একটি নয়, দু’টি নয়, সাত-সাতটি রিপোর্ট সিএজি সম্প্রতি সংসদে পেশ করেছে। বিরোধীরা সেই রিপোর্টকে হাতিয়ার করলেও মোদির দখলিকৃত ‘গোদি মিডিয়া’-য় তার ছিটেফোঁটাও প্রতিফলিত নয়। সেখানে দিন-রাতের চর্চা ‘জি ২০’ নামক মোচ্ছবের। প্রধানমন্ত্রী দেশকে কোন উচ্চতায় তুলে দিয়েছেন, গোটা পৃথিবী কীভাবে তাঁর মহিমা প্রচারে মগ্ন, সেই ঢাক পেটানোর পাশাপাশি চলছে সিএজি রিপোর্টকে কীভাবে দেখতে হবে, বুঝতে হবে, অনুধাবন করতে হবে, তা তঁারই শিক্ষাদান।
সিএজি রিপোর্টের তিনটি নমুনা দেখিয়ে দিচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর নাকের ডগায় দুর্নীতি কীভাবে প্রশ্রয় পেয়ে দৈত্যাকার হয়েছে। ‘ভারতমালা’ প্রকল্পে দেশজুড়ে ৩৪ হাজার কিলোমিটার রাস্তা তৈরিতে বরাদ্দ ৫ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকা। অথচ, ২৬ হাজার কিলোমিটার রাস্তা তৈরিতে খরচ হচ্ছে ৮ লাখ ৪৬ হাজার কোটি! সহজ অঙ্ক, ৯ হাজার কিলোমিটার রাস্তা কম তৈরি হচ্ছে অথচ খরচ হচ্ছে বরাদ্দের চেয়ে ৩ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা বেশি।
এই হিসাব ম্লান করেছে দ্বারকা এক্সপ্রেসওয়ে। দিল্লির দ্বারকা থেকে হরিয়ানার গুরুগ্রাম পর্যন্ত এই এক্সপ্রেসওয়ে তৈরির খরচ ধরা হয়েছিল কিলোমিটার প্রতি ১৮ কোটি টাকা। সিএজি রিপোর্ট দেখাচ্ছে, সেখানে প্রতি কিলোমিটারে খরচ হচ্ছে ২৫০ কোটি।
‘আয়ুষ্মান প্রকল্প’ প্রধানমন্ত্রীর বড় সাধের। গরিবের কান্না মোছাতে বুক বাজিয়ে বারবার তিনি এই প্রকল্পের কথা প্রচার করেছেন। সিএজি রিপোর্ট দেখাচ্ছে, সেই প্রকল্পে ৭৫ লাখ মানুষের নাম নথিবদ্ধ হয়েছে একটি মাত্র মোবাইল নম্বরের অধীনে! একটি মাত্র আধার কার্ডে লাখ লাখ মানুষের নাম! ৮৮ হাজার মৃত মানুষের নামে চিকিৎসা বিমার টাকা পেমেন্ট হয়েছে! জম্মু-কাশ্মীরের উপ-রাজ্যপালের পদ থেকে সরিয়ে সিএজি-র দায়িত্ব নরেন্দ্র মোদি দিয়েছিলেন অতি বিশ্বস্ত গুজরাতের ক্যাডার গিরিশচন্দ্র মুর্মুকে।
কত দ্রুত তিনি ‘বিভীষণ’ আখ্যা পান, সেটাই এখন ভাবাচ্ছে। সেই সঙ্গে চোখে ভাসছে দু’টি মুখ। প্রথমজন বিনোদ রাই, সিএজি হিসাবে যিনি ‘টুজি’ স্পেকট্রাম বণ্টনে ১ লাখ ৭৬ হাজার কোটি টাকার কল্পিত ক্ষতির খতিয়ান পেশ করে মনমোহন সিং সরকারকে টলিয়ে দিয়েছিলেন। সেই অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি, তবে মোদি সরকারকে ক্ষমতাসীন করেছিল। পুরস্কার জুটেছিল বিনোদ রাইয়েরও। মোদি তাঁকে ‘পদ্মভূষণ’ করেছিলেন, ব্যাংক বোর্ড ব্যুরোর চেয়ারম্যানও।
দ্বিতীয় মুখটি সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈয়ের। ‘দেশের স্বার্থে’ সিলবন্ধ খামে পেশ করা সরকারি যুক্তিতে সন্তুষ্ট হয়ে তিনি রায় দিয়েছিলেন, রাফাল কেনাবেচায় দুর্নীতি হয়নি। অবসর গ্রহণের পর এখন তিনি রাজ্যসভার রাজরত্ন! রাফাল, ইলেক্টোরাল বন্ড কিংবা ‘পিএম কেয়ার্স’-এর রহস্য কোনও একদিন নিশ্চয়ই ফাঁস হবে। আপাতত সিএজি-র ম্যাও সামলাতে মোদি ব্যস্ত।
নরেন্দ্র মোদির তৃতীয় প্রতিশ্রুতি ছিল দেশের সীমান্ত সুরক্ষার। সেই কাজে তাঁর ব্যর্থতার জ্বলন্ত প্রমাণ পূর্ব লাদাখের বিস্তীর্ণ অঞ্চল। বাজপেয়ীকে হতবাক করেছিল মুশারফের পাকিস্তান। ভারতীয় জওয়ানদের আলসেমি ও গা এলানো মনোভাবের সুযোগ নিয়ে দ্রাস, কার্গিলের গিরিপ্রান্তর ছেয়ে ফেলেছিল পাকিস্তানি বাহিনী। মোদির ভারতকে হতবাক করে চিনের লাল ফৌজও নিঃসাড়ে লঙ্ঘন করেছে লাদাখের কয়েক হাজার বর্গ কিলোমিটার ধূসর গিরিপ্রান্তর। গালওয়ানের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর কেটে গিয়েছে তিনটি বছর। আজও ৬৫টি এলাকার মধ্যে ২৬টি-তে টহলদারির অধিকার ভারতীয় জওয়ানরা ফিরে পাননি। ১৯ বার বৈঠকে বসেছে দুই দেশের বাহিনী। ‘প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা’-য় ২০২০ সালের জুন-পূর্ববর্তী স্থিতাবস্থায় ফেরত পাঠানো যায়নি চিনকে। কেন-ই বা যাবে তারা? দেশপ্রেমিক প্রধানমন্ত্রী-ই যেখানে সর্বদলীয় বৈঠকে বুক ঠুকে বলেছেন, ‘কেউ ঢোকেনি, কেউ ভারতের কোনও ঘাঁটিও কবজা করে বসে নেই।’ তার মানে ‘স্থিতাবস্থা’-ই তো বহাল? তাহলে কেন এত নাকি-কান্না? সীমান্তে স্থিতাবস্থা না ফিরলে সম্পর্ক স্বাভাবিক না হওয়ার জিগির?
স্বরূপ উদ্ঘাটনে দশটা বছর অনেক। নতুন প্রতিশ্রুতিতে দেশবাসী মোহিত হবে কি না পরের কথা, মুখোশের আড়ালে ‘প্রধান সেবক’-এর মুখটা কিন্তু ঝকঝক করছে।
(মতামত নিজস্ব)
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.