সোশ্যাল মিডিয়ায় দলিত অধ্যাপক মিথিলেশ কুমারের একটি পোস্ট। এবং সে পোস্ট-সংক্রান্ত বিতর্কের জেরেই শেষমেশ চাকরি থেকে বরখাস্ত! ভারতে ‘পঞ্চম বর্ণ’ বলে চিহ্নিত মানুষেরা অস্পৃশ্যতার শিকার হয়ে যুগের পর যুগ দারিদ্র, অশিক্ষা ও অবহেলাকে ‘অদৃষ্ট’ বলে মেনে নিচ্ছেন। ভারতের তথাকথিত ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ তকমা কি মুছে যাচ্ছে? হিন্দু ধর্মেও কি ধীরে ধীরে বদলে আনছে রাজনৈতিক অনুশাসন? লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল
আপনারা মিথিলেশ কুমার গৌতমের নাম শুনেছেন? মিথিলেশ বেনারসে ‘মহাত্মা গান্ধী কাশী বিদ্যাপীঠ’-এ রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। সম্প্রতি তাঁকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে কলমের একটি খোঁচায়। কিন্তু কেন? কেন তাঁকে বরখাস্ত করা হল?
মিথিলেশ কুমার ছিলেন এক দলিত অধ্যাপক। সোশ্যাল মিডিয়ায় খুবই সক্রিয়। তিনি তাঁর সমস্ত পোস্টের শেষে লিখতেন ‘জয় ভীম’। নবরাত্রি উদ্যাপনের সময় তিনি একটি পোস্ট করেন। লেখেন, ভারতীয় নারীরা নবরাত্রির সময় ন’দিন যদি উপোস না-করে ভারতীয় সংবিধান এবং ‘হিন্দু কোড বিল’ পড়েন, তাহলে অনেক বেশি ভাল হবে। কারণ এর ফলে তাঁরা দাসত্ব এবং ভয় থেকে নিজেদের মুক্ত করতে পারবেন।
সোশ্যাল মিডিয়ায় এ মন্তব্য পোস্ট হওয়ার পর বিজেপি ছাত্র সংগঠন ‘অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ’ (এবিভিপি) প্রতিবাদ আন্দোলনে নামে। কলেজের সামনে, এমনকী, ‘বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়’-এর বিভিন্ন ভবন ও গেটের সামনে এই অধ্যাপকের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ কর্মসূচি শুরু হয়। দাবি তোলা হয়, অধ্যাপককে অবিলম্বে বরখাস্ত করতে হবে। উপাচার্যর কাছে স্মারকলিপিও জমা দেওয়া হয়। বলা হয়, মিথিলেশ নবরাত্রি ব্রত সম্পর্কে কটাক্ষ করে হিন্দু ধর্মের উপর আঘাত হেনেছেন। তাঁর যোগ্য শাস্তি হওয়া উচিত।
এদেশ এখনও ‘গণতান্ত্রিক’। ভারতীয় সংবিধান বলছে, প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক অধিকার আছে। এই অধিকার অনুসারেই, যে কোনও মহিলার উপবাস রাখার অধিকার আছে। ভারতীয় হিন্দু ধর্মে সনাতন শাস্ত্রে উপবাসের উপযোগিতার কথা ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তিন ধরনের উপবাসের কথা বলা হয়েছে ভারতীয় শাস্ত্রে। প্রথমত নির্জলা, দ্বিতীয়ত জল খেয়ে উপবাস, তৃতীয়ত, রস-উপবাস। অর্থাৎ, শুধু ফলের রস খেয়ে থাকা। শুধু হিন্দু ধর্ম কেন ইসলাম, খ্রিস্ট ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম- সর্বত্রই উপবাসের প্রথা আছে। উপবাস মাঝে মাঝে করলে তা শরীরের জন্য কেন ভাল, কেন এই উপবাস বৈজ্ঞানিক– সেকথা আজকাল সোশ্যাল মিডিয়াতেও প্রচারিত।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি পুরুষ হয়েও নবরাত্রি পালন করেন। এ সময়ে অন্য কোনও রাষ্ট্রনায়কের সঙ্গে তাঁর বৈঠক হলেও তিনি কূটনীতিক ভোজসভাতেও আহার গ্রহণ করেন না। শুধু ফলের রস পান করেন। যা ‘রস-উপবাস’। তাঁকে সেজন্য কোনও কটাক্ষের শিকার হতে হয়েছে বলে শুনিনি। ঘোরতর মোদি-বিরোধীও তাঁর উপবাস নিয়ে কোনও কটু মন্তব্য করেননি। বাঙালিরা নবরাত্রির উপবাস কার্যত মানেই না। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ দুর্গাপুজোর সময়, অর্থাৎ নবরাত্রির সময় ঘোরতর আমিষপন্থী। নবমীর দিন মাংস খাওয়ার সংস্কৃতিও সুপ্রাচীন। তা’বলে কেউ নবরাত্রির উপবাস করলে তাঁকে উপহাস করব? উপোস করতে বাধা দেওয়ার আমি কে?
হে মিথিলেশ কুমার, তোমার নাম মিথিলা-শ্রেষ্ঠ হতে পারে, তা’বলে এই জ্ঞান দেওয়ার অধিকার তোমাকে কাশীবাসী দেয়নি, সমগ্র ভারতও দেয়নি। কিন্তু সটান চাকরি থেকে বরখাস্ত! আসলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপকের বক্তব্যের ‘থ্রাস্ট’ ছিল যে, ভারতীয় সংবিধান ও ‘হিন্দু কোড বিল’ পড়া নারীদের জন্য বেশি জরুরি। তাতে তাঁদের সমাজ-সচেতনতা বাড়বে।
ভারতীয় নারীরা এখনও ধর্মীয় আচার-বিধি নানা সংস্কার-শৃঙ্খলায় বন্দি। মিথিলেশ নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলতে চেয়েছেন। পুরুষতান্ত্রিক সামন্তবাদী মানসিকতায় আঘাত হানতে চেয়েছিলেন। যারা বলে, নারী তুমি ‘অর্ধেক আকাশ’ তারাই নারীদের ‘দ্বিতীয় লিঙ্গ’-র ঘেরাটোপে আটকে রেখেছে।
তাই মিথিলেশের বক্তব্যে প্রগতিশীল কুসংস্কারমুক্ত বৈজ্ঞানিক রাজনীতি সচেতন মনের পরিচয়ও আছে। কিন্তু সমস্যা হল মিথিলেশ হিন্দু সমাজতান্ত্রিক শিক্ষক নন। তিনি একজন ‘দলিত’ অতিথি অধ্যাপক। বলা হচ্ছে, দলিতকে ‘দলিত’ বলবেন না। সরকারি নাম: ‘তফসিলি জাতি ও উপজাতি’। এই দলিতকে সম্প্রতি ‘হিন্দু’ তকমা দেওয়ারও রাজনীতি শুরু হয়েছে প্রবলভাবে। বলা হচ্ছে, হে দলিত, হে নীচ জাতি, হে মুচি-মেথর তোমাদের পরিচয়সত্তা অ-হিন্দু নয়, তোমরা হিন্দু সমাজের অন্তর্গত। ‘আরএসএস’ যদি ভারতীয় মুসলমানকেও ‘হিন্দু’ বলে অভিহিত করে, তবে দলিত কেন অ-হিন্দু?
দলিত কে? ভারতীয় বর্ণাশ্রম অনুসারে চারটি প্রধান জাত। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র। দলিত এই চার জাতেরও বাইরে। এজন্য অনেকে তাদের ‘পঞ্চম বর্ণ’ বলেও অভিহিত করেছে। ‘দলিত’ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত থেকে। সংস্কৃত ভাষায় শব্দটির অর্থ বিভাজিত (divided)- ভেঙে যাওয়া, টুকরো হয়ে যাওয়া (split-broken), ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বিক্ষিপ্ত হয়ে যাওয়া (scattered)। বাবাসাহেব আম্বেদকর বলেছেন, প্রায় ৪০০ ‘সিই’ (common era) থেকে দলিত প্রথার এ-সমাজে প্রবর্তন ঘটে। ব্রিটিশরা জনগণনার সময় সবচেয়ে নিষ্পেষিত, অত্যাচারিত জাতকে ‘দলিত সমাজ’ বলে চিহ্নিত করেছিল। ব্রাহ্মণবাদী হিন্দু ধর্মের অতীত অত্যাচারে বহু দলিত খ্রিস্টান ও মুসলমান হয়ে যান। ধর্মান্তরিত হওয়ার পর তাঁরা সংরক্ষণ আইন অনুসারে দলিত কোটার অধীনে এসে সুযোগ-সুবিধা পাবেন কি পাবেন না, তা নিয়েও বিতর্ক হয়েছে। কিন্তু ২০২২-এর শেষ লগ্নে দাঁড়িয়ে শুধু এই মন্তব্য করার জন্য মিথিলেশকে এত বড় শাস্তি? নরেন্দ্র মোদির নির্বাচন কেন্দ্র বেনারস। এই শহরটি শুধু হিন্দু ধর্ম নয়, ভারতীয় সভ্যতার প্রাচীনতম শহর।
মার্ক টোয়েন ১০০ বছর আগে বারাণসী ভ্রমণ করে বলেছিলেন, বেনারস সমস্ত ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং কিংবদন্তির চেয়েও প্রাচীন সভ্যতার শহর। তা এহেন শহরে লঘুপাপে এত গুরুদণ্ড! এ তো সুকুমার রায়ের বিচারক প্যাঁচার রায়: ‘তিনমাস জেল আর সাতদিনের ফাঁসি’। হিন্দু ধর্মের বৈশিষ্ট্য তার সহিষ্ণুতা, ঔদার্য, সর্বজনগ্রাহ্যতায়। হিন্দু ধর্মকে বরাবরই একটি প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম না-বলে একটি ‘বিশেষ জীবনধারা’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। তাই হিন্দুধর্মের মধ্যে ন্যায়, বৈশেষিক, বেদান্তবাদীরা যেমন ছিলেন, তেমন ছিলেন নাস্তিক হিন্দুরাও। কপিলের সাংখ্য, চার্বাক এমনকী, বৌদ্ধ ধর্মকেও এককালে হিন্দু ধর্মের ছাতার তলায় রাখার চেষ্টা হয়।
কেউ জন্মসূত্রে হিন্দু হয়েও নাস্তিক হতেই পারেন। মার্কসবাদীরা তো নাস্তিক হিন্দু (Hindu)। ঈশ্বরে যাঁরা বিশ্বাস করেন না, সেই অবিশ্বাসীরা তো আজও মনে করেন- ধর্ম হল আফিম, নিপীড়িত মানুষের দীর্ঘশ্বাস। তাঁরা মনে করেন শুধু নবরাত্রি কেন, কালীপুজো থেকে ছটপুজো, আল্লা-র কথিত ইসলামিক ধর্মাচার অথবা খ্রিস্টানদের গির্জায় গিয়ে প্রার্থনা- এসবই অবান্তর। এর চেয়ে ভারতীয় সংবিধান পড়া প্রয়োজন। তাহলেও কি এই মার্কসবাদীদের চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হবে?
বেনারসে এখন বিজেপির দাপট। এ ঘটনার প্রতিবাদে সেখানে ‘বহুজন সমাজ পার্টি’-র নেত্রী মায়াবতীর কোনও প্রতিবাদ দেখলাম না। তিনি এখন ‘তাজ করিডোর’ বিক্রির দুর্নীতির মামলা থেকে বেকসুর খালাস পেতে ব্যস্ত। নব্য দলিত নেতা চন্দ্রশেখর আজাদ-ও আসন্ন ভোটে বিজেপির সঙ্গে বোঝাপড়ার সম্ভাবনা খতিয়ে দেখছেন। বেনারসে সমাজবাদী পার্টির কোনও পালটা বিক্ষোভ কাশী বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা গেল না। তাই শুধু বরখাস্ত নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার সুনীতা পাণ্ডে সংবাদমাধ্যমের সামনে এসে আদেশটি পড়ে শোনালেন। তিনি জানালেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের ১৪/৪ ধারা অনুসারে অধ্যাপককে বরখাস্ত করা হল, কারণ তিনি হিন্দু ধর্মর উপর আঘাত হেনেছেন। হিন্দু ধর্মের বিশ্বাসীদের অপমান করেছেন। এখানেই শেষ নয়, বলা হয়েছে ওই অধ্যাপককে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে আর ঢুকতে দেওয়া হবে না।
হিন্দু ধর্ম কি এতই ঠুনকো? এতই ভঙ্গুর? ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান (Pakistan) ‘ইসলাম রাষ্ট্র’ হলেও যে ভারত ‘ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র’ হয়েছিল, সেই ভারতের রাষ্ট্রীয় আখ্যানও কি বদলে যাচ্ছে? হিন্দু ধর্মও কি ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে রাজনৈতিক অনুশাসনে? ভারতে ‘পঞ্চম বর্ণ’ বলে চিহ্নিত মানুষরা অস্পৃশ্যতার শিকার হয়ে যুগের পর যুগ দারিদ্র ও অশিক্ষাকে ‘অদৃষ্ট’ বলে মেনে নেয়। মহারাষ্ট্রে জে্যাতিরাও ফুলে, তামিলনাড়ুতে রামস্বামী এবং বাংলায় গুরুচঁাদ ঠাকুর প্রথম দলিতদের জানিয়েছিলেন, এ শোষণ অদৃষ্টবাদ নয়, ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজে তারা জাতপাতের শিকার। সম্মিলিতভাবে সামাজিক ন্যায়ের জন্য লড়তে হবে।
দেবপ্রসাদ রায়ের ‘স্বাধীনতার ধাপে ধাপে’ গ্রন্থে এই দলিত সমাজের আন্দোলনের ইতিহাস লিপিবদ্ধ হয়েছে। তিনি লিখেছেন, ১৮৭২ সালের শেষে ফরিদপুর ও বাখরগঞ্জে নমঃশূদ্র অধ্যুষিত এলাকায় সংগঠিত সামাজিক বয়কট আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল। ফরিদপুর জেলার মসলন্দপুরের আমগ্রামের ধনী এক নমঃশূদ্র দ্বারকানাথ মণ্ডলের পিতৃশ্রাদ্ধে দশ হাজার লোকের গণভোজন হয়। কিন্তু, কায়স্থরা আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করে বলেন, চণ্ডালদের সঙ্গে এক পঙক্তি বসে তাঁরা খাবেন না। কারণ চণ্ডালরা মেথরের কাজ করেন- ওঁরা অস্পৃশ্য। ওঁদের মেয়েরা হাটে-বাজারে যান। এই ঘটনার প্রতিবাদে চণ্ডালদের আন্দোলন শুরু হয়। সিদ্ধান্ত হয়, সমানাধিকার না-পাওয়া পর্যন্ত উচ্চবর্ণের হিন্দুদের জমিতে তাঁরা লাঙল চালাবেন না, ধান কাটা, গৃহস্থালির কাজও করবেন না। স্বল্পকালের জন্য হলেও এই আন্দোলন ভূস্বামী-জমিদারদের অসহায়তার মুখে ঠেলে দেয়।
দলিতদের বাড়িতে গিয়ে বিজেপি নেতারা তাঁদের সঙ্গে বসে ভোজন সারছেন, টিভির পর্দায় আমরা তা দেখছি। কিন্তু উচ্চবর্ণের হিন্দু ও দলিতদের সামাজিক বৈষম্য ঘুচল কোথায়? উলটে ১৮৭২ সালে ফরিদপুরের আন্দোলনই বা হচ্ছে কোথায়?
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.