প্রধানমন্ত্রী যখন কর্ণাটকের নির্বাচনের প্রচার চলাকালীন বলেন ‘দ্য কেরালা স্টোরি’ সবার দেখা উচিত, যখন বেশ কিছু বিজেপি-শাসিত রাজ্যে, এই সিনেমাটিকে কর-মুক্ত ঘোষণা করা হয়, তখন এই ছবিটি আর ‘শিল্পকর্ম’ থাকে না, হয়ে ওঠে প্রচারের হাতিয়ার। কলমে সুমন সেনগুপ্ত
মুক্তির আগে থেকেই বিতর্ক দানা বেঁধেছিল বাঙালি পরিচালক সুদীপ্ত সেন নির্মিত ‘দ্য কেরালা স্টোরি’ সিনেমা ঘিরে। প্রাথমিকভাবে এই সিনেমাটিকে যেভাবে প্রচারের আলোয় আনা হয়, তা নিয়ে বিতর্কের সূত্রপাত। বলা হয়, কেরল থেকে প্রচুর কমবয়সি মহিলা ইসলামি মৌলবাদী সংগঠনে যুক্ত হচ্ছেন। বলা হয়, সেই সংখ্যাটা প্রায় ৩২ হাজার। আরও বলা হয়, কমবয়সি মহিলাদের এই মৌলবাদী সংগঠনে যুক্ত করার জন্য কেরলে নাকি একটি চক্র সক্রিয়, যাঁদের কাজ-ই হচ্ছে হিন্দু মহিলাদের ভুল বুঝিয়ে, বিভ্রান্ত করে, এই কাজে সামিল করানো। কেরল সরকারের তরফে দেশের সর্বোচ্চ আদালতে প্রাথমিকভাবে এই বিষয়ে আপত্তি জানানো হয়, তখন প্রযোজক এবং পরিচালকের তরফে বলা হয়, যে, এই সাধারণীকরণ ভুল হয়েছে, এই সংখ্যাটা ৩২ হাজার নয়, সংখ্যাটা মাত্র তিন। কিন্তু ততদিনে যা প্রচার হওয়ার হয়ে গিয়েছে!
সামাজিক মাধ্যমের রমরমার যুগে এই ধরনের একটি ভুল তথ্য যে কতটা ভয়ংকর হতে পারে, তা আমরা জানি। আর, প্রধানমন্ত্রী যখন কর্নাটকের নির্বাচনের প্রচার চলাকালীন বলেন ‘দ্য কেরালা স্টোরি’ সবার দেখা উচিত, যখন বেশ কিছু বিজেপি-শাসিত রাজ্যে, এই সিনেমাটিকে কর-মুক্ত ঘোষণা করা হয়, তখন এই ছবিটি আর ‘শিল্পকর্ম’ থাকে না, হয়ে ওঠে প্রচারের হাতিয়ার। তিন মহিলার গল্প কখন যেন একটা সাধারণ ধারণা গঠন করতে সাহায্য করে। সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে যদি কোনও একটি অর্ধসত্য ও মিথ্যে-মেশানো তথ্যে পরিপূর্ণ সিনেমা বাজারে আসে, তাহলে কি সেই ঘৃণাকুণ্ডে আরও ঘৃতাহুতি পড়ে না?
বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এই সিনেমাকে ‘নিষিদ্ধ’ ঘোষণা করেছেন, পরিচালক বলেছেন, মুখ্যমন্ত্রী ছবিটি না-দেখে এমন সিদ্ধান্ত না নিলেই পারতেন। প্রযোজক এবং পরিচালক, মুখ্যমন্ত্রীর এই প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন, যদিও এই বিষয়ে মতামত দেবে কলকাতা হাই কোর্ট। তাই নতুন করে আবার মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। তা অবশ্যই ভাল দিক, এমনিতেই দেশে এই মুহূর্তে বাক্-স্বাধীনতার হাল খুব একটা ভাল নয়। দেশের সর্বোচ্চ আদালত এই বিষয়ে নানা সময়ে উষ্মা প্রকাশ করেছে। তবে দুঃখের বিষয় হচ্ছে, শিল্পীর স্বাধীনতা বা বাক্-স্বাধীনতা নিয়ে এখন যাঁরা সবচেয়ে বেশি সোচ্চার, তাঁরাই কিন্তু কিছুদিন আগে, ‘বিবিসি’-র একটি তথ্যচিত্র সামাজিক মাধ্যম থেকে নামিয়ে দেওয়ার পক্ষে সওয়াল করেছিলেন। সেখানে যা দেখানো হয়েছিল, তার মধ্যে ভুয়া তথ্য পরিবেশন করা হয়নি, তবুও যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে সেই তথ্যচিত্রটিকে চালাতে দেওয়া হয়নি, কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে।
যাঁরা বলছেন, মুখ্যমন্ত্রী ‘নিষিদ্ধ’ না করলেও পারতেন, এর ফলে ছবিটি আরও প্রচার পেয়ে গেল, তাঁরা হয়তো কিছু অংশে ঠিক, কিন্তু তা সত্ত্বেও আরও কিছু কথা বলা উচিত। বিশিষ্ট অভিনেত্রী শাবানা আজমি বলেছেন, একবার যখন সেন্সর বোর্ড এই ছবিটির মুক্তি নিয়ে ‘সবুজ সংকেত’ দিয়েছে, তখন সাংবিধানিকভাবে এই ছবিটিকে আটকানো যায় না। এই কথাটাও মনে ধরেছে দক্ষিণপন্থী বিজেপি নেতাদের। তাই তাঁরাও শাবানা আজমির বক্তব্য সম্বল করে বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছেন। সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন, সমাজের আরও বেশ কিছু উদারমনস্ক মানুষ।
সাধারণত যে কোনও ছবি বা পুস্তক বা যে কোনও শিল্প ‘নিষিদ্ধ’ করার বিরোধিতা আমরা করলেও এই ধরনের একটি ফিল্ম, যা বানানোই হয়েছে একটি বিশেষ সম্প্রদায়কে ছোট করার উদ্দেশ্যে, সেটির প্রেক্ষাপট না বুঝলে ভারতের বর্তমান শাসক দলের চরিত্র বোঝা সম্ভব নয়। কেন দেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে বিজেপির তাবৎ নেতা-মন্ত্রী এই সিনেমা নিজেরা দেখছেন এবং মানুষকে দেখতে উৎসাহিত করছেন? কেন বিভিন্ন রাজ্য এই ছবিটিকে কর-মুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে? যে ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানোর কাজ গণমাধ্যম বা আলোচনা সভার মধ্যবর্তিতায় সম্পন্ন করা যায় না, তা যদি একটি শিল্পকর্মের আদলে, সিনেমা বানিয়ে করা যায়, তাহলে অনেক বেশি প্রভাব বিস্তার করানো যায়। কিছুদিন আগে আরও একটি সিনেমার ক্ষেত্রেও সেই চেষ্টা হয়েছিল- ‘দ্য কাশ্মীর ফাইল্স’। সেখানে দেখানো হয়েছিল, কীভাবে কাশ্মীরের মুসলমানদের হাতে নিগৃহীত হয়ে, কাশ্মীর উপত্যকা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন সেখানকার হিন্দু পণ্ডিতরা। যদিও সিনেমাটি ‘নিষিদ্ধ’ হয়নি।
অনেকে বলছেন, যদি এই সিনেমাটিকে উপেক্ষা করা যেত, তাহলে এই সিনেমা নিয়ে বেশি ‘প্রচার’ হত না। কিন্তু তথ্য কী বলছে? এই রাজ্যে ‘নিষিদ্ধ’ হলেও দেশের অন্যান্য রাজ্যে এই সিনেমা দেখিয়ে বিপুল লাভ করেছেন প্রযোজক। আসলে শেষ বিচারে এই ধরনের কোনও ছবি নির্মিত করলে একদিকে ঘৃণা ও বিদ্বেষ যেমন বৃদ্ধি পায়; অন্যদিকে লক্ষ্মীলাভও হয় প্রযোজক এবং পরিচালকের।
অধিকার রক্ষা আন্দোলনের কর্মীরা এবং বেশ কিছু উদারমনা মানুষ বলছেন, একটি নিষিদ্ধকরণ আরও একটি নিষিদ্ধকরণের জমি তৈরি করে। নিষিদ্ধকরণ আসলে মতপ্রকাশের অধিকারকে খর্ব করে। তবে এটাও ভেবে দেখার প্রয়োজন, মতপ্রকাশের অধিকার যদি হয় রবীন্দ্রজয়ন্তী বা নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোসের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি দেওয়া, তাহলেও কি তা সমর্থনযোগ্য? জানি, তর্কের খাতিরে হয়তো অনেকে সেটাকেও সমর্থন করে বসবেন, কিন্তু বিষয়টা কি এতটাই সরল? যদি নজর দেওয়া যায়, তাহলে দেখা যাবে, বিভিন্ন রাজ্যে যেখানে এই সিনেমা প্রদর্শিত হচ্ছে, সেখানকার প্রেক্ষাগৃহে সিনেমা চলাকালীনও ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি উঠেছে। অর্থাৎ মেরুকরণের বার্তা সুস্পষ্ট।
ভারতের সেন্সরশিপ আইন ১৯১৮ সালের ব্রিটিশ সেন্সরশিপ আইনের আদলে তৈরি। এখনও এই আইনের মূল বিতর্ক আবর্তিত হয় যৌনতা এবং হিংসার মাপকাঠি দিয়ে, যা নিতান্ত হাস্যকর। কিন্তু যেসব দেশে এই সেন্সরশিপ ইত্যাদি নেই বললেই চলে, সেখানেও কি মতপ্রকাশের অধিকারের নামে একটি জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে শিল্পের নামে মিথ্যে-সমৃদ্ধ ন্যারেটিভ পরিবেশন করা হয়? সেন্সরশিপের বিরোধিতা আমাদের করা উচিত যে-যুক্তিতে, সেই একই যুক্তিতে ঘৃণা-ভাষণেরও বিরোধিতা করা জরুরি।
(মতামত নিজস্ব)
[email protected]
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.