সময় কি পিছিয়ে দেওয়া যায়? এই প্রশ্ন যতখানি প্রাসঙ্গিক, ততখানিই গুরুত্বপূর্ণ জম্মু-কাশ্মীরের ‘বিশেষ মর্যাদা’ কেড়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত সংবিধানসম্মত কি না, সেই মামলার নিষ্পত্তি। অপেক্ষা যদি অপরিহার্য, তাহলে সিদ্ধান্ত রূপায়ণে বিরত থাকার নির্দেশ কেন দেওয়া হল না গত চার বছর, যেখানে এক রাজ্যের ভাল-মন্দ, ভবিষ্যতের প্রশ্ন জড়িয়েছিল! কলমে সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়
ঠিক চার বছর পর মীমাংসা হতে চলেছে সেই মামলার, যা ঠিক করে দেবে, জম্মু-কাশ্মীরের ‘বিশেষ মর্যাদা’ কেড়ে নেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্ত সংবিধানসম্মত ছিল কি না। এই সময় ঝিলম দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। বদলে গিয়েছে ভূস্বর্গের রাজনীতি, প্রশাসন, সরকারি মানসিকতা, দৈনন্দিন জীবনযাপন ও নিরাপত্তা চেতনা। আগামী দিনের জীবন হয়তো আরও বদলাবে। এই সন্ধিক্ষণে যদি প্রতিপন্ন হয় সরকারি সিদ্ধান্তগুলি সংবিধানসম্মত ছিল না, ঘড়ির কাঁটা কি তাহলে পিছিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে?
প্রশ্ন জাগছে, কারণ, তিন বছর আগে এই মামলার শুনানির সময় সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি এন. ভি. রমানা একবার আবেদনকারীর উদ্দেশে বলেছিলেন, সব পক্ষকে শোনার পর ঘড়ির কাঁটা পিছিয়ে দেওয়া যেতে পারে, কিন্তু সরকারের অভিমত না-শুনে রাজ্য দ্বিখণ্ডিকরণের প্রক্রিয়া রূপায়ণ স্থগিত রাখার নির্দেশ তিনি দিতে পারবেন না।
ঘড়ির কাঁটা কি সত্যিই পিছিয়ে দেওয়া যায়? এই প্রশ্ন যতটা প্রাসঙ্গিক, ততটাই গুরুত্বপূর্ণ এমন গুরুতর সাংবিধানিক মামলা নিষ্পত্তির তাগিদ কেন চার বছর পর অনুভূত? অপেক্ষা যদি অপরিহার্য, তাহলে সিদ্ধান্ত রূপায়ণে বিরত থাকার নির্দেশ কেন দেওয়া হল না? বিশেষত যেখানে একটা রাজ্যবাসীর ভাল-মন্দ ও ভবিষ্যতের প্রশ্ন জড়িয়ে?
জম্মু-কাশ্মীরের ‘বিশেষ মর্যাদা’ প্রত্যাহৃত হয়েছিল ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট। তার চারদিন পর ৯ আগস্ট, রাজ্য দ্বিখণ্ডিত হয়। তৈরি হয় দু’টি পৃথক কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল। একটি বিধানসভা-সহ জম্মু-কাশ্মীর। অন্যটি বিধানসভা-হীন লাদাখ। স্বাধীনতার পর যে-প্রয়োজনীয়তা কেউ অনুভব করেনি, যে-সাহসও কেউ দেখাতে পারেনি, নরেন্দ্র মোদির সরকার তা করে দেখায়। সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ খারিজ ও রাজ্য ভাগ- মোদি সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত।
ওই সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর-পরই সুপ্রিম কোর্টে দাখিল হয় একের পর এক মামলা। প্রতিটিই সাংবিধানিক বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে। মামলাগুলি দাখিলের সময় প্রধান বিচারপতি ছিলেন রঞ্জন গগৈ। অযোধ্যা মামলা শুনানির সাংবিধানিক বেঞ্চ নিয়ে তখন তিনি ব্যস্ত। তাই বিচারপতি এন. ভি. রমানার নেতৃত্বে গঠিত হয় পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ, এই মামলা শোনার জন্য। ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে মোট ছ’দিন শুনানি চলে মামলাটি বৃহত্তর বেঞ্চে পাঠানো হবে কি না, এই বিবেচনায়।
২০২০ সালের ২৩ জানুয়ারি শুনানি-শেষে বেঞ্চ রায় স্থগিত রাখে। দু’-মাস পর জানায় বৃহত্তর বেঞ্চের কোনও প্রয়োজন নেই। সে বছরেই জুলাই মাসে বিচারপতি রমানা কেন্দ্রীয় উদ্যোগে স্থগিতাদেশ না দিয়ে বলেছিলেন, প্রয়োজনে ঘড়ির কাঁটা পিছিয়ে দেওয়া যাবে।
রঞ্জন গগৈয়ের পর টানা এক বছর পাঁচ মাস প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালন করেন শরদ অরবিন্দ বোবদে। ২০২১ সালের এপ্রিল মাসে প্রধান বিচারপতি হন এন. ভি. রমানা। তারপর সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য প্রধান বিচারপতি হয়েছিলেন উদয় উমেশ ললিত। তারপর ডি. ওয়াই. চন্দ্রচূড়। এতকাল ধরে এই মামলা ‘ন যযৌ ন তস্থৌ’।
২ আগস্ট থেকে টানা শুনানিতে বিবাদের মীমাংসা করবেন বলে প্রধান বিচারপতি জানিয়েছেন। নতুন বেঞ্চের নেতৃত্বেও তিনিই। বাকি চার বিচারপতি এস. কে. কৌল, সঞ্জীব খান্না, বি. আর. গাভাই ও সূর্যকান্ত। বিচার্য বিষয় তিনটি- প্রথমত, ৩৭০ অনুচ্ছেদ রদ সংবিধানসম্মতভাবে হয়েছে কি না। দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রপতি শাসন চলাকালীন জম্মু-কাশ্মীরের জনগণের সম্মতি ছাড়া ৩৭০ অনুচ্ছেদ খারিজ সে রাজ্যের জনগণের মৌলিক অধিকার (সংবিধানের ১৪ ও ২১ অনুচ্ছেদ) হরণ করেছে কি না। তৃতীয়ত, ২০১৯ সালে তৈরি জম্মু-কাশ্মীর পুনর্গঠন আইন সংবিধান লঙ্ঘন করেছে কি না।
সুপ্রিম কোর্টের প্রথম বিবেচনা কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তটি ‘ডকট্রিন অফ কালারেবিলিটি’ লঙ্ঘন করছে কি না। এই ‘ডকট্রিন’ বা তত্ত্ব অনুযায়ী, আইনত যা সরাসরি করা যায় না, সেই কাজ ঘুরিয়ে বা পরোক্ষভাবে করাও নিষিদ্ধ। যেমন, সংবিধান বলেছে, ৩৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করতে হলে জম্মু-কাশ্মীরের ‘কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলি’-র অনুমোদন জরুরি। এক্ষেত্রে সেটা করা হল ভিন্ন উপায়ে। এদিকে জম্মু-কাশ্মীরের ‘কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলি’ ১৯৫৭ সালেই ভেঙে দেওয়া হয়েছে। সেখানে তার অস্তিত্বই নেই! কেন্দ্রীয় সরকার তাই সেই দায়িত্ব অর্পণ করল রাজ্য বিধানসভাকে। কিন্তু বিধানসভাও ভেঙে দেওয়া হয়েছে। জারি ছিল রাষ্ট্রপতি শাসন। দেশের সংবিধানকে জম্মু-কাশ্মীরেও প্রয়োগের জন্য রাষ্ট্রপতিকে তাই সুপারিশ করল রাজ্যসভা। রাজ্য দ্বিখণ্ডীকরণ নিয়ে মামলায় বলা হয়েছে, জম্মু-কাশ্মীরকে রাজ্য ভেঙে দু’টি পৃথক কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করার সিদ্ধান্ত সংবিধানের তৃতীয় অনুচ্ছেদের পরিপন্থী। সেই অনুচ্ছেদে বলা আছে, সংসদ নতুন রাজ্য সৃষ্টি করতে পারে। রাজ্যের সীমানা বাড়াতে-কমাতে পারে। রাজ্যের নাম বদল করতে পারে। কিন্তু কোনও রাজ্যকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করতে পারে না।
এই সেদিন মামলা যখন নতুন সাংবিধানিক বেঞ্চে উঠল, এবং প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড় জানালেন ২ আগস্ট থেকে লাগাতার শুনানি শুরু হবে, তার ঠিক আগের দিন কেন্দ্রীয় সরকারের পেশ করা এক অনাবশ্যক হলফনামা চোখ টানল। হলফনামার পরতে পরতে উপত্যকায় অপার শান্তি ও রামরাজ্য কায়েমের একের পর এক নজির। কীভাবে উপদ্রুত উপত্যকা আজ শান্তির নিকেতন, মানুষের মনে আনন্দ, চিত্ত ভয়শূন্য, রাজনীতি কালিমামুক্ত, তিন দশকের নিকষ কালো অন্ধকার দূর হয়ে ভবিষ্যতের আলোকবর্তিকা ঝিকমিক করছে তা বর্ণনা করে বলা হয়, এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আবেদনকারীদের দাবি গ্রাহ্য হলে তা শুধু জম্মু-কাশ্মীর ও লাদাখের জনগণের স্বার্থ-বিরোধীই হবে না, দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের পক্ষেও বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়াবে। সহজ কথায়, সুপ্রিম কোর্টকে সরকার সমঝে দিতে চেয়েছে, যা করা হয়েছে, তা যেন অপরিবর্তিত থাকে।
এখানেও সেই রাষ্ট্রীয় স্বার্থ, জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জিগির। এই অজুহাত দেখিয়ে সরকার রাফাল মামলায় সিল বন্ধ খামে সুপ্রিম কোর্টে তথ্য পেশ করেছিল। পেগাসাস মামলায় সহযোগিতা করেনি। গালওয়ানে সাংসদদের নিয়ে যাওয়ার দাবি মানেনি। চিনা আগ্রাসন নিয়ে সংসদে আলোচনাতেও নারাজ। জাতীয় নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে মালয়ালি নিউজ চ্যানেল ‘মিডিয়া ওয়ান’ বন্ধ রাখার কারণও সরকার সিল করা খামে সুপ্রিম কোর্টে জমা দিতে চেয়েছিল। ভর্ৎসিতও হয়েছিল। প্রধান বিচারপতি বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, সবকিছুতে জাতীয় নিরাপত্তার দোহাই খাটে না। এবার কী করবে সুপ্রিম কোর্ট?
এত গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের সাংবিধানিক বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আনা মামলাগুলো চার বছর ধরে কেন অমীমাংসিত থাকে? আরও সংগত প্রশ্ন, সুপ্রিম কোর্ট যখন সিদ্ধান্ত রূপায়ণে স্থগিতাদেশ দেয়নি, তখন কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত অসাংবিধানিক প্রতিপন্ন হলে চারবছর ধরে করা পরিবর্তনগুলো কি আগের অবস্থায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব? ঘড়ির কঁাটা কি সত্যিই পিছিয়ে দেওয়া যায়?
‘সবার উপরে’ সিনেমায় নির্দোষ প্রশান্ত চাটুজ্জের (ছবি বিশ্বাস) আকুল আকুতি মেনে জজসাহেব কি তাঁকে ফিরিয়ে দিতে পেরেছিলেন জেল-কুঠুরিতে কাটিয়ে দেওয়া ১২টা বছর?
অত দূরের কাহিনি-ই বা কেন? এই তো হালে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরের চাকরির মেয়াদ বৃদ্ধির সিদ্ধান্তকে সুপ্রিম কোর্ট বেআইনি বলেছে। যাঁর বর্ধিত মেয়াদ বেআইনি, সেই মেয়াদে তাঁর গৃহীত সিদ্ধান্তগুলোও তাহলে বেআইনি? কিন্তু কী করল সর্বোচ্চ আদালত? ঘড়ির কাঁটা পিছনো তো দূরের কথা, চলতি মাসের শেষ তারিখ পর্যন্ত তাঁকে কাজে বহাল রাখল! কেন তৎক্ষণাৎ বিদায় করা হল না? এ তো অন্য আমলাদের কর্মদক্ষতার প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন? জম্মু-কাশ্মীর নিয়েও সুপ্রিম কোর্ট নিজেকে বিতর্ক-বলয়ে টেনে এনেছে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.