ফাইল ছবি
রক্তে-ভেজা কাশ্মীরের জটিল ইতিহাসকে প্রাসঙ্গিক প্রেক্ষাপট এবং দৃষ্টিভঙ্গি না দিয়ে একতরফা রাজনৈতিক নাটকে পরিণত করা যেতে পারে না! গত তিন দশকে, কংগ্রেস, বিজেপি এবং তৃতীয় ফ্রন্ট সরকার প্রত্যেকেই কেন্দ্রে ক্ষমতায় এসেছে, কিন্তু কাশ্মীরি পণ্ডিত পরিবারগুলোকে পুনর্বাসন দিতে বা প্রকৃতপক্ষে পরিবারের মৃত আত্মীয়দের খুনিদের বিচারের অধীনে আনতে পেরেছে কেউ? লিখছেন রাজদীপ সরদেশাই
২০০৫ সাল। ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ তখন কোথায়? মুক্তি পেল ‘পারজানিয়া’। ২০০২-এর গুজরাট দাঙ্গায় এক পারসি পরিবারের সন্তান হারানোর রক্তাক্ত স্মৃতি সিনেমার মধ্য দিয়ে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিচ্ছে। আহমেদাবাদে ছবিটি মুক্তি পাওয়ার ঠিক আগে, পরিচালক রাহুল ঢোলাকিয়াকে ‘মাল্টিপ্লেক্স থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশন’ তলব করল এবং সরাসরি জানিয়ে দিল যে, স্থানীয় বজরং দলের নেতা বাবু বজরঙ্গি ‘অনুমতি’ দিলে তবেই জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত ছবিটি দেখানো যাবে! বলে রাখি, ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গায় জড়িত হত্যাকারী খুনে-জনতাকে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত ছিল কুখ্যাত এই বজরঙ্গি। গুজরাটের তৎকালীন সরকার এই ঝামেলায় হস্তক্ষেপ তো করলই না, মুখ অবধি ঘুরিয়ে নিল। ফলে, সিনেমাটি প্রত্যাহার করে নেওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় রইল না ঢোলাকিয়ার। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, যিনি এখন ‘সত্য’ উদ্ঘাটনের জন্য ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’-এর ভূয়সী প্রশংসা করছেন এবং তাঁর দলের সাংসদদের ছবিটি দেখতে উত্সাহিত করছেন এবং আহ্বান জানাচ্ছেন, সেই তিনিই ছিলেন গুজরাটের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী।
কিন্তু অপরিবর্তনীয় ‘সত্য’ এটাই যে, নেতৃত্বগণ এবং তাঁদের পক্ষপাতদুষ্ট স্তাবক দল দলীয় সীমারেখা অতিক্রম করে ইতিহাসের অসুবিধাজনক তেতো সত্যের মুখোমুখি হতে চায় না। পরখ করে নিতে ১৯৮৪ সালের শিখ-বিরোধী গণহত্যার উপর একটি সিনেমা তৈরি করুন এবং হাতেনাতে দেখতে পাবেন, কংগ্রেসের তরফে আপত্তির ঝড় ধেয়ে আসবে। রাজনৈতিক হিংস্রতা তুলে ধরে, এমন একটি ‘বেঙ্গল ফাইলস’ বানানো হোক, সিনেমাটি বঙ্গে প্রদর্শিত হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। কান্নুর রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড নিয়ে ‘কেরালা ফাইলস’ বানানো হোক না, প্রায় নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, সেখানের বামফ্রন্ট সরকার আটকে দেবে। এবং ২০০২ সালের গুজরাত গণহত্যা নিয়ে ‘গুজরাট ফাইলস’ তো বিজেপি শাসিত রাজনৈতিক বিশ্বে কস্মিনকালেও দিনের আলো দেখতে পাবে না। এ-দেশের সিনেমার ইতিহাস সিনেমার সেন্সর এবং নিষিদ্ধ হওয়ার ঘটনায় ছেয়ে আছে। আর শৈল্পিক স্বাধীনতার সীমারেখা সেখানে ক্ষমতাসীনের হাতে নিয়ন্ত্রিত।
‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ একটি বিরল দৃষ্টান্ত, যেখানে একটি ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল বেসরকারিভাবে নির্মিত একটি চলচ্চিত্রকে সক্রিয়ভাবে প্রচার করার জন্য অবিচ্ছিন্ন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা প্রয়োগ করছে! বিনোদন করে ছাড় থেকে শুরু করে ভরতুকি মূল্যে থিয়েটার বুকিং, এমনকী, সরকারি কর্মীদের চলচ্চিত্রটি দেখার জন্য একটি দিন ছুটি পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে! সাম্প্রতিক সময়ে এর আগে কখনওই কোনও রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং তার সহযোগী গোষ্ঠীগুলি এমন নির্লজ্জভাবে বাণিজ্যিক সিনেমাকে জনসাধারণের সংহতির জন্য এমনভাবে ব্যবহার করেনি। দেখা যাবে, এখানে রাষ্ট্রীয় প্রচার এবং সিনেম্যাটিক ভাষ্যের মধ্যেকার বিভেদরেখা সম্পূর্ণ আবছা হয়ে মিশে গিয়েছে।
‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ নিয়ে রাষ্ট্রের প্রকট পৃষ্ঠপোষণ যদিও অবাক করার মতো নয়। কারণ, আসলে সিনেমাটির মূল কাহিনিটি যে দেশের প্রভাবশালী সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক মতাদর্শের সঙ্গে সুন্দরভাবে খাপ খেয়ে যায়। যে-মতাদর্শ, দেশের সীমান্তের ভিতরে বা বাইরে, মুসলিমদের প্রধান ‘শত্রু’ রূপে খাড়া করে। ১৯৮৯-’৯০ সালের হত্যাকাণ্ড এবং কাশ্মীরি পণ্ডিতদের নিজস্ব বাস্তুত্যাগের ভয়াবহতায় ‘বর্বর’ ইসলাম ধর্ম বনাম ‘শান্তিপ্রিয়’ হিন্দুধর্মর আখ্যান এমনভাবেই গড়ে তোলা সেখানে, যাতে মনে হবে সবটাই কঠোর এবং বাস্তব। কিন্তু বাস্তবটা হল, সেই বছরের ভয়াবহ শীতে কাশ্মীরের সহিংসতা দেখেছিল, আসলে পাকিস্তান-স্পনসর্ড কিছু জঙ্গিগোষ্ঠীর দ্বারা কাশ্মীরি হিন্দুদের হত্যা করা হচ্ছে। ‘নতুন’ ভারতের প্রেক্ষাপটে সেই চিত্রগুলিকে পুনরুজ্জীবিত করে কেবলমাত্র প্রচলিত ‘ইসলামোফোবিক’ ঘৃণার রাজনীতিকেই উসকে দেবে, যা ইতিমধ্যে আমাদের সমাজকে গ্রাস করেছে।
অনেক কাশ্মীরি হিন্দু পরিবারের কাছেই এই সিনেমা ক্যাথারসিস ঘটাবে, যন্ত্রণা দেবে- এটাই দস্তুর। বাড়ি থেকে উৎখাত করা হয়েছিল তাঁদের। এবং আক্ষরিক অর্থেই উদ্বাস্তু শিবিরে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল। তাঁদের সেই যন্ত্রণাদায়ক জীবনের আখ্যান ব্যাপক দর্শকের কাছে বলার সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে এই সিনেমা। কিন্তু এত কিছু সত্ত্বেও, জাতীয় মূলধারা থেকে কাশ্মীরি মুসলমানের ‘বিচ্ছিন্নতার’ দিকে মনোনিবেশ করার সময়, কাশ্মীরি হিন্দুদের নিপীড়নের দিকে অবশ্যই কম মনোযোগ দেওয়া হয়েছে। অথচ, এই সংক্রান্ত অজস্র প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ রেকর্ড করা হয়েছে এবং তা প্রকাশিতও হয়েছে। তাই কাশ্মীরি পণ্ডিত পরিবারগুলোর এই দুঃখের অধিকার রয়েছে যে, তাঁদের দুর্দশা কখনওই কোনও বাম-উদারপন্থী বুদ্ধিজীবী পুরোপুরি স্বীকার করেননি।
কিন্তু একটি সিনেমা যদি আধারিত ঘটনার ভুক্তভোগীদের কাছে মানসিকভাবে শান্তিদায়কও হয়, তবুও এটা কি সত্যিকারের পরিবর্তন, ন্যায়বিচারের ধারণা এবং অবশেষে শান্তি এনে দিতে পারে? ঠিক এখানেই রক্তে-ভেজা কাশ্মীরের জটিল ইতিহাসকে প্রাসঙ্গিক প্রেক্ষাপট এবং দৃষ্টিভঙ্গি না দিয়ে একতরফা রাজনৈতিক নাটকে পরিণত করা যেতে পারে না। যেমন, কাশ্মীরের হিমশীতল অশান্তির অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দিকও কোনওরকম উল্লেখ ছাড়াই কীভাবে একজন কাশ্মীরি পণ্ডিতের সাকিন-ত্যাগের আপাত স্মৃতিভ্রষ্টতাকে সংশোধন করে দেবে? তা সে দিল্লি-শ্রীনগর রাজনৈতিক চক্রান্ত হোক, বা সেবারের নির্বাচনের কারচুপি। রাজ্যের প্রশাসনিক বর্বরতা হোক বা বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসনের ঐতিহাসিক দাবি বা প্রকৃতপক্ষে ‘আজাদি’-র দাবি। এগুলোকে কি নস্যাৎ করা সম্ভব?
গত তিন দশকে কংগ্রেস, বিজেপি এবং তৃতীয় ফ্রন্ট সরকার প্রতে্যকেই কেন্দ্রে ক্ষমতায় এসেছে, কিন্তু কাশ্মীরি পণ্ডিত পরিবারগুলোকে পুনর্বাসন দিতে বা প্রকৃতপক্ষে পরিবারের মৃত আত্মীয়দের খুনিদের বিচারের অধীনে আনতে ব্যর্থ হয়েছে। আমাদের ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার কথাই ভাবুন। কাশ্মীরি ‘আজাদি’-র প্রধান মুখগুলোর একজন, ইয়াসিন মালিককে ১৯৯০-এর সন্ত্রাসী হামলায় ভারতীয় বিমান বাহিনীর চার কর্মকর্তাকে হত্যার জন্য এই ২০২০ সালের শেষের দিকে কিনা অভিযুক্ত করা হল! সেই সময়ে দিল্লিতে পরের পর সরকারগুলোর কথাই ভাবুন- বিজেপি আর কংগ্রেস। ইয়াসিন মালিক তখন জেল থেকে বেরচ্ছেন, আবার জেলে ঢুকছেন। আবার বেরিয়ে আসছেন। আর কাশ্মীর নিয়ে বক্তব্যে তিনি হয়ে উঠছেন অন্যতম বক্তা, সিদ্ধান্ত নেওয়ার নিরূপক।
আর ঠিক এই কারণেই, একজন নির্লজ্জ বিজেপি সমর্থক ‘জঙ্গি মানেই মুসলিম’ এই আখ্যানের উপর ভিত্তি করে বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে তৈরি করা ফেলেন গোদা একটি সিনেমা। সেখানে ভূরি-ভূরি ও বিপজ্জনক অর্ধসত্য। কিন্তু সন্ত্রাসের শিকার নিরীহ মানুষগুলোকে ন্যায়বিচার দেওয়া বা কাশ্মীর সংক্রান্ত দীর্ঘকালীন অস্বস্তির নিরসন ঘটানোয় কোনও ভূমিকা বা প্রয়াস থাকে না তাঁর। এবং এর মধ্য দিয়ে বেমালুম ভারতীয় রাষ্ট্রযন্ত্রের ব্যর্থতা ঢেকে ফেলা যায়। তার চেয়েও বড় কথা, এই ন্যায়প্রদান তো শুধুমাত্র কাশ্মীরি পণ্ডিতদের উদ্দেশে হলে ন্যায় থাকবে না। ন্যায় তখনই সম্পূর্ণ হয় যখন, তা প্রদান করা হবে সেই হাজার হাজার কাশ্মীরি মুসলিমকেও, যাঁরা এই জঙ্গি ও হিংস্রতার আবহে প্রাণ হারিয়েছেন।
দুর্ভাগ্যবশত, ১৯৯০-এর পরবর্তী প্রজন্ম- বর্তমানে এই দেশের প্রায় অর্ধেক নাগরিকই জন্মগ্রহণ করেছে এই যুগান্তকারী বছরের পরে। এই নাগরিক গোষ্ঠীর কাছে মেরুকরণের ব্যাপারে ঐতিহাসিক নির্ভুলতা অন্বেষণের সময় নেই। মনে রাখতে হবে, ১৯৯০-এর আগের সময়টা ছিল প্রাক্-২৪×৭ নিউজ টিভির যুগ। সে ছিল ঢিমেতালের ভারত, যে কিনা প্রতিদিনের ব্রেকিং নিউজের শ্বাস-প্রশ্বাসের চক্রে আটকা পড়েনি। আর আজকের ভারত চলে প্রতিদ্বন্দ্বিতাময় প্রচারে, উত্তর-সত্যের মারপ্যাঁচে এবং উগ্র জাতীয়তাবাদের পাঁচনে। এ এক ‘নব্য’ ভারত, যেখানে ‘ফ্যাক্ট’ তথা সৎ তথ্যের হদিশ মেলে হোয়াটসঅ্যাপ ফরওয়ার্ডে, সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সারদের বয়ানে এবং ৬০ সেকেন্ডের ভাইরাল ভিডিওয়। এ এক অদ্ভুত ‘নূতন’ ভারত, যেখানে গান্ধীর লেখার চেয়ে গডসে-কে নিয়ে সিনেমা অনেক বেশি মনোযোগ আকর্ষণ করে। ইসলামি চরমপন্থার উচ্চকিত জোয়ার এবং ‘হিন্দু জাগরণ’-এর মাঝে গোত্তা খেয়ে একটা গোটা প্রজন্ম যেন ‘অপর’ করার ভাবনাতেই মগ্ন, এবং অপর-কে ভয় এবং ঘৃণার চোখে দেখতেই অভ্যস্ত। সমবেদনা এবং সম্প্রীতির কোনও প্রয়াস তাদের নেই। উদাহরণ স্বরূপ, ধরা যাক, কেউ কাশ্মীরি মুসলিম এবং কাশ্মীরি পণ্ডিতদের একত্র হয়ে সময়টাকে সামলে ওঠার প্রয়াসগুলো, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের সেই ঘটনাগুলো নিয়ে রীতিমতো তথ্যসমৃদ্ধ সিনেমা বানাতে গেল। এবার, সিনেমার পরিচালককে ‘দেশদ্রোহী’ তকমা না দিয়ে ছাড়া হবে তো? ভগ্ন অতীতের ক্ষত সারানোর আগে সত্যকথক আয়নাটি দিয়ে ভাল, খারাপ এবং কুৎসিত- সবদিকই নিখুঁতভাবে দেখতে হবেই।
পুনশ্চ কয়েক বছর আগে, সুপারহিট ফিল্ম ‘বজরঙ্গি ভাইজান’ ভারত-পাকিস্তানের বন্ধুত্ব ও সহাবস্থানের বার্তা দিয়েছিল। সেই সিনেমার একটা সাড়া-জাগানো লাইন আমার এখনও মনে আছে। ‘নফরত ফয়লানা বহত আসান হ্যায়, প্যায়ার বাটনা মুশকিল’। তরজমা করলে হয়- হিংসা ছড়ানো খুব সহজ কাজ, কিন্তু ভালবাসা ভাগ করে নেওয়াটাই চাপের। ভোটব্যাংকের রাজনীতি করা নেতা-নেত্রী ও পরিচালকদের হাড়ে-হাড়ে চিনে নেওয়ার জন্য এই পঙ্ক্তিটুকুই যথেষ্ট।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.