জালালউদ্দিন, হাত জোড় করে মিনতি করেছিলেন উত্তর দিল্লি পৌরসভার কর্মীদের কাছে। বলেছিলেন, অন্তত খাবার জলের সংযোগটি যেন না ভেঙে দেওয়া হয়, কিন্তু তাঁরা শোনেননি। লিখছেন সুমন সেনগুপ্ত
দিল্লির জাহাঙ্গীরপুরির ঘটনার কথা এখন সবাই জানেন। কীভাবে কোনও আগাম সতর্কবার্তা ছাড়া, ‘অবৈধ’ দখলদারি হিসাবে চিহ্নিত করে, সংখ্যালঘু মানুষদের ঘর-বাড়ি, ব্যবসা তছনছ করে দেওয়া হল। কিন্তু এই ‘অবৈধ’ দখলদার কারা? তাঁরা কি সত্যিই রোহিঙ্গা শরণার্থী? খোঁজ নিয়ে দেখা গিয়েছে, এই উত্তর দিল্লির জাহাঙ্গীরপুরি অঞ্চলের ‘অবৈধ’ বাসিন্দারা আদপে এই বঙ্গের লোক। প্রায় তিরিশ থেকে চল্লিশ বছর আগে তাঁরা দিল্লির জাহাঙ্গীরপুরিতে গিয়ে সাকিন গড়ে তোলেন। ছোটখাটো ব্যবসার মধ্য দিয়ে কষ্ট করে সংসার চালাতেন।
এক সাংবাদিক বন্ধুর সঙ্গে কথা বলে এমন বহু মানুষের কথা জানা গেল। যেমন, জালালউদ্দিন, হাত জোড় করে মিনতি করেছিলেন উত্তর দিল্লি পৌরসভার কর্মীদের কাছে। বলেছিলেন, অন্তত খাবার জলের সংযোগটি যেন না ভেঙে দেওয়া হয়, কিন্তু তাঁরা শোনেননি। জালালউদ্দিন, তিরিশ বছর আগে বাংলা থেকে দিল্লিতে চলে যান পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে। সেখানে তিনি সবজি বিক্রি করেন দীর্ঘদিন ধরে। তিনি দাবি করেছেন, তাঁর সমস্ত ধরনের পরিচয়পত্র আছে ওই জাহাঙ্গীরপুরির ঠিকানায়। তাঁর এখন প্রশ্ন, যদি সরকারি সমস্ত নথিপত্র থাকা সত্ত্বেও তাঁর এই অবস্থা হতে পারে, তাহলে যে মানুষের পরিচয়পত্রে সামান্য গোলমাল আছে, তাঁর কী অবস্থা সরকার করতে পারে? তিনি বিভ্রান্ত, তাঁর অপরাধ কী?
সাংবাদিক বন্ধুটির কাছে অভিযোগ করেছেন আরও অসংখ্য মানুষ। তাঁদের মধ্যে ঠান্ডা পানীয় বিক্রেতা, মোবাইল সারাই করার দোকানি যেমন আছেন; তেমনই আছেন রাজমিস্ত্রি থেকে শুরু করে নানা পেশার মানুষ। সবাই মোটামুটি একটাই কথা বলেছেন, তাঁরা তো এ দেশেই জন্মেছেন, শুধু দিল্লির বদলে অন্য রাজ্যের মানুষ তাঁরা। শুধুমাত্র তাঁরা বাংলায় কথা বলেন বলে, কেন তাঁদের বাংলাদেশি মুসলমান এবং রোহিঙ্গা শরণার্থী বলা হবে? বারংবার অনুরোধ সত্ত্বেও, দেশের সর্বোচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ থাকা সত্ত্বেও, তাঁদের ঘর-বাড়ি, দোকানপাট তছনছ করা হল কেন? পৌরসভার কর্মচারীদের এহেন আচরণের পিছনে কাদের মদত আছে, তাঁরা কি চাইছেন, তাঁদের উদ্দেশ্যই বা কী? কেন বুলডোজার দিয়ে ধ্বংস করা হল এত মানুষের বসতি, আশ্রয়, স্বপ্ন?
কিছুদিন আগে থেকেই এই ‘বুলডোজার’ হয়ে উঠছিল রাষ্ট্রীয় শক্তির পরিচায়ক। উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন জায়গায় ‘অবৈধ’ ব্যবসা থেকে শুরু করে, ঘর-বাড়ি ভাঙার ক্ষেত্রে এই বুলডোজারকেই ব্যবহার করা হয়েছিল। তখনও অভিযোগ ছিল, ধ্বংসলীলা চালানো হয়েছিল যাঁদের ওপর, তাঁরা মূলত গরিব সংখ্যালঘু। পরে এই বুলডোজারের সঙ্গে ছবি দিয়ে সেই রাজ্যের শাসক দলের নেতারা দাবি করেন যে, এই পদ্ধতিতেই আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামলাতে হবে।
কিছুদিন আগে রামনবমীর মিছিল কেন্দ্র করে যখন সেখানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পরিস্থিতি তৈরি হয়, তখন গুজরাট ও মধ্যপ্রদেশে দেখা গেল সেই বুলডোজার ব্যবহার করেই সংখ্যালঘু মানুষদের লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে তাঁদের ঘর-বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া হল। অভিযোগ, গুজরাটের আনন্দ জেলার খাম্বাটে, বেশ কিছু রাস্তার ধারের অস্থায়ী দোকান এবং বাড়ি থেকে রামনবমীর মিছিলে পাথর ছোড়া হয়েছে, এবং সেই দোকানগুলো সব ‘অবৈধ’। অতএব, ভেঙে দেওয়া হোক। যদিও সেসব দোকানের যাঁরা মালিক, তাঁরা দীর্ঘদিন ধরে সেখানকার পুরসভাকে ট্যাক্স দিয়ে আসছেন। তাঁদেরও দাবি, দোকান বৈধ। তবুও কোনও সুযোগ বা আগাম নোটিস না দিয়ে দোকানগুলো ভেঙে ফেলা হল। একইরকম পদ্ধতি নেওয়া হল মধ্যপ্রদেশের খারগোনে এবং রাইসেন জেলাতেও। সেখানেও বলা হল, কিছু সংখ্যালঘু অধ্যুষিত অঞ্চল থেকে রামনবমীর মিছিলে পাথর ছোড়া হয়েছে, অতএব বুলডোজার দাওয়ায়। অথচ কেউ একবার খোঁজও নিল না, ওই অঞ্চলের বেশ কিছু ঘর কিন্তু প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার টাকায় তৈরি।
বিরোধীরা তীব্র অভিযোগ করলেও এই রাজ্যগুলির শাসক কর্তৃপক্ষ জানে, সংখ্যাগরিষ্ঠতার রাজনীতিতে এই প্রক্রিয়াই নির্বাচনে ফায়দা এনে দেবে। সংখ্যালঘুর উপর জোর ফলিয়ে তারা জাহির করতে চায়, ‘অবৈধ’ কিছুই মেনে নেওয়া হবে না, তা সে যতই স্থগিতাদেশ দিক আদালত, বা তা সে যতই আইনবিরোধী হোক। আসলে দিল্লি থেকে মধ্যপ্রদেশে, এই বুলডোজারের মাধ্যমে রাষ্টযন্ত্র একটাই বার্তা দিতে চাইল- সংখ্যালঘু মুসলমানদের সংখ্যাগুরুর ধর্মীয় আস্ফালনের সামনে মাথা নিচু করে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে বাঁচা ছাড়া আর কোনও বিকল্প নেই। অনেকেই যখন এই বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর নীরবতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে, সেই পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের দু’দিনের ভারত সফরে এসে বরোদায় জেসিবি-র বুলডোজার কারখানায় বুলডোজারের সঙ্গে ছবি তোলার ঘটনাটি বিতর্কের আগুন উসকে দিল আরও।
এ যেন বহুবিধ সমর্থন তৈরি করার প্রক্রিয়া। যা দিয়ে তৈরি হয় ‘বিকল্প সত্য’। কখনও ‘গুজরাট মডেল’-কে তুলে ধরা, কখনও প্রবল পরাক্রমী একজন প্রধানমন্ত্রী বলেই প্রতিবেশী দেশের আক্রমণের সমুচিত জবাব দেওয়া গিয়েছে- এই আখ্যান প্রতিষ্ঠা করে দেওয়া, কখনও ধর্মীয় ভাবাবেগ এবং রাজনৈতিক দলকে মিলিয়েমিশিয়ে দেওয়া- এই সমস্ত কিছুর মধ্য দিয়ে আখেরে একজন সাধারণ ভোটারকে প্রভাবিত করা যায় সহজেই। এখনকার দিনে সামাজিক মাধ্যমের দৌলতে সারা বছর ধরে এই বিকল্প সত্যের নির্মাণ ও কারিকুরি চলছে। ফলে, সংখ্যাগরিষ্ঠতার মেজাজ হয়ে উঠছে আরওই পেশিবহুল। এই ঘটনা ও ঘটনার খবর ক্রমশ হয়ে উঠছে ক্ষমতাশালী দলের পেশি-ফোলানোর বিজ্ঞাপন। তার সঙ্গে ভোটকুশলীর কূটচক্র তো রয়েছেই। সংখ্যাগরিষ্ঠকে কেবল উত্তেজিত করা, তার ভাবাবেগ উসকে দেওয়া হয়ে উঠেছে এই বিকল্প সত্যের লক্ষ্য- তাহলেই কেল্লা ফতে। সংখ্যালঘুকে দমন ও সংখ্যাগরিষ্ঠতার রাজনীতি কায়েমের জন্য জন্য কোনও আইন-কানুন নয়, আবেগমণ্ডিত জনাবেগ ও জনরোষই যে যথেষ্ট, তা প্রমাণিত হচ্ছে বারবার।
এমন পরিস্থিতে, আমরা যারা এখনও নিশ্চিন্ত হয়ে আছি, ভাবছি রাষ্ট্রযন্ত্রের শিকার তো আমরা হব না, আমাদের ঘরে আগুন এসে তো পৌঁছবে না, সেই ভুল ধারণার অবসান হোক। দেশের সংবিধান দেশের সাধারণ নাগরিকদের রক্ষাকবচ। সংবিধানের লঙ্ঘন মানে, নাগরিক ও ব্যক্তিজীবনের উপর কোপ পড়া। সেই সামগ্রিক কোপ কবে ব্যক্তিজীবনে এসে পড়বে, ততদিন অবধি আমাদের বোধোদয়ের জন্য অপেক্ষা করতে না হোক। সংবিধান, দেশের আইন-কানুন রক্ষিত হোক। ভীতিপ্রদর্শনের মধ্য দিয়ে, সংখ্যালঘুর উপর সংখ্যাগরিষ্ঠের পরাক্রমী ভাব দেখিয়ে, গণতন্ত্রের দেশ হিসাবে আমাদের যে গৌরব রয়েছে, তা বিঘ্নিত হচ্ছে কি না খেয়াল রাখা শাসক দলের তথা সরকারের দায়িত্ব। তাহলেই দেশ ও দশ মিলিয়ে এই ভারত কেবলই বৃহত্তম গণতন্ত্রের রাষ্ট্র নয়, সর্বোত্তম গণতন্ত্রের রাষ্ট্র হয়ে উঠতে পারবে।
(লেখক কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্তুকার)
(মতামত নিজস্ব)
[email protected]
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.