অনির্বাণ চৌধুরী: ছোড়দির কাজ শেষ করে ওঠার পর বাবা একটা কথা বলেছিলেন। শ্রাদ্ধ ব্যাপারটার মধ্যে শোকের কিছু নেই। হিন্দুধর্ম খুবই উদার। পূর্বপুরুষকে শ্রদ্ধা জানানোর পাশাপাশি দেবতা, যক্ষ, কিন্নর, রাক্ষস, ভূত, পিশাচ- কাউকেই সে বাদ দেয় না। সবাইকে শ্রদ্ধা জানিয়ে শ্রাদ্ধ তাই শেষপর্যন্ত জীবন উদযাপন।
পিতৃপক্ষের চতুর্থ দিনে আমার কথাটা মনে পড়ে গেল।
পিতৃপক্ষ বলব, না শ্রাদ্ধপক্ষ?
ভুল কোনওটাতেই নেই। পিতৃপুরুষকে মনে রেখে জীবনের মূল স্রোতে ফেরার এই সময় শাস্ত্রমতে শ্রাদ্ধের আদর্শ। সেই জন্যই এই পক্ষের আসে উৎসব। দক্ষিণ এবং পশ্চিম ভারতে যার ব্যাপ্তি ভাদ্রপদ থেকে শুরু করে পরের পনেরোটি দিন। তাই সে অঞ্চলে গণেশ চতুর্থীর পরেই শুরু হয় শ্রাদ্ধপক্ষের আয়োজন। অন্য দিকে, উত্তর ও পূর্ব ভারতে আশ্বিন থেকে শুরু হয় পিতৃপক্ষ। শেষ হয় সর্বপিতৃ অমাবস্যা বা মহালয়ায়। এখন মহালয়া বললেই আমাদের বাঁধাধরা গতে মনে পড়ে যায় একটা কথা- পিতৃপক্ষ শেষ হল, শুরু হল দেবীপক্ষ।
কিন্তু, পিতৃপক্ষের শুরুর তারিখটা সব সময় খেয়াল থাকে না কেন?
এখন কিন্তু পিতৃপক্ষই চলছে। ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয়ে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তার মেয়াদ। যার পনেরোটা দিনই তিনপুরুষকে উৎসর্গীকৃত। যার এক একটা দিন এক এক শ্রেণির মৃত্যুকে নিবেদিত।
শাস্ত্র বলছে, এই পক্ষের প্রথম দিনটিকে বলা হয় পূর্ণিমা শ্রাদ্ধ। যে প্রিয়জন পূর্ণিমা তিথিতে পৃথিবী ছেড়ে গিয়েছেন জ্যোৎস্না রাতের মায়া কাটিয়ে, এই দিনটি তাঁর জন্য। দ্বিতীয় দিনটি প্রতিপদ শ্রাদ্ধ, প্রতিপদে গতাসুকে মনে রেখে। তৃতীয় এবং চতুর্থ দিনের দ্বিতীয়া, তৃতীয়া শ্রাদ্ধ যথাক্রমে নিবেদিত দ্বিতীয়া, তৃতীয়া তিথিতে মৃত পরিজনের উদ্দেশ্যে। ভরণী নক্ষত্রের সমাবেশকে মাথায় রেখে চার এবং পাঁচ নম্বর দিনটিকে বলা হয় চতুর্থী ভরণী এবং ভরণী পঞ্চমী। যা নির্দিষ্ট হয়েছে ঠিক গত বছর প্রয়াত প্রিয়জনের জন্য। এছাড়া ভরণী পঞ্চমী অবিবাহিত অবস্থায় যাঁরা প্রয়াত হয়েছেন, তাঁদের সম্মান জানানোর দিন। ষষ্ঠী, সপ্তমী এবং অষ্টমী শ্রাদ্ধ এই তিন তিথির মৃতের জন্য। নয় নম্বর দিনটিকে বলা হচ্ছে অবিধবা নবমী। এই দিন সধবা রমণীর শ্রাদ্ধ বিহিত। দশমী, একাদশী শ্রাদ্ধ নিয়ম মেনে এই দুই তিথিতে প্রয়াত পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে নিবেদিত। দ্বাদশী শ্রাদ্ধ নিবেদন করা হয়েছে সন্ন্যাসীদের জন্য। তেরো নম্বর দিনটিকে বলা হচ্ছে মঘা ত্রয়োদশী শ্রাদ্ধ। এই তিথিতে, অপরাহ্নে মৃত শিশুদের শ্রদ্ধা জানানো বিধি! চোদ্দ নম্বর দিনের চতুর্দশী শ্রাদ্ধ যাঁরা অপঘাতে প্রাণ দিয়েছেন, তাঁদের জন্য। তাই একে ঘাত চতুর্দশীও বলা হয়ে থাকে। আর পনেরো দিনে আসে সর্বপিতৃ অমাবস্যা বা মহালয়া। এই দিনটিতে যে কোনও ভাবে মৃত পূর্বপুরুষকে শ্রদ্ধা জানানো যায়।
এই দিনবিভাগের কারণেই ঠিক অর্ধেক মাসের ব্যাপ্তি! বুঝতে অসুবিধা হয় না- পিতৃপক্ষ কাউকেই ভুলে থাকার সময় নয়।
লোকবিশ্বাস যদিও অন্য কারণ দর্শাচ্ছে। বলছে কর্ণের কথা। কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধে নিহত হয়ে কর্ণ তখন লাভ করেছেন ক্ষত্রিয়র যোগ্য সম্মান। তাঁর স্বর্গপ্রাপ্তি হয়েছে। কর্ণ তাতে আশ্বস্ত। শুধু পৃথিবী থেকে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে স্বর্গে আসায় তিনি যারপরনাই ক্ষুধার্ত বোধ করছেন। ইন্দ্র, মতান্তরে যম, সদ্য স্বর্গবাসীর আপ্যায়ণে কার্পণ্য করেননি। তিনি কর্ণকে দেন যোগ্য আসন এবং খাদ্য হিসাবে সোনা। স্বর্ণপিণ্ড দেখে অবাক হন কর্ণ। তখন তাঁকে বলা হয়, তিনি সারা জীবনে পূর্বপুরুষকে কখনই খাদ্য-জল উৎসর্গ করেননি। শুধু অকাতরে অভাবীকে দিয়েছেন সোনা! তাই সোনাই বিনিময়ে তাঁর স্বর্গলোকে প্রাপ্য। বিমূঢ় কর্ণ অতঃপর জানাতে বাধ্য হন, পিতৃপরিচয় তাঁর জানা ছিল না!
ইন্দ্র হোন বা যম- এমন পরিহাস করবেন কেন, সে এক রহস্য! দেবতা হিসাবে তাঁরা ভালই জানেন কর্ণের জন্মপরিচয়। স্বয়ং সূর্য তাঁর পিতা! অতএব, কর্ণের তো পিতৃপুরুষকে পিণ্ডদানের কথা নয়!
কাহিনি খুব সম্ভবত কুন্তীর সূত্রে কর্ণকে পাণ্ডুর বংশগত করেছে। এ দিক থেকে দেখলে শুধু পাণ্ডু নন, পালকপিতা অধিরথের পূর্বপুরুষদেরও খাদ্য-জল উৎসর্গ করতে হয় কর্ণকে। তাই ইন্দ্র বা যমের দাক্ষিণ্যে তিনি ফিরে এলেন পৃথিবীতে। সম্পন্ন করলেন পিতৃপুরুষের শ্রাদ্ধানুষ্ঠান। কর্ণ অনুষ্ঠিত এই পনেরোটি দিনের অনুষ্ঠানই পরিচিত হয়েছে পিতৃপক্ষ বা শ্রাদ্ধপক্ষ নামে। কর্ণকে অনুসরণ করে এই পক্ষে পূর্বজদের শ্রদ্ধা জানালেই প্রাপ্তি হয় স্বাস্থ্য, সমৃদ্ধি এবং সৌভাগ্য।
কেউ কেউ এই লোককাহিনির মধ্যে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের একটা গা-জোয়ারি টের পেতেই পারেন। প্রশ্ন তুলতে পারেন, শ্রাদ্ধপক্ষে শুধু তিনপুরুষকেই সম্মান জানানোর প্রথা নিয়ে। বিশ্বাস বলছে, যিনি শ্রাদ্ধ করছেন, তাঁর তিনপুরুষ অবস্থান করেন পৃথিবী আর স্বর্গের মধ্যবর্তী অন্তরীক্ষে। তাকে বলা হয় পিতৃলোক। এই পক্ষে শ্রাদ্ধ করলে একপুরুষ পিতৃলোক ছেড়ে স্বর্গে যান, সেই জায়গায় স্থান পান আরেক পুরুষ। এভাবেই চক্র ঘুরতে থাকে জন্ম এবং মৃত্যুর! এই লোকবিশ্বাসকেও আবার দাঁড় করানো যায় প্রশ্নের মুখে। প্রতি বছরেই তো আমরা স্বজন হারাই না! তাহলে এই তিনপুরুষের চক্র পূর্ণ হয় কী ভাবে?
সে সব বাদ দিয়েও একটা কথা অস্বীকার করা যায় না। এই পিতৃপক্ষে শ্রদ্ধা নিবেদন আসলে শিকড়ে ফিরে যাওয়া। এই শিকড়ের টান কোনও ভাবেই অগ্রাহ্য করা যায় না। পিতৃপুরুষকে শ্রদ্ধা নিবেদন তাই নিজেকেই জানা। জন্মের সঙ্গে যে উত্তরাধিকার পেয়েছি, সেটা বুঝে নেওয়া। তাই শ্রাদ্ধপক্ষকে অস্বীকার করা যায় না।
আর, শ্রাদ্ধপক্ষের বিধি যে ভীষণ ভাবেই ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকতাকে সমর্থন করে, তাও কিন্তু নয়। এই পক্ষে শ্রাদ্ধবিধি নিয়ে শাস্ত্র যথেষ্টই উদার। শাস্ত্রমত বলছে, পক্ষের নির্দিষ্ট দিনে শ্রাদ্ধ না করে উঠতে পারলে শুধু শেষ দিন মহালয়ায় তর্পণ করলেই প্রসন্ন হবেন পিতৃপুরুষরা, তাঁদের অক্ষয় স্বর্গলাভ হবে। ঠিক যেমন বিষ্ণুর সহস্রনাম জপ করে উঠতে না পারলে শুধু রাম নাম উচ্চারণেই পুণ্য হয়, এও তাই!
ফাঁকিবাজি? তা নয়! আসলে এই ব্যবস্থা সাধারণ মানুষের সামর্থ্যের অভাবের প্রতি দৃষ্টি রেখে। মোদ্দা কথা কিন্তু সেই শিকড়টিকে ভুলতে না দেওয়া! আসলে, নিজেকে না চিনলে আনন্দও সম্যক হয় না। শ্রাদ্ধপক্ষ অন্তেই তাই উৎসবের দিন শুরু হয়। উৎসব পরিপূর্ণতা পায়।
তাই এই পিতৃপক্ষে আসনটি হয়েছে বিশ্বের পবিত্রতম স্থান। সব নদ-নদী সেই আসনের সম্মুখ ভাগে একত্রিত হয়েছে মহাবিশ্বের পূর্ণতা নিয়ে। আসছেন দেবতারা। আসছে যক্ষ, রক্ষ, কিন্নর, ভূত, পিশাচেরা। আমরাও পিতৃপুরুষের সঙ্গে সবাইকে শ্রদ্ধা জানিয়ে উৎসবের জন্য তৈরি হচ্ছি।
আর বিশেষ করে আমার মনে পড়ছে বাবার কথা! আশ্চর্য ব্যাপার, বাবাকে কোনও দিনই পিতৃপক্ষে বা মহালয়ায় তর্পণ করতে দেখিনি। না করার পিছনে নিজস্ব একটা যুক্তি তাঁর নিশ্চয়ই ছিল! সেটা কী, এখন আর জানার উপায় নেই!
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.