ছবি: প্রতীকী
বিপদটা বুঝতে পেরেছিলেন একজন। তিনি জ্যোতিবাবু। তিনি মমতাকে বাড়িতে ডেকে কথা বলেছিলেন। তৃণমূলনেত্রী কী বলছেন তা রাজ্য সরকারের শোনা উচিত বলেও মন্তব্য করেন। কিন্তু ততদিনে পার্টিতে বসুর কথার গুরুত্ব কমে গিয়েছে। তাই ‘ঐতিহাসিক ভুল’-এর মতো আর এক ভুল হয়ে গেল। বর্ষীয়ান নেতার পরামর্শ গুরুত্ব পেলে ইতিহাস হয়তো অন্যরকম হত। কলমে কিংশুক প্রামাণিক
একজন পরিশ্রমী সাংবাদিক হিসাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সিঙ্গুরে কৃষিজমি রক্ষার আন্দোলন খুব কাছ থেকে দেখেছি। ২০০৬ সালের ৪ ডিসেম্বর থেকে ২৯ ডিসেম্বর, ধর্মতলায় মেট্রো সিনেমার উল্টোদিকের ফুটপাথে কনকনে উত্তুরে হাওয়ায় প্রায় খোলা আকাশের নিচে তাঁর অনশন, অথবা জল-ঝড়-দুর্যোগ উপেক্ষা করে ২০০৮-এর ২৪ আগস্ট থেকে টানা ১৬ দিন সিঙ্গুরে নির্মীয়মাণ কারখানার বাইরে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের একপাশে অবস্থান সত্যাগ্রহ- রাতভর, প্রতিটি দিন, প্রতিটি মুহূর্ত প্রত্যক্ষ করার বিরল অভিজ্ঞতা আমার আছে।
বিস্মিত হয়ে দেখেছি, দিনের পর দিন মহানগরীর পথের ধুলো, মশা-মাছি-ইঁদুর থেকে সিঙ্গুরের ঝোপঝাড়ের সাপখোপ, পোকামাকড়ের উপদ্রব উপেক্ষা করে অবলীলায় আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন তৃণমূল নেত্রী। প্রাণের মায়া তাঁর নেই। লক্ষ্যে অবিচল অভিযাত্রী। হার মানবেন না।
মজার বিষয় হল, সেই লড়াইয়ের শিকড় মাটির তলা দিয়ে কতদূর ছড়িয়ে পড়ছে, নানা শাখা-প্রশাখা মিলে বিন্দু থেকে সিন্ধু হচ্ছে, তা অনুধাবন করতে না পেরে ভুলের পর ভুল করে চলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। মমতাকে (Mamata Banerjee) তিনি পছন্দ করতেন না। লড়াকু মনোভাবকে অবজ্ঞা করতেন। তাই চোখ বন্ধ করে হয়তো উপেক্ষা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ হয়! হয়নি।
অতএব ‘ন্যানো’ কারখানা কেন সিঙ্গুরে হল না- তা নিয়ে যখন ১৫-১৬ বছর পর বিতর্ক হয়, এবং কিছু অজ্ঞদের ভুলভাল ব্যাখ্যা শুনি, তখন মনে হয় এ-ও এক ইতিহাস বিকৃতি। কোন পটভূমির উপর দাঁড়িয়ে এই আন্দোলন এত তীব্র আকার নিল, কেন রতন টাটা আচমকা চলে যাওয়ার কথা ঘোষণা করে দিলেন, কেনই বা সুপ্রিম কোর্ট কৃষকদের জমি ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দিল- এসব নিয়ে একটু পড়াশোনা করে মত দেওয়া উচিত সবার। কারণ স্বাধীনতার পর কৃষিজমি রক্ষার এমন লড়াই আর কখনও হয়নি। যেহেতু এই আন্দোলন কভার করা আমার প্রায় তিন দশকের সাংবাদিকতা জীবনের মাইলফলক, সেই কারণে সিঙ্গুর নিয়ে নিজস্ব কিছু মূল্যায়ন আমার আছে।
২০০৬ সালে জোর করে বিতর্কিত জমি টিন দিয়ে ঘিরে দেওয়ার ঘটনার পর ২৫ সেপ্টেম্বর স্থানীয় বিডিও অফিসে মমতা-সহ আন্দোলনকারীদের উপর পুলিশি অত্যাচার থেকে দশ বছর পর দেশের মহামান্য প্রধান বিচারালয়ের রায়ে সেই অধিগ্রহণ বেআইনি ঘোষণা, নাটকীয় ঘটনাক্রমের সম্পূর্ণটা দেখে আমার মনে হয়েছে- ন্যানো প্রকল্প না হওয়ার জন্য সরাসরি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য দায়ী নন। তেমনই ধন্যবাদ প্রাপ্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। ভাগ্যিস তিনি সেদিন কৃষিজমি রক্ষার আন্দোলন করেছিলেন। তার জেরেই ১৮৯৭ সালের ব্রিটিশ সৃষ্ট কালাকানুন বাতিল হয় সংসদে। জোর করে জমি কেড়ে নেওয়ার সেই আইন যদি থাকত, তাহলে আজকের ভারতে বিপদ আরও ভয়ংকর আকার নিত। গরিব মানুষের হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাংক থেকে লুণ্ঠনকারীদের ‘সেফ প্যাসেজ’ দেওয়া বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের মদতপুষ্ট সুবিধাভোগী ধনী শ্রেণি হাত বাড়াত কৃষিজমির দিকে। নষ্ট হত কৃষিজমির ভারসাম্য। তিন কৃষি আইন নিয়ে ঘটনায় সবাই বুঝে গিয়েছে শাসকের মানসিকতা।
তাহলে সিঙ্গুরে (Singur) প্রকল্প হল না কেন? খুব মূল্যবান প্রশ্ন। টাটাদের কারখানা না হওয়ার কারণ তিনটি সংখ্যা- ২৩৫। উনত্রিশ বছর ক্ষমতায় থাকার পরও যখন কোনও রাজনৈতিক দল বিধানসভায় ২৯৪টি আসনের মধ্যে ২৩৫টি-তে জয়লাভ করে, তখন তারা নিজেকে ঈশ্বর ভাবতে শুরু করে। মনে করে, যা খুশি তাই করার ক্ষমতা তৈরি হয়ে গিয়েছে। তাদের প্রদেশে বিরোধীদের কোনও মূল্য নেই। বিরোধীরা গুরুত্বহীন। এই ভাবনা থেকে তৈরি হয় অহংকার, ঔদ্ধত্য, উপেক্ষা, অবহেলা। আর অহং যখন গ্রাস করে, তখন আলেকজান্ডারও পুরুকে চিনতে ভুল করেন।
তাই ভুলটা আসলে হয়েছিল আলিমুদ্দিনের মানসিকতায়। যে ভোটে তারা ভাল ফল করতে পারবে কি না তা নিয়ে সংশয় ছিল, সেই ভোটে ২৩৫ আসন পেয়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করতে শুরু করেন কমরেডরা। সিপিএমের তৎকালীন নেতারা বলতে শুরু করেন, কে মমতা? মাত্র ৩০ আসন পেয়েছেন। লোকসভা ভোটে একা হয়ে গিয়েছেন। তাঁকে কেন পাত্তা দিতে হবে? আমরা লোকসভা ভোটে ৪২টির মধ্যে ৩৫ আসন পেয়েছি। বিধানসভা ভোটে ২৩৫। মানুষ আমাদের সঙ্গে। মমতার কথার কোনও গুরুত্ব আছে? সিঙ্গুরে তিনফসলি জমি তো কী হয়েছে? আমরা মনে করেছি ওখানে টাটাদের কারখানা হবে, তাহলে হবেই। কে ইচ্ছুক, কে অনিচ্ছুক কিছুই দেখতে হবে না। জোর করে জমি অধিগ্রহণ করে নাও। কেউ বাধা দিতে এলে ফেলে পেটাও। মমতা অনশন করছেন, তাতে কী এসে গেল! ওঁর দিকে তাকিয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার দরকার নেই। যেমন রাস্তায় পড়ে আছেন, তেমন থাকুন। আমরা ২৩৫!
বুদ্ধবাবু তখন উঠতে-বসতে বলতেন, ‘আমরা ২৩৫, ওরা ৩০। কে আমাদের ঠেকাবে।’ তবে এও ঠিক, এই সিদ্ধান্ত একা বুদ্ধবাবুর ছিল না। সিপিএমে একক সিদ্ধান্তে কিছু হয় না। রাজ্যস্তরে রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর কথাই শেষ কথা। কেন্দ্রীয়ভাবে কিছু হলে পলিটবুরো। তারপর কেন্দ্রীয় কমিটি। ভুলে গেলে চলবে না, জ্যোতি বসু যে প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি, সেটা এই জন্য। কেন্দ্রীয় কমিটি দু’-দু’বার ভোটাভুটি করে জানিয়ে দেয়, সংখ্যাগরিষ্ঠের সায় নেই বসুর প্রধানমন্ত্রিত্বের দিকে।
সেই সময়ও রাজ্যের শীর্ষ নেতৃত্ব একজোট হয়ে মমতার আন্দোলনকে গুরুত্ব না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। বুদ্ধবাবু তার শরিক মাত্র। ঠিক এই কারণে সাম্প্রতিক বিতর্কে মমতা কিন্তু বুদ্ধবাবুকে দায়ী করেননি। সাফ বলেছিলেন, টাটাদের তাড়িয়েছে সিপিএম।
বিপদটা বুঝতে পেরেছিলেন একজন। তিনি জ্যোতিবাবু। তিনি মমতাকে বাড়িতে ডেকে কথা বলেছিলেন। তৃণমূল নেত্রী কী বলছেন তা রাজ্য সরকারের শোনা উচিত বলেও মন্তব্য করেন। কিন্তু ততদিনে পার্টিতে বসুর কথার গুরুত্ব কমে গিয়েছে। তাই ‘ঐতিহাসিক ভুল’-এর মতো আর এক ভুল হয়ে গেল। বর্ষীয়ান নেতার পরামর্শ গুরুত্ব পেলে ইতিহাস হয়তো অন্যরকম হত।
জমি আন্দোলনের ব্যাপকতা বুঝে বসু সেদিন অশনি সংকেত দেখেছিলেন। সিপিএম-এর ভিত্তি কৃষকসমাজ। সেই সমাজের সমর্থনের উপর দাঁড়িয়ে বামফ্রন্ট সরকারের জয়। অথচ মমতা কৃষিজমি রক্ষার কথা বলে তাঁদের মন টলিয়ে দিচ্ছেন। কৃষক, খেতমজুররা দলে দলে চলে যাচ্ছেন তাঁর দিকে। বসু পার্টিকে বলতে চেয়েছিলেন, আকাশ থেকে মাথা মাটিতে নামাও। সবুজ ধান কী বলছে শোনো। গরিষ্ঠতা আজ আছে, কাল নেই। রাজীব গান্ধী ৪০০-র বেশি আসন পেয়েও বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংয়ের কাছে
হেরে গিয়েছিলেন।
আশঙ্কা সত্যি হয়েছিল ২০১১ সালের ভোটে কৃষক বিদ্রোহে। সিপিএম ক্ষমতাচ্যুত হয়। কিন্তু ভুলটা কতটা গুরুতর সেটা আরও বোঝা গেল ১০ বছর পর। আশ্চর্য, ২৩৫ পাওয়া সেই বিধানসভায় একটি আসনও নেই বামেদের। কৃষকের লালদুর্গ আজ সবুজ গড়।
অতএব, ইতিহাস মেনে এগিয়ে চলা উচিত। সিঙ্গুর নিয়ে মমতাকে খোঁচা না দেওয়া ভাল। মমতা কিন্তু সেদিন স্পষ্ট বলেছিলেন, অনিচ্ছুকদের ৪০০ একর ফিরিয়ে দিয়ে বাকি ৬০০ একরে কারখানা হোক। তাতে কৃষি-শিল্প দুই-ই জিতে যাবে। আর ভবিষ্যতে বহুফসলি কৃষিজমিটা বাদ দিয়ে প্রকল্প করুন।
এই কথাগুলো যে কেউ ওই সময়ের সংবাদপত্রগুলি দেখলে পেয়ে যাবেন। কিন্তু সেই কথা সিপিএমে গুরুত্ব পায়নি। গুরুত্ব দিলে মমতার দাবি মেনে নেওয়া হয়। কেন মানব? আমরা যে ২৩৫! কাজেই ২০০৬ সালের বিধানসভা ভোটে ২৩৫ আসনই বামেদের সর্বনাশ ডেকে আনে। তারা ভুলে যায়- আসন সংখ্যা শেষ কথা বলে না। গণতন্ত্রে ‘যত বড় জয়, তত বেশি ভয়।’
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.