আমেরিকার ধাঁচে সেনাবাহিনীকে ঢেলে সাজাতে চলেছে কেন্দ্র৷ দেশের সবকটি সশস্ত্র বাহিনীকে একজোট করে গড়ে তোলা হতে পারে ‘জয়েন্ট অ্যাকশন ফোর্স’৷ কী সুবিধা হবে ‘চিফ অফ দ্য ডিফেন্স স্টাফ’ নিয়োগে, খোঁজ নিলেন দীপেন্দু পাল৷
Advertisement
নির্বাচনী ইশতেহারে এনডিএ তথা বিজেপি ঘোষণা করেছিল, দেশের সেনাবাহিনীকে আরও মজবুত করে তুলতে একজন ‘চিফ অফ দ্য ডিফেন্স স্টাফ’ বা ‘সিডিএস’ নিয়োগ করা হবে৷ এই কঠিন সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে পারলে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে দু’টি বড় রদবদল এবছর হতে চলেছে৷ প্রথম ‘এক পদ এক পেনশন’ চালু৷ এবং দ্বিতীয়টি এই ‘চিফ অফ দ্য ডিফেন্স স্টাফ’ নিয়োগ৷
কী এই ‘সিডিএস’? কেনই বা এর অবিলম্বে দরকার হয়ে পড়ল সেনাবাহিনীতে?
কে সুব্রহ্মণ্যমের নেতৃত্বে গঠিত কারগিল রিভিউ কমিটি সুপারিশ করেছে, ভারতের সশস্ত্র সেনাবাহিনীকে আরও আধুনিক ও মারাত্মক করে তুলতে একজন ‘চিফ অফ দ্য ডিফেন্স স্টাফ’ নিয়োগ করা জরুরি৷ আমেরিকার মতো দেশ, যাদের সশস্ত্র বাহিনী বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী বলে মানা হয়, তাদের একজন ‘সিডিএস’ রয়েছে৷
মিলিটারি যে কোনও দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার প্রধান স্তম্ভ৷ যার সেনাবাহিনী যত বড়, তার অভ্যন্তরীণ কাঠামো ততই জটিল৷ তাই কোনও একজন ব্যক্তি একচ্ছত্র নেতৃত্ব দাবি করতে পারেন না৷ তার উপর এখন শুধু জলে বা স্থলে নয়, দেশের সাইবার নিরাপত্তাকে আঁটসাঁট করতেও পৃথক বাহিনীর প্রয়োজন হয়ে পড়েছে৷ বিদেশি আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করতে অবিলম্বে দেশের সেনাবাহিনীর কাঠামোয় কয়েকটি পরিবর্তন করা জরুরি৷ পদাতিক, নৌবাহিনী ও বায়ুসেনার মধ্যে সমন্বয় ঘটানো খুব জরুরি হয়ে পড়েছে৷ সবকটি বাহিনীর ‘জয়েন্ট অ্যাকশন’ শত্রুকে কড়া মোকাবিলা দিতে পারে৷ ‘জয়েন্ট অ্যাকশন’ বলতে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনও একটি বাহিনী তাদের পৃথক যুদ্ধ লড়বে না৷ ধরা যাক, সীমান্তে জঙ্গি অনুপ্রবেশের মোকাবিলায় একা বিএসএফ নয়, যৌথ অভিযান চালাবে সীমান্তরক্ষী বাহিনী, নৌসেনা ও বায়ুসেনা৷ আকাশ থেকে গুলিবর্ষণ, রণতরী থেকে ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়ে ও পদাতিক বাহিনী একেবারে শত্রুর ঘাঁটিতে ঢুকে ঝাঁঝরা করে দিয়ে এলে অনেক সহজে, কো-ল্যাটারাল ড্যামেজ এড়িয়ে জঙ্গি দমন করা যেত বলে অনুমান সামরিক বিশেষজ্ঞদের৷ তবে এক্ষেত্রে সব বাহিনীকে সম্মিলিতভাবে কোনও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে৷
এই কাঠামো কিন্তু প্রথম বিশ্বের প্রায় সমস্ত সশস্ত্র বাহিনীই অনুসরণ করে চলে৷ ১৯৮৭-তে মার্কিন আইনসভায় পাশ হয় সেই বিখ্যাত ‘গোল্ডওয়াটার-নিকোলাস অ্যাক্ট’৷ ওই আইন প্রণয়নের কৃতিত্ব দিতেই হয় প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগানকে৷ আইন তৈরি করে একেবারে ‘ক্লাসিক থিয়েটার কমান্ড সিস্টেম’-এ মার্কিন সশস্ত্র বাহিনীর পরিচালনা শুরু হয়৷ মার্কিন মুলুকের চারটি সশস্ত্র বাহিনিকেই এক ছাদের নিচে নিয়ে আসা হয়৷ প্রত্যেক বাহিনীর প্রধানদের দায়িত্ব থাকে সেনাকে প্রশিক্ষণ দেওয়া, তাঁদের অপারেশনের জন্য তৈরি করা৷ তাঁরা রিপোর্ট করেন কমব্যাটান্ট কমান্ডারকে৷ কমব্যাটান্ট কমান্ডার সরাসরি রিপোর্ট করেন সেক্রেটারি ডিফেন্সকে৷ সেক্রেটারি ডিফেন্সকে কিন্তু ভারতের ডিফেন্স সেক্রেটারির সঙ্গে গুলিয়ে ফেললে চলবে না! আমাদের দেশে প্রতিরক্ষা সচিব একজন আমলা৷ মার্কিন মুলুকের সেক্রেটারি ডিফেন্স হলেন আমেরিকার প্রতিরক্ষামন্ত্রী৷ তিনি রিপোর্ট করেন মার্কিন প্রেসিডেন্টকে, যিনি আমেরিকার সর্বাধিপতি, সর্বোচ্চ সেনানায়ক৷ পড়শি পাকিস্তান যে আজ পারমাণবিক গবেষণায় আন্তর্জাতিক মহলের নজর কেড়েছে তার জন্যও কিন্তু দায়ী এই ‘জয়েন্ট অ্যাকশন’ সিস্টেম৷ ‘জয়েন্ট চিফ অফ স্টাফ কমিটি’র চেয়ারম্যান পারমাণবিক গবেষণার রিপোর্ট দেন সরাসরি প্রধানমন্ত্রীকে৷
২০০১ সালে কারগিল রিভিউ কমিটির সুপারিশ মোতাবেক কেন্দ্রীয় সরকার ‘এইচ কিউ ইন্টিগ্রেটেড ডিফেন্স স্টাফ’ বা ‘এইচ কিউ আইডিএস’ গঠন করে৷ এর কাজ হল পরিকল্পনা, মতামত, ইন্টেলিজেন্স, প্রশিক্ষণ এমনকী যৌথ অভিযানেরও প্রাথমিকভাবে আইডিএস-এর কাজের পরিধির মধ্যে পড়ে৷ কিন্তু এখনও দেশের তিনটি প্রধান বাহিনীর মাথারাই কোনও অভিযানের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন৷ ডিফেন্স ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি বা ডিআইএ গঠিত হয় ২০০১ সালে৷ জাতীয় সুরক্ষা উপদেষ্টা বিভাগের অধীনে কাজ করে ডিআইএ৷ ওই বছরই ‘স্ট্র্যাটেজিক ফোর্স কমান্ড (এসএফসি)’ তৈরি হয় যারা দেশের পারমাণবিক গবেষণা সংক্রান্ত বিষয়গুলির দেখভাল করেন৷ এই এসএফসি কিন্তু কোনও বাহিনীর আওতায় পড়ে না৷ এর সর্বোচ্চ নিরামক সংস্থা এনএসএ৷ এতদিন ‘আন্দামান ও নিকোবর কমান্ড’-এর দায়িত্ব ‘রোটেশন’ পদ্ধতিতে সামলাতেন তিন বাহিনীর প্রধান৷ সম্প্রতি সেই দায়িত্ব পাকাপাকিভাবে দেওয়া হয়েছে ভারতীয় নৌবাহিনীকে৷ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এইভাবে কোনও একটি বাহিনীর হাতে চূড়ান্ত ক্ষমতা না তুলে দিয়ে ‘সিডিএস’ নিয়োগ করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ! সমস্ত অপারেশনের জন্য তিনি দায়বদ্ধ থাকবেন৷ যদিও বাহিনীর প্রশিক্ষণের দায়িত্ব থাকবে প্রধানদের হাতেই৷ কিন্তু পদাতিক, নৌবাহিনী ও বায়ুসেনার আলাদা আলাদা প্রধানের পদ এখন সত্যি পুরনো হয়ে গিয়েছে৷ ২০০১ থেকে ২০১৬- মাঝের এতগুলো বছরেও সেনাবাহিনীর গঠন কাঠামোয় কোনও পরিবর্তন আসেনি৷ এখনও এ দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সেনাবাহিনী-রাজনীতি ও আমলাতন্ত্রের ত্রিভুজের উপর নির্ভরশীল৷ এই ব্যবস্থা চললে কোনও সাহসী পদক্ষেপ নিতে দেরি হয়ে যেতে পারে৷ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মতো একজন সাহসী নায়ক এ বিষয়েও কোনও বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার হিম্মত দেখাতে পারেন কি না, সেদিকেই তাকিয়ে প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা৷
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.