পুজোর দিনগুলো এগিয়ে চলে আনন্দ-ফুর্তির সঙ্গে বিষাদের অনুষঙ্গ বুনে-বুনে। ক্রমে ফুরয় নবমী নিশি। উপস্থিত হয় বিদায়ের ক্ষণ। বিসর্জন। মন বলে ‘যেতে নাহি দিব’। বিজয়া দশমীর বিশেষ নিবন্ধ সুস্নাত চৌধুরীর কলমে
জীবনে আনন্দের ভূমিকা যত, বিষণ্ণতারও ততটাই। উৎসব আমাদের এই সত্য আরও বেশি করে মনে করিয়ে দেয়। পুজোর মরসুমে এই এত আলো এত আকাশ যতটা উদ্দীপনা বয়ে আনে, ততটা বিষাদও। যতখানি স্ফূর্তি, দীর্ঘশ্বাস তার চেয়ে কিছু কম নয়। ‘আছে’ শব্দের আর-একটা অর্থ যে আসলে ‘থাকবে না’, জীবনের সেই অমোঘ পাঠ আমরা প্রথম গ্রহণ করি উৎসবের কাছেই। তখন কাছের মানুষকে বলতে ইচ্ছা করে- ‘বন্ধু আমার মন ভাল নেই, তোমার কি মন ভাল?/ বন্ধু তুমি একটু হেসো, একটু কথা বোলো…/ বন্ধু আমার বুকের মাঝে বিসর্জনের ব্যথা/ বন্ধু তুমি অমন করে যেয়ো না আর একা।’
আশৈশব দেখে এসেছি, পুজোর দিনগুলো এগিয়ে চলে আনন্দ-ফুর্তির সঙ্গে বিষাদের অনুষঙ্গ বুনে-বুনে। আগমনির রোদের পাশেই যেন বোবা মূর্তির মতো ঠায় অপেক্ষায় বসে থাকে আসন্ন বিদায়ের ছায়া। শাক্ত পদাবলি থেকে লোকমুখে প্রচলিত ছড়া- বারে বারে ফিরে আসে এই একই ভাবনার রেশ। ‘গিরি, এবার আমার উমা এলে, আর উমা পাঠাব না’, কিংবা ‘ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ, ঠাকুর যাবে বিসর্জন’- শুরুর পূর্বমুহূর্ত থেকেই অনিবার্য সমাপ্তির কল্পনা আমাদের ভেতরে ভেতরে কাতর করে রাখে। জমাটি আড্ডা, সদ্য প্রেম, আড়চোখে ঝাড়ি, রাতভর ঘোরাঘুরি- এই সমস্তই থাকে, কিন্তু ভদকায় যেভাবে ডাবের জল মেশে, পুজোর এসব ভরপুর উত্তেজনার মধ্যেও তেমনই মিশে থাকে খেলা শেষের সুর।
তারপর, প্রতিবারের মতো, ফুরয় নবমী নিশি। উপস্থিত হয় বিদায়ের সেই ক্ষণ। বিসর্জন। ভাসান। যেন এরই প্রস্তুতি চলছিল আলো ঝলমলে এই ক’দিন ধরে। পুজোর এত জাঁকজমক তখন মিথ্যা মনে হয়। পিছু ফিরে কিশোরবেলার সেসব দিনের দিকে তাকালে ভেসে ওঠে অকৃত্রিম এক কার্নিভালের স্মৃতি। সেই ভাসান যাত্রাতেও হয়তো আলো ছিল, শব্দ ছিল, দেখনদারিত্বও বিলক্ষণ ছিল, কিন্তু স্বতঃস্ফূর্ততার কোনও অভাব ছিল না। কার লাইটিং ‘লোকাল’ আর কার ‘চন্দননগর’ থেকে আনা, কোন গেট কতটা উঁচু- সেসব চাপা লড়াইও কি ছিল না? উত্তরপাড়া বনাম দক্ষিণপাড়ার ‘সংঘর্ষ’ শুধু সিনেমার পর্দাতেই নয়, বাংলার মফস্সল শহরগুলিতে দশমীর সন্ধ্যায় মাঝেমধ্যেই চাক্ষুষ করা যেত। জানি না, আজ আর কতটা সেসবের দেখা মেলে নদীপারের অলিগলি রাজপথে।
‘ডিজে’ শব্দটি তখনও চালু নয়। কিন্তু ব্যাঞ্জো আর তাসা না থাকলে ‘প্রসেশন’ হয়ে পড়ত অর্থহীন! ভাসানগীতি ‘টুম্পা’ ছিল না বটে, কিন্তু ‘দো ঘুঁট মুঝে ভি পিলা দে শরাবি’ বাজতেই হবে বারকতক। ক্রমে ঢুকবেন, আশা পারেখ না, তবে শেফালি জরিওয়ালা– ‘কঁাআটাআ লাগাআ’। আর, এসবের সঙ্গে চলবে তালিমবিহীন খোকা-বুড়োর উদ্দাম নৃত্য। দু’-একপিস মাইকেল জ্যাকসনও যে সাক্ষাৎ হাজির হয়ে যেত না, তা নয়। আবার যেসব পুজোর ভাসানে বাড়ির মহিলারাও সগৌরবে নাচে সামিল হতেন, তা ছিল একটা ব্যাপার! বাঙালির রক্ষণশীলতার আগল বিশ-পঁচিশ বছর আগেও বোধহয় এতটা খোলেনি। স্বাধীনতার ফুরফুরে বাতাস মিশে থাকত দশমীর ওই ঘামে-চুপচুপে কয়েক ঘণ্টায়। কোনও কোনও সদ্য সম্পর্কও ষষ্ঠীর চোখাচুখি আর অষ্টমীর ঈষৎ স্পর্শ পেরিয়ে শেষ সন্ধের এই ফুরসতে পৌঁছে যেতে চাইত পাকাপোক্ত প্রেমের ঠিকানায়।
হুজ্জুতিও কি ছিল না? সকাল থেকে রসায়নের যাবতীয় গূঢ় রহস্যকে তরল রূপ দেওয়ার যে-অভিযান চলেছে, তার ফল মিলত হাতেনাতে। ছাই কিংবা তামা খেলা দেখাত ভাঙের শরবতে। উইকেট পড়তে থাকত একে-একে। আবার কেউ টিকে যেত অনড় অটল এম. এল. জয়সীমা হয়ে। নেশায় টং, পায়ে মৃদু মাত্রাবৃত্ত, কিন্তু মুখ গম্ভীর গদ্যময়। হেঁটে চলেছে লক্ষ্য অটুট রেখে। জলের ঝাপটা, তেঁতুলজল গেলানো কিংবা মুখে কঁাচালঙ্কা ঠুসে দেওয়ার টোটকাও যে সবসময় কাজ দিত, এমন নয়। ধুনকি কখনও থেকে যেত রাত কাবার হয়েও। রসিকজনের জন্য সিদ্ধির সঙ্গে যদি কোনওক্রমে জুটে যেত দু’-এক ঢোঁক কারণবারি, তখন যে কোথাকার জল কোথায় গড়াত! আবার ভাসানের এই গ্যালাখ্যালার পুণ্য তিথি হয়ে উঠত কারও কারও মুখেমদের প্রথম অভিজ্ঞতাও।
তবু যে যতই বিপথগামী হয়ে পড়ুক না কেন, প্রতিমা ঠিকই ধীরে ধীরে এগিয়ে যেত নিরঞ্জনের পথে। কারণ প্রতি পুজো কমিটিতেই দায়িত্ববান কিছু মানুষের অভাব ছিল না। সপরিবারে মা দুর্গাকে চাগিয়ে তোলার কৌশল তঁাদের নখদর্পণে। দড়ির টান আর বঁাশের ঠেকনায় সে প্রায় পদার্থবিদ্যার কঠিনতম প্র্যাকটিকাল পরীক্ষা! বলবিদ্যা থেকে তড়িতের দিকে প্রশ্নপত্র ঘুরে যেত যখন ইলেকট্রিকের তারের তলা দিয়ে নিয়ে যেতে হত ম্যাটাডোর কি ভ্যান। কলকাতা শহরের বিসর্জন-সংস্কৃতি গত দু’-একদশকে বেশ খানিক বদলালেও মফস্সলে হয়তো এখনও ততটা ভোল পাল্টায়নি। তবু সময়ের সঙ্গে কিছু পরিবর্তন আসবেই, তাকে স্বীকার না করে উপায় কী?
দুর্গাপুজোর যাবতীয় ঘটনা পরম্পরার সঙ্গে বিসর্জনের শোভাযাত্রার প্রধানতম মৌলিক ফারাক মনে হয় পরিপ্রেক্ষিতের বদলে যাওয়া। এর আগে পর্যন্ত মানুষ চলমান থাকে, প্রতিমা স্থির। স্থিতি-গতির খেলাটা এবার ঘুরে যায়। পথপার্শ্বে মানুষকে দাঁড় করিয়ে রেখে গতিশীল হয়ে পড়ে প্রতিমা। ক্ষণিক ও অন্তিম এই গতিশীলতাই যাবতীয় বিষাদের উৎস। যতই বলি, যেতে নাহি দিব; তবু চলে যাওয়াই নিয়তি। আবার এসো মা। এই কামনাটুকুই তখন সম্বল। আসছে বছর আবার হবে। নিজেকে প্রবোধ দেওয়া ছাড়া আর অবশিষ্ট থাকে না কিছু। সিক্ত পোশাকে পাড়ায় ঢুকে ফঁাকা মণ্ডপ দেখে মনটা হু হু করে উঠবে, চোখের নীচে থমকে থাকবে অনেকখানি চোখের জল; তবু সোল্লাসে উচ্চারণ করে না-গেলে ধরা পড়ে যেতে হবে নিজের কাছেই। তাই তখনই কোলাকুলি, শুভেচ্ছা বিনিময়, মিষ্টিমুখ।
জীবনের প্রায় সব ক্ষেত্রেই আজ মনে হয়, থাকার চেয়ে এই যাওয়াটাই বুঝি খাঁটি। অতি আনন্দে আতিশয্য থাকতে পারে, অতি শোকে থাকতে পারে দেখানেপনা, অতি প্রেমে হয়তো মিশে যেতে পারে খানিক ভড়ং- কিন্তু হারিয়ে ফেলার যে নীরব বেদনা, বিচ্ছিন্নতার যে শব্দহীন গোঙানি, যা একান্ত ব্যক্তিগত, যা কেবল নিজেরই অন্তরে অনুরণিত হয়ে চলে, তাতে এতটুকু খাদের সম্ভাবনা নেই।
দেবী দুর্গার বিসর্জনের মধ্যে ফিরে আসার সুনিশ্চিত প্রতিশ্রুতি আছে ঠিকই, কিন্তু বিষণ্ণতার যে চাপা বায়ুস্তর সে আমাদের মনের ভেতরঘরে সাময়িক বিছিয়ে দিয়ে যায়, উৎসবের এত আড়ম্বরের উলটোদিকে তাকেই আজ সবচেয়ে পবিত্র বলে বোধ হয়। নির্ভেজাল, নিরাকাঙ্ক্ষা। বিষাদের এই উপস্থিতি-ই আমাদের ক্ষণস্থায়ী রূপকথাকে করে তোলে মায়াময়, চিরন্তন এক অপরূপকথা। বাৎসরিক ঘটনাবলি থেকে উত্তীর্ণ হয়ে তা তখন হয়ে ওঠে স্মৃতি। চলে গিয়েও যা আসলে রয়ে যায়।
(মতামত নিজস্ব)
লেখক প্রাবন্ধিক
[email protected]
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.