Advertisement
Advertisement
Refugee

ঘর বেঘর

উচ্ছেদ হওয়া মানুষের কাছে ঘরের ধারণা তবে কীভাবে জ্যান্ত হয়ে আছে এই ভূ-পটে?

The concept of home as refugee crisis swells | Sangbad Pratidin
Published by: Monishankar Choudhury
  • Posted:July 25, 2023 11:58 am
  • Updated:July 25, 2023 11:58 am  

চার দেওয়ালের অফুরন্ত স্বাধীনতা কার স্বপ্ন নয়? যতই কাব‌্য হোক, ‘চারটে দেওয়াল, জুড়লেই ঘর, ভাঙলেই পৃথিবী’, একুশ শতকে শরণার্থীদের ভিড় আবিশ্ব। রাজনৈতিক, জাতিগত, পরিবেশ সংক্রান্ত- নানা কিসিমেই উদ্বাস্তু ও আশ্রয়হীন মানুষের সংখ‌্যা বাড়ছে ক্রমশ। ঘর হারানো বা উচ্ছেদ হওয়া মানুষের কাছে ঘরের ধারণা তবে কীভাবে জ‌্যান্ত হয়ে আছে এই ভূ-পটে? কলমে ঋতা বসু

র, বাসা, বাড়ি- প্রত্যেকটি শব্দের আদি উৎস অন্য যা কিছুই হোক না কেন, এই তিনটে শব্দের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে কেমন নিশ্চিন্তি, ভালবাসা, আশ্রয়। কর্ম অন্তে একান্তে অবসর। বাড়ি মানে আমার ঠিকানা। হালে যে কোনও কাগজেই লিখতে হয় ‘পার্মানেন্ট অ্যাড্রেস’। হাজার মাইল দূরে বাসা বেঁধে থাকলেও তা মিথ্যে হয়ে যায় না। তবু লেখার সময় বুকের মধ্যে কুট করে কী যেন কামড়ায়। এখনকার পৃথিবীতে সত্যিই কি আমাদের কোনও চিরন্তন ঠিকানা আছে? কেন যে এই অদ্ভুত নিয়মটা এখনও টিকে আছে কে জানে। মনে হয় আছে এজন্য যে, মানুষ এখনও ভাবে, সে ফিরবে যেখান থেকে ডানা ঝাড়া দিয়ে একদিন উড়াল দিয়েছিল সেখানে। যেখানে আছে নানা সুখময় কোনাকাঞ্চি, খোলা ছাদের ভাঙা কার্নিশ, অকারণ আত্মীয়তা। আর সে যে এই পৃথিবীতে ছিল, আছে তার একটা চিরস্থায়ী প্রমাণ। সেই জায়গাও এখন কারণে-অকারণে ভাঙা পড়ে। আশ্রয়ও কখনও কখনও বড় অসহায়। ইচ্ছা থাকলেও ঘরের মানুষগুলোকে বুকে জড়িয়ে ধরে নিরাপত্তার ওম দিতে পারে না।

Advertisement

পৃথিবীর যেখানেই যাই না কেন, নতুন করে ঘর বাঁধার আগে তালিকায় টিক মেরে মিলিয়ে নিই মূল ব্যাপারগুলো। এই বৈশিষ্ট্যগুলো চিরন্তন, মানুষের সঙ্গে মনুষ্যেতর প্রাণীর ক্ষেত্রেও সত্যি। জানালা দিয়ে দেখতে পাই, বুলবুল পাখি বাসা বানানোর আগে কতদিন ধরে সেই জায়গা নির্বাচন করে। হোক অস্থায়ী, কিন্তু নিরাপত্তা চাই একশো ভাগ। মানুষেরও ঘর বঁাধতে গেলে একেবারে প্রথম শর্তই হল নিরাপত্তা। ঘরটিকে হতে হবে সম্পূর্ণ নিরাপদ। বাইরের জল, ঝড়, চোর, ডাকাত, ফেরিওয়ালা, অকারণ ভাব-ঝগড়া করতে আসা প্রতিবেশী- সবার কাছ থেকেই রক্ষা করবে আমাকে, আমার পরিবারকে- এই ভাবনা আসে একেবারে প্রথমে। এই সুরক্ষা বৃত্তের মধ্যে আমি আমার প্রয়োজনীয় দামি জিনিসপত্র রক্ষা করতে পারব। যেখানে ফিরে এলে আমাকে মুখোশ পরে থাকতে হবে না। সোজাকথায় কাচা কাপড়, বাড়া ভাত, পাতা বিছানা পাব। এমন একটি জায়গাই তো প্রতিটি মানুষের হৃদ্‌মাঝারে। ঘর বা বাড়ির ধারণা আরও অনেক কিছু চায়। সবাই যে সব পায় এমন নয়। তবু চাহিদার প্রাথমিক শর্তও যদি পূর্ণ না হয়, তাকে ঘর বলি কেমনে? আরাম ও নিরাপত্তার মাত্রার হেরফের হতে পারে। কিন্তু এই দু’টিই হল আশ্রয়ের প্রধান বালি-সিমেন্ট।

সেজন্য কাউকে যদি এমন আরামের জায়গাটা বাধ্য হয়ে ছেড়ে যেতে হয় অন্য কোনও ঠিকানায়, সে তার অব্যবহার্য অপ্রয়োজনীয় অথচ সেন্টিমেন্টের রসে চোবানো কিছু জিনিস দিয়ে ভরিয়ে রাখে নিজেকে। কখনও আসতেও পারি এমন একটা সম্ভাবনার কথা নিজের মগজে থাকলেও, অন্যের মগজে থাকা আরও জরুরি।

[আরও পড়ুন: ছাড়ের হার বাড়ালেই কি বাজার ধরা যায়? বিপণির সজ্জা নিয়ে উদাসীন বাঙালি প্রকাশকরা]

এই ঘর যে আমার অধিকার- তা যেন ভুলে না যায় চারপাশ। এই আরাম ও অধিকার বোধ থেকেই কিন্তু তৈরি হয়েছে বাড়ি বা বাসার কয়েকটা অন্ধকার দমচাপা বৈশিষ্ট্য। এর মধ্যে কোনও বিশেষ লিঙ্গের প্রতি পক্ষপাত না রেখেও বলা যায় এই দেবদুর্লভ জায়গাটা কিন্তু একেকজনের পক্ষে বিভীষিকাময়। গাহর্স্থ্য হিংসা এখনকার পৃথিবীর মাথাব্যথার অন্যতম কারণ। কী ঘটে চার দেয়ালের মধ্যে, তা বাইরের কারও পক্ষেই জানা সম্ভব না। আর সম্ভব হলেও ওটা অন্যের ব্যক্তিগত ব্যাপার বলে পাশ কাটাই আমরা সবাই। একটা হিংস্র ঘরের মধ্যে নিরুপায় কেটে যায় কত জীবন।

কী মনে হয় তাদের? যে-ঘর তাদের রক্ষক, সেটাই যদি ভক্ষক হয়, তাহলে কী ভয়ানক। যদি এইসব অসহায় সম্মিলিত হাতের মুঠি ভেঙে দিতে পারত চারপাশের দেওয়াল, তাহলে কেমন হত? কিন্তু তা হয় না। ওই যে ঘরের আরামের জন্যই। তবু তো আছে একটা আশ্রয়। তপ্ত কড়াই আর জ্বলন্ত আগুনের উপমা ভোলা যায় না সহজে।

ঘরের আর-একটা প্রতিশব্দ ‘আগার’– বিশ্রামের সঙ্গে সন্ধি হলেও সে ততটা ব্যবহৃত নয়। বরং কারাগারের সঙ্গেই যেন বেশি মিল। শব্দটা সৃষ্টি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই লেগে গিয়েছিল এই অভিশাপ যে ‘আগার’ কখনও ‘কারাগার’ হয়ে উঠতে পারে।

ঘরের মধ্যে কোনও হিংস্রতা ছাড়াও বন্দি থাকে কত জন। রাজরোষে গৃহবন্দি, রোগে বন্দি, শোকে বন্দি। কোভিডকালের হোলসেল গৃহবন্দিত্ব ভুক্তভোগী মানুষ জীবনেও ভুলবে না। এগুলো একেবারে অন্য দুর্বিপাক, কিন্তু ইচ্ছা করেই হাতে তুলে নেয় এই স্বর্ণশৃঙ্খল- এমন মানুষও আছে। হাত থেকেই তা কাঁধে উঠে যায়, আর তার চাপে কোলকুঁজো হয়ে কাটিয়ে দেয় সারাজীবন, তা টেরও পায় না।

আমরা যদি কয়েক দিনের জন্য কোথাও বেড়াতে যাই অচেনা অঞ্চলে, অদেখা-অজানার সঙ্গে সারাদিন উত্তেজনায় কাটানোর পর দিনশেষে একটা অস্থায়ী আস্তানায় ফিরে যাই। কয়েক মুহূর্তের জন্য সেটাই আশ্রয়। নিশ্চিন্তির বোধটা একইরকম। এই আরাম নিশ্চিন্তি থেকেই ছেড়ে যাওয়ার ভয়, দুঃখ, অসহায়তা। তবে সব শূন্যই কোনও না কোনওভাবে পূর্ণ হয়ে যায়। যেভাবে নদীর এক পাড় ভাঙে, অন্য তীরে জেগে ওঠে চর। সেভাবেই দেশে দেশে রচনা হয় তাসের ঘরের মতো ভঙ্গুর অগুনতি ঘর। যুদ্ধ, বন্যা, উন্নয়ন, লোভ, এমনকী নব নব প্রেমজালও কখনও হয়ে ওঠে আশ্রয়ের শত্রু। এদের ছোবলে নিমেষের মধ্যে ভেঙে যায় একটু একটু করে গড়ে তোলা ঘর। যারা নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে দিন কাটায়, ঈশ্বরের আশীর্বাদে এইসব শত্রুর একটির সঙ্গেও যাদের মোলাকাত করতে হয়নি- নিরাশ্রয় হওয়ার হাহাকার কেমন, তারা কিছুতেই বুঝবে না।

ঘরটি সবথেকে মনের মতো হয় যদি থাকে অফুরন্ত স্বাধীনতা। ঘর যেমন আসার তেমন যাওয়ারও বটে। ‘ঘরবার’ কথাটা সেজন্যই এত মিঠে। ঘরে যেতে মন চায় না বাহির যেদিন পাগল করে। আবার দ্বার খুলে সমস্ত অর্গল মুক্ত করে গৃহবাসী উদার আমন্ত্রণ জানায় সবাইকে। এই আনন্দযজ্ঞে শুধু মানুষ নয়, স্থলে জলে বনতলে দোলা লাগানো বিশ্ব প্রকৃতিকে সে তার আপন ঘরে ডেকে নেয়। এই আনন্দের ঘরটি পাননি বলেই অতুলপ্রসাদী গানে অভিমানের সুরটিই যেন জেগে থাকে বেশি। বারবার একটি প্রেম আনন্দময় ঘরের কল্পনা ঘুরেফিরে আসে তার গানে। আকুল হয়ে ডাকেন সাথীকে- এসো গো একা ঘরে। সজল নয়নে রব বল কত রাতি।

তাঁর আশা পূর্ণ হয়নি, মন গলেনি, ডাক পৌঁছয়নি ঘরের অন্দরে। তাই তো আবার গাইলেন, ‘আমি বসে আছি তব দ্বারে’। তাঁর গানের একতারাতে তাই এই সুরটিই বারবার বেজে ওঠে। ঘরটি নিরাপদ অথচ দ্বার যেখানে অবাধ উন্মুক্ত, সেই ঘরটিই সবার কামনার ধন। সেই ঘর কাঁচা হোক বা পাকা- স্বাধীন ইচ্ছার রঙে রঙিন নিজ-হাতে গড়া সেই ঘরটিই সবথেকে প্রাণময়।

[আরও পড়ুন: ছাড়ের হার বাড়ালেই কি বাজার ধরা যায়? বিপণির সজ্জা নিয়ে উদাসীন বাঙালি প্রকাশকরা]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement