উপনির্বাচনের রাজনৈতিক গুরুত্ব আসলে অন্য জায়গায়। বিজেপি দ্বিতীয় স্থানটি ধরে রাখতে পারবে, না কি সিপিএম আবার চাঙ্গা হয়ে তাদের ঘাড়ের কাছে শ্বাস ফেলবে? সেই জল্পনা উসকে উঠছে সহসা। ভোটের আগে এবং পরে রাজ্য রাজনীতির অবস্থা এক নয়। তৃণমূলের বিশাল জয়, বিজেপির ধাক্কায় বিরোধী-স্রোত পথ হারিয়ে থমকে। এই বিজেপিকে দিয়ে আর হবে কি না- সেটা নিয়ে যেমন তৃণমূল-বিরোধী ভোটারদের মনে সংশয় তৈরি হয়েছে; তেমনই সিপিএম ভেসে উঠতে খড়কুটো খুঁজছে। লিখছেন কিংশুক প্রামাণিক
ভবানীপুরে হোম ম্যাচে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে খুবই ভালভাবে জিতবেন তা নিয়ে কারও মনে সংশয় নেই। বরং তাঁর জয়ের ব্যবধান কেমন হয়, তা নিয়ে যাবতীয় জল্পনা। সদ্য শেষ হওয়া বিধানসভা নির্বাচনে বিপর্যয়ের পর এই মুহূর্তে রাজ্যে উপনির্বাচন চাইছিল না বিজেপি। ভোটের পর যেভাবে শাসক শিবিরে ফেরার হিড়িক পড়ে গিয়েছে, মাঝে মাঝেই কোনও না কোনও বিধায়ক বিজেপি ছাড়ছেন, তাতে গেরুয়া সংগঠন তছনছ। এখন ভোট মানে মরার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো। এই অসময়ে বেলতলায় ন্যাড়া কেন যাবে? কিন্তু রাজনীতি থেমে থাকে না, তাই পরিণতি জেনেও গেরুয়া শিবিরকে নামতে হচ্ছে ভবানীপুরের ভোটে।
বিধানসভা নির্বাচনে শত চেষ্টা করেও কলকাতার ধারে-কাছে একটিও পদ্মফুল ফোটেনি। বৃহত্তর কলকাতা, হাওড়ায় বিজেপি প্রায় শূন্য। মহানগরীর কোনও আসনে লড়াইয়েই ছিল না গেরুয়া শিবির। দেখা যাচ্ছে, কলকাতায় প্রায় ৫৫-৬০ শতাংশ ভোট তৃণমূল কংগ্রেসের ঘরে গিয়েছে। যা সর্বকালীন রেকর্ড। ভবানীপুরে কৃষিমন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় জেতেন ২৮,৭৯১ ভোটে। চারমাস কাটতে না কাটতে সেই আসনে উপনির্বাচন। প্রার্থী এবার স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী। এলাকার ১০ বছরের বিধায়ক। অতঃপর রাজনৈতিক অক্সিমিটার এই বার্তা-ই দেয়, পরিবর্তিত এই পরিস্থিতিতে এই ভোটে বিজেপির শ্বাসকষ্ট বাড়বে। চারমাস আগেও ভবানীপুরে যেটুকু বিরোধিতা ছিল, তা-ও গুটিয়ে যাবে।
মমতা (Mamata Banerjee) যেহেতু প্রার্থী, তাঁর প্লাস পয়েন্ট অনেক। তিনি ঘরের মেয়ে। তাঁর পরিবার বহুদিন ধরে আদি গঙ্গার পাড়ে হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটে বসবাস করে। বীরভূমের কুসুম্বা গ্রামে মামার বাড়িতে জন্ম নিলেও মমতার ‘মমতা’ হয়ে ওঠা ৩০বি-র পথের ধুলোবালি মেখেই। একচিলতে টালির ঘরে মা গায়ত্রীদেবীর স্নেহছায়ায়, প্রশ্রয়ে পা মাটিতে রেখে তাঁর আকাশছোঁয়া।
ভবানীপুর, কালীঘাট, রাসবিহারী, চেতলা, হাজরা এলাকার প্রায় প্রতিটি পরিবারকে তিনি চেনেন। বাঙালি-অবাঙালি, হিন্দু-শিখ-মুসলিম নির্বিশেষে সবার সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ক। এই সম্পর্ক আরও নিবিড় করেছে ‘জনপ্রতিনিধি’ মমতা। দৈনন্দিন পরিষেবার বাইরে বহু পরিবারের তিনি সাহারা হয়ে উঠেছেন নিঃশব্দে। ফলে দল-মত নির্বিশেষ মানুষ তাঁকে ভালবাসেন।
১৯৯১ সাল থেকে তাঁরা মমতাকে ভোট দিয়ে আসছেন। দক্ষিণ কলকাতা লোকসভা কেন্দ্রে তিনি অপরাজিত। আবার ২০১১ সাল থেকে দক্ষিণের অন্তর্গত ভবানীপুর বিধানসভা ক্ষেত্রে তিনি বিধায়ক। অতএব, চেনা বামুনের যেমন পৈতে লাগে না, তেমন ঘরের মাঠে মমতাও নিশ্চিত। তঁাকে আবার আইনসভায় পাঠাতে প্রস্তুত ভবানীপুর। বর্ধিষ্ণু শিক্ষিত এলাকা হিসাবে পরিচিত ভবানীপুর আরও জানে- তাদের মেয়েই মুখ্যমন্ত্রী। সেজন্য এই উপনির্বাচন খানিকটা নামকে ওয়াস্তে। ভোটের ফল কী হবে সবাই বুঝে গিয়েছে। তাহলে কি কোনও গুরুত্ব নেই এই উপনির্বাচনের? অবশ্যই আছে।
সবচেয়ে বড় বিষয়, সাংবিধানিক তাৎপর্য। মুখ্যমন্ত্রী এই মুহূর্তে বিধায়ক নন। তাঁকে ছ’-মাসের মধ্যে একটি আসন জিতে আসতে হবে। শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় ইস্তফা দিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর জন্য আসনটি খালি করে দেন। কিন্তু ভোট নিয়ে গত তিনমাস বিস্তর টানাপোড়েন চলে। বকেয়া আরও ছয় আসনে দ্রুত ভোটের দাবি ওঠে। বারবার কমিশনের দরজায় যায় তৃণমূল। প্রশ্ন তোলা হয়, ৩৩ শতাংশ করোনা পজিটিভিটি রেট নিয়ে বিধানসভা ভোট হতে পারে, ১.৫ শতাংশে উপনির্বাচন হবে না কেন? রাজ্যের মুখ্যসচিব এইচ. কে. দ্বিবেদী নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্স করে দ্রুত ভোটের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করেন। অবশেষে সব উৎকণ্ঠার মুক্তি।
এবার ২৯৪ আসনের মধ্যে নির্বাচন হয়েছিল ২৯২ আসনে। সামশেরগঞ্জ ও জঙ্গিপুরে প্রার্থীর মৃত্যুতে ভোট স্থগিত হয়। ভোটপর্ব মিটতেই পাঁচ আসনে উপনির্বাচনের ঘণ্টা বেজে যায়। খড়দহে জয়ী তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী ফলপ্রকাশের আগে প্রয়াত হন। মারা যান বাসন্তীর তৃণমূল বিধায়কও। দুই বিজেপি সাংসদ তাঁদের সদ্য জেতা বিধায়ক পদ ছাড়ায় শান্তিপুর ও দিনহাটা আসন শূন্য হয়। এবং ভবানীপুর। অর্থাৎ, সাতটি বিধানসভা আসনে ভোট বকেয়া হয়। যদিও আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর মুর্শিদাবাদের দু’টি আসন ও ভবানীপুরে উপনির্বাচনের দিন ঘোষণা করা হয়েছে। এতে বেজায় চটে বিজেপি। কেন শুধু মুখ্যমন্ত্রীর আসনে উপনির্বাচন, তা নিয়ে তাদের ক্ষোভ।
তবে এই উপনির্বাচনের রাজনৈতিক গুরুত্ব আসলে অন্য জায়গায়। বিজেপি দ্বিতীয় স্থানটি ধরে রাখতে পারবে, না কি সিপিএম আবার চাঙ্গা হয়ে তাদের ঘাড়ের কাছে শ্বাস ফেলবে? সেই জল্পনা উসকে উঠছে সহসা। ভোটের আগে এবং পরে রাজ্য রাজনীতির অবস্থা এক নয়। তৃণমূলের বিশাল জয়, বিজেপির ধাক্কায় বিরোধী-স্রোত পথ হারিয়ে থমকে। এই বিজেপিকে দিয়ে আর হবে কি না- সেটা নিয়ে যেমন তৃণমূল-বিরোধী ভোটারদের মনে সংশয় তৈরি হয়েছে; তেমনই সিপিএম ভেসে উঠতে খড়কুটো খুঁজছে। বিজেপিতে চলে যাওয়া ভোট ফেরানোর চেষ্টা শুরু হয়েছে। সেই আশায় বুক বেঁধে ভবানীপুরে প্রার্থী দিয়ে তৃণমূল ও বিজেপি-বিরোধী প্রচারে সিপিএম। বলা হচ্ছে, লালের ভোট লালে দিন।
লোকসভা ভোটে ১৮ আসন পাওয়ার পর বিজেপির নেতারা ধরেই নিয়েছিলেন তাঁরা ২০২১-এ ক্ষমতা পেয়ে যাচ্ছেন। স্লোগান তোলা হয়, ‘উনিশে হাফ, একুশে সাফ’। কেন্দ্রীয় নেতারা এমনভাবে ‘২০০ আসন পাব’ বলে ঘোষণা করেন যেন তুড়ি মেরে সব উড়ে যাবে! মাটির খবর না-রাখার ফল বিজেপি পেয়েছে। তাদের ভূমিশয্যা প্রমাণ করেছে, বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি। বাংলা তথা বাঙালির অনুভূতিকে গুরুত্ব না দিয়ে গো-বলয়ের কায়দায় নবান্ন দখল করতে নেমেছিলেন নরেন্দ্র মোদি (Narendra Modi), অমিত শাহরা। তাঁদের বিরুদ্ধে মমতার ‘বহিরাগত’ স্লোগান ও প্রচারে তৃণমূলের ‘বাংলা নিজের মেয়েকে চায়’ থিম বাজিমাত করে। বাছবিচার না করে তৃণমূল নেতাদের দলে নেওয়া-সহ আরও নানা ভ্রান্তি বিজেপিকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেয়।
সেই বিস্তারিত আলোচনা অনেক হয়েছে। আসল কথা হল, রাজনীতিতে জয়-পরাজয় থাকেই। কিন্তু পরাজয়ের হতাশায় ক্ষয়রোগ গ্রাস না করে। ২০১১ সালে হারের পর সিপিএমের তেমন দশা হয়। ১০ বছর ধরে বাম-ভোট চলেই যাচ্ছে বিজেপিতে। তার পরিণতিতে এবার বিধানসভায় বামফ্রন্টের কোনও প্রতিনিধি নেই। সিপিএম-এর ভোট ৪.৭ শতাংশ। এমতাবস্থায় ভবানীপুর তাদের কাছে পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনা হতে পারে। বিজেপিতে চলে যাওয়া ভোট ঘরে ফেরানোর অ্যাসিড টেস্ট। বিজেপিতে মোহভঙ্গ হচ্ছে অনেকের। তৃণমূলের লোকেরা বিজেপি ছাড়ছেন। সিপিএম এর লোকজন এখন কী করবেন? ভবানীপুর রহস্য ভেদ করবেন?
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.