Advertisement
Advertisement

Breaking News

CRPF

‘জঙ্গি রোখার চেয়ে কঠিন মায়ের ফোন’, বলছেন ভূস্বর্গে মোতায়েন বাঙালি জওয়ানরা

দিন-মাসের হিসেব নেই, শত্রুদমনই একমাত্র লক্ষ্য এই সিআরপিএফ জওয়ানদের।

The Bengal brave hearts guarding the Kashmir valley। Sangbad Pratidin

প্রতীকী ছবি।

Published by: Biswadip Dey
  • Posted:June 16, 2022 2:03 pm
  • Updated:June 16, 2022 2:06 pm  

কৃষ্ণকুমার দাস, গুলমার্গ: ”মানুষ যখন অবাক বিস্ময়ে রঙিন ফুল আর বরফে ঘেরা ঐশ্বরিক সৌন্দর্য দেখেন আমরা তখন শুধু তাঁদের দিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখি। হাজার হাজার পর্যটক যখন প্রকৃতির রূপে মুগ্ধ হয়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলেন আমরা তখন তাঁদের সন্ত্রাসীদের কুদৃষ্টি থেকে আগলে রাখি। সাদা বরফে মোড়া পাইন গাছের আড়াল থেকে যাতে কোনও গরম সিসার গুলি ছুটে না আসে সেটা দেখাই আমাদের একমাত্র ডিউটি। বলতে পারেন, ‘ভয়ংকর সুন্দরী’র সঙ্গে ঘর করছি গত চার বছর ধরে। নভেম্বর থেকে মার্চ, প্রায় পাঁচমাস বরফ। আর সাত মাস গরম-বৃষ্টি, কোথা থেকে যে মাসগুলো পেরিয়ে যাচ্ছে তা টেরই পাই না। কবে লক্ষ্মীবার, আর কবে রবিবার তার হিসাব অনেকদিন আগে ভুলে গিয়েছি। একটাই টার্গেট, শত্রু দেখলেই খতম করো।” চোয়াল শক্ত করে এক নিশ্বাসে কথা বলে থামলেন কাশ্মীরের (Kashmir) গুলমার্গ গন্ডোলা নামের রোপওয়ের প্রবেশপথে ডিউটি করা বাঙালি CRPF জওয়ান সুজিত কাহালি।

এই যে এখানে সৌন্দর্যের অমরাবতীতে আপনি আছেন, পরিবারের লোকেদের দেখাতে পারছেন না তার জন্য কষ্ট হয় না? প্রশ্ন শেষ হওয়া মাত্রই সপাট উত্তর, ”মোটেই না। ওরা তো কেউ আসতেই চায় না। উলটে কাশ্মীরে কোথাও জঙ্গি হামলা হলেই বাড়ি থেকে ফোন আসা শুরু হয়ে যায়। কিন্তু সব সময় নেটওয়ার্ক থাকে না, আর তাতেই ঘরের লোকের চিন্তা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। তাই যে করেই হোক, জঙ্গি হানা সামলানোর পাশাপাশি পরিবার সামাল দিতে কোনও মাধ্যমে পরিবারের কাছে খবর দিতে হয়। কলকাতায় টিভিতে ‘ব্রেকিং’ দেওয়ার আগেই জানিয়ে দিতে হয়, এখানে কিছু হয়নি, অনেক দূরের ঘটনা। আমি বেঁচে আছি।” ইস্পাত কঠিন চোয়ালে এবার ফিক করে হাসি খেলে যায় খড়গপুরের সুজিতের মুখে।

Advertisement

[আরও পড়ুন: দশদিনে দ্বিতীয়বার, পরমাণু ক্ষেপণাস্ত্রের সফল উৎক্ষেপণ ভারতের ]

শ্রীনগরের (Srinagar) লালচক থেকে গুলমার্গ, পহেলগাঁও, কেশর খেত থেকে কাশ্মীরি শাল তৈরির ফ্যাক্টরি, যেদিকে চোখ যাচ্ছে দেখছি সর্বত্র স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে সিআরপিএফ। যেখানে যত বেশি সৌন্দর্য, সেখানে তত বেশি চাপা আতঙ্ক, না হলে সেই স্পটে কেন বেশি সংখ্যায় কেন্দ্রীয় বাহিনীর রুটমার্চ থাকবে? আবার ৯১, ৯৫, ১১৯ ব্যাটেলিয়নে বাঙালি জওয়ান বেশি। আস্তে আস্তে, নিচু গলায় কিছুটা গোপন রহস্য ফাঁস করার মতো কথাগুলি বলছিলেন প্রশান্ত মোদক। নদিয়ার বেথুয়াডহরির এই পাঁচ ফুট নয় ইঞ্চির যুবক মাত্র ছয় বছর আগে কেন্দ্রীয় বাহিনীর সদস্য হয়েছেন। তার মধ্যে প্রায় পাঁচ বছরই কাশ্মীরে ডিউটি করছেন। বাড়িতে মা, বাবা ও দুই বোন। সেই বড়, ছোট বোন এবার মাধ্যমিকে ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছে। কলেজ জীবনের প্রেমিকা সিআরপিএফে যোগ দিতেই আর বিয়ে করতে রাজি হয়নি।

তবে চাকরিতে যোগ দেওয়ার পর একই ব্যাটালিয়নে আরও দুই বাঙালির সঙ্গে প্রশান্তর খুব ভাব হয়েছে। একজন জয়দেব, বাড়ি মুর্শিদাবাদের জলঙ্গিতে। অন্যজন মুস্তফা লস্কর, উত্তর দিনাজপুরের কৃষক পরিবারের ছেলে। শিফটিং ডিউটির কারণে একসঙ্গে তিনজনের দেখা ও আড্ডা খুবই কম হয়। চাপা ক্ষোভ নিয়ে প্রশান্তর অভিযোগ, “ডিউটি রোস্টার করার সময় দায়িত্বে থাকা পাঞ্জাবি অফিসারই আমাদের আলাদা করে রাখে। বলে, আমরা নাকি ডিউটিতে গিয়ে শুধু আমাদের মুখ্যমন্ত্রী মমতাদির গল্প করি।” তবে প্রশান্ত যে সুযোগ পেলে গল্প করতে ভালবাসে তা গুলমার্গ বেসক্যাম্প থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে ট্যাঙ্কের মতো সাঁজোয়া গাড়ির আড়ালে দাঁড়িয়ে কথা বলার ফাঁকে স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম।

[আরও পড়ুন: কেন্দ্রের ‘অগ্নিপথ’ প্রকল্পের প্রতিবাদে উত্তাল বিহার, পুলিশকে লক্ষ্য করে পাথর, পালটা কাঁদানে গ্যাস]

লুকিয়ে নিজের ফোন থেকেই অন্য উপত্যকায় ডিউটিতে থাকা মুস্তফার সঙ্গে কথা বলিয়েও দেয় এই বেথুয়াডহরির ডানপিটে, মিশুকে যুবক। কাশ্মীরে ডিউটি করতে ভয় লাগে না? বাড়ির লোকজন চিন্তা করে না? আশপাশে জঙ্গি হামলা হলে তখন কি ভয় আরও বেড়ে যায়? ঘণ্টার পর ঘণ্টা অজানা শত্রুর দিকে স্টেনগান তাক করে ধৈর্য হারিয়ে ফেললে কী করতে ইচ্ছে হয়? তিনজনকেই একই প্রশ্ন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে করে প্রবাসে বাঙালি জওয়ানদের মনের কোণে জমা হওয়া গুপ্ত খবর ও সুপ্ত ইচ্ছাগুলি জানার চেষ্টা করেছি। আসলে ওঁদের যেমন কমান্ডারের নির্দেশে সৌন্দর্য ছেড়ে শত্রু দেখে তেমনি আমিও এডিটোরিয়াল ক্যাপ্টেন কুণাল ঘোষের কথা মাথায় রেখে সফরে এসে ভূস্বর্গে ডিউটিতে থাকা বঙ্গ-জওয়ানদের যন্ত্রণা খুঁজতে নেমেছিলাম।

সফরসঙ্গী বন্ধু মিঠু বারবার সতর্ক করেছে, “দূরে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করবে। না হলে, তাক করে রাখা একে ৪৭ থেকে যখন তখন গুলিবৃষ্টি হতে পারে। জঙ্গি না পেয়ে তোমায় ঝাঁঝরা করে দিতে পারে।” তবে সুজিত বা প্রশান্তরা সবাই একবাক্যে স্বীকার করেছেন, “জঙ্গি হানার চেয়েও পরিবারের দুশ্চিন্তা সামাল দেওয়া বেশি কঠিন। আর যত নষ্টের গোড়া ওই টিভি চ্যানেলের ব্রেকিং নিউজ। অনেক সময়, সীমান্তে তিনদিনের পুরনো গুলি বিনিময় টাটকা ব্রেকিং দিতেই বাড়ির লোকেরা টেনশনে পড়ে যান।” অবশ্য কোভিডের জেরে গত দু’বছর ধরে সন্ত্রাসী হানা ‘অনেকটা কম’ বলে দাবি কেন্দ্রীয় বাহিনীর বঙ্গ সদস্যদের। গুলমার্গ-পহেলগাঁও জোনে ডিউটি করা দুই বঙ্গভাষী যুবকের কথায়, “বারামুলা বা সোপোরে জঙ্গিরা একটা গুলি চালালেও বাড়ি থেকে ফোনের বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। ওরা বুঝতে চায় না, যে আমরা প্রায় ১০০ কিমি দূরে আছি।” আসলে উত্তর দিনাজপুরের প্রত্যন্ত গ্রামের কৃষককে বোঝানো কঠিন, গুলমার্গ আর বারামুলার দূরত্ব কতখানি। বাড়ির লোকেদের আর দোষ দেব কেন? কৈফিয়ত মেশানো সুর মুস্তাফার গলাতে।

সামরিক নিয়ম মেনে ডিউটিতে থাকার সময় বাইরের কোনও মোবাইলে ছবি তোলা নিষেধ। আমাদের মতো সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলা তো মৃত্যু পরোয়ানায় সই করা। ইচ্ছে থাকলেও ক্যামেরার সামনে তাই দাঁড়াতে পারলেন না। শুধু দূর থেকে বাঙ্কার গাড়ির মাথায় ডিউটি করার ছবি তুলতে দিলেন। এরই মধ্যে অফিসারের নির্দেশ এসে যেতেই চলে যাচ্ছিলেন খড়গপুরের সুজিত। তার আগে বললেন, দূরে কোথাও হয়তো হামলা হচ্ছে, আমরা পজিশন নিয়েছি কোনও দুর্গম পয়েন্টে। আর ঠিক তখনই বাড়ি থেকে মা, বোন, কাকিমা, পিসিরা ফোন করতে শুরু করে দেন। সমস্যা হয়, যদি মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকে। ঘরের লোকেরা এতটাই অবুঝ হয়ে পড়েন, কী আর বলব? অবশ্য ওদের কষ্ট বুঝি, তাই যে করে হোক জানানোর চেষ্টা করি, আমি সুস্থ আছি। তড়িঘড়ি উত্তর দিয়ে চলে যান বিদ্যাসাগরের জেলার লড়াকু জওয়ান।

জঙ্গি হানার মুহূর্তে বাড়িতে থাকা লোকেদের নিয়ে আরও একটা সমস্যার কথা বলছিলেন প্রশান্ত। বললেন, “ধরুন, আমি যেখানে আছি সেখানে মোবাইল নেই। মুস্তফাকে বললাম, বাড়িতে জানিয়ে দে তো ভাই। তাতে ফল হল, উলটো। মা, কাঁদতে বসে গেলেন। ওরে কী হয়েছে ছেলের, তোরা কেন ফোন করছিস? এমন দু’দুবার হয়েছে, কী করা যায়, বলুন তো। মা’কে বোঝাই কী করে?”

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement