দীপংকর দাশগুপ্ত: ৮ জুন ‘ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক’ পত্রিকার একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, থাইল্যান্ডে কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা ছিল সামান্যই– ৩,১৩৫ জন এবং মৃত্যুসংখ্যা ৫৮। সাম্প্রতিকতম ‘দ্য ইকনমিস্ট’ পত্রিকা জানাচ্ছে যে, আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩,৭০৯ ও মৃতের সংখ্যা ৫৯ জন। এটুকু নিশ্চয়ই অনুমান করা যায় যে, বহু দেশের তুলনায় থাইল্যান্ডে (Thailand) কোভিড মহামারীর আক্রমণ অনেকটাই কম। আর এই অনুমান যে নির্ভরযোগ্য, তার আরেকটি প্রমাণ হল ১০ অক্টোবর থাইল্যান্ডে প্লেনভর্তি চিনা পর্যটকদের আগমন। এই ঘটনা থাইল্যান্ডের ঝিমিয়ে পড়া অর্থনীতির পক্ষে নিঃসন্দেহে আশাজনক।
ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের লেখক জানাচ্ছেন যে, থাইল্যান্ডে দুর্নীতির অভাব নেই, বিশেষ করে স্বাস্থ্যমন্ত্রকে। তা সত্ত্বেও কোভিড আক্রমণ থেকে সাধারণ মানুষ অনেকটাই সুরক্ষিত। কারণ হিসাবে লেখক বলছেন যে, অনেক দিন আগে থেকেই মারাত্মক পরিবেশ দূষণের কারণে থাইল্যান্ডের অন্তত ৯৫ শতাংশ অধিবাসী মাস্ক ব্যবহার করতে অভ্যস্ত। ফলে, যদিও চিনের পর প্রথম কোভিড আক্রান্ত ধরা পড়ে থাইল্যান্ডেই, তবুও সেদেশে মাস্ক পরার অভ্যাসের জন্য, অন্তত আক্রান্ত বা মৃতের সংখ্যার হিসাব ধরে এগলে, কোভিডের আঘাত বড় মাপের নয়।
অবশ্য থাইল্যান্ডেও লকডাউন জারি ছিল। তাই অন্যান্য অনেক দেশের মতো অর্থনৈতিক সংকট সেখানেও যথেষ্ট দেখা দিয়েছে। ২০২০ সালে থাইল্যান্ডের জাতীয় উৎপাদনে ৮ শতাংশ অর্থনৈতিক সংকোচন ঘটবে বলে কোনও কোনও মহলে বিশ্বাস। আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে প্রায় ৫ লক্ষ ছাত্র-ছাত্রী বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে বেরবে। তাদের চাকরির বাজার কেমন হবে, তাই নিয়ে তারা ঘোর আশঙ্কায়। কাজেই কোভিডের ভয় কম হলেও পেটের জ্বালার দুশ্চিন্তা থেকেই গিয়েছে।
কোভিডের ভ্যাকসিন এখনও বেরিয়েছে বলে নিশ্চিতভাবে কিছু শোনা যায়নি। কিন্তু কোভিডের ফলে বিশ্বের সমস্ত অর্থনীতিই খোঁড়াচ্ছে। এবং অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য নানা উপায়ে মানুষের হাতে অর্থের জোগান দিয়ে যাচ্ছে সরকার। ভারত সরকার কি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারও সেই একই রাস্তায় হঁাটছে। মানুষের হাতে টাকা থাকলে খরচ বাড়বে, চাহিদা বাড়বে, ফলে দুর্দশাগ্রস্ত উৎপাদক সম্প্রদায় কিছুটা স্বস্তির শ্বাস ফেলবে এমনটাই ধারণা। কিন্তু এই স্বস্তি কি দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে? যতক্ষণ না কোভিডকে কবলে আনা যাচ্ছে, হয়তো গুদামে জমা মাল বিক্রি হবে সরকারের দয়ায়। কেবল নতুন উৎপাদন এবং কর্মসংস্থান কেমন করে স্থায়ী গতিতে বাড়বে, সেটা বোঝা মুশকিল। মানুষের হাতে খরচের টাকা তুলে দেওয়া যে একটি ‘অর্থনৈতিক দাওয়াই’, তা বলা বাহুল্য। তবে এই দাওয়াইয়ের সাহায্যে কি মানুষের শরীরের রোগ সারে? সারে না। রোগ যে-ওষুধে সারে, সেই ওষুধ অর্থনীতির কেতাবে নির্দেশ করা নেই।
কেইনসীয় অর্থনীতি অনুযায়ী, চাহিদা বাড়িয়ে তোলার প্রয়োজন অবশ্যই রয়েছে। শুধু, যে-মন্দার কবলে আমরা পড়েছি তার মূল কারণ এমন একটি রোগ, যা, ডাক্তার অল্পস্বল্প হয়তো বা বোঝেন, অর্থনীতিবিদ একেবারেই বোঝেন না। এবং এখনও পর্যন্ত সমগ্র পৃথিবীর ডাক্তাররা মিলেও রোগটির মোকাবিলা করতে পারছেন না। তাই একটা কথা বোঝা বিশেষ দরকার। মন্দার থেকে নিষ্কৃতি পেতে হলে মূলত প্রয়োজন ডাক্তারি ওষুধের। অর্থনৈতিক ওষুধেরও দরকার আছে, তবে সে ওষুধে মন্দা যাবে না। ১৯৩০-এর ‘মহামন্দা’-র সঙ্গে আজকের মহামারীজনিত মন্দার এটাই সবচেয়ে বড় তফাৎ।
ডাক্তারি ওষুধ কবে আসবে, জানা নেই। তাই থাইল্যান্ডের একেবারে সাধারণ মানুষের অনুকরণে কোভিড (Covid-19) হয়তো কিছুটা আটকানো যেতে পারে। হাওয়ায় ভাসতে থাকলেও শরীরে সে ঢুকতে পারবে না। এবং তখন লকডাউনের প্রয়োজনও হয়তো কমবে, হয়তো কলকারখানাতেও অল্পস্বল্প প্রাণ ফিরে আসবে। কেবল ‘হয়তো’ কথাটার গুরুত্ব এখানে খুবই বেশি। থাইল্যান্ডের রাস্তায় নাকি মাস্ক পরা না থাকলে, অন্যান্য পথচারী সেটা মেনে নেয় না। অর্থাৎ পুলিশ দিয়ে মারধর করার দরকার নেই, নিজের স্বার্থেই লোকজন আন্দোলন করে। ফলে রোগের সংক্রমণ হয়েছে কম এবং অর্থনীতিতে আশা করা যায়, আবার কিছুটা হলেও গতি ফিরে আসবে।
সাধারণ মানুষ যে ব্যাপারটাকে লঘু দৃষ্টিতে দেখছে না, তার প্রমাণ পাওয়া গেল সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গেই। সঠিক তথ্যাবলি পরে নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে, কিন্তু এখনও পর্যন্ত পুজোর বাজারে যেটুকু দেখা গেল, সেটা কোভিড নিরাময়ের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে আশাজনক। এই লেখকের কলকাতা-বাসের অভিজ্ঞতায় এমন জনমানবশূন্য পুজোর স্মৃতি নেই। সরকারেরও হয়তো কিছুটা হাত ছিল, কিন্তু সন্দেহ হয় যে, নিজের স্বার্থেই মানুষ রাস্তাঘাট, পুজোমণ্ডপ এড়িয়ে চলেছেন। যানজট পর্যন্ত বিশেষ দেখা গেল না। সরকার থেকে যখন ঘোষণা করা হয় যে, দুর্গাপুজোয় লকডাউন থাকবে না, তখন অনেকেই আতঙ্কিত হয়েছিলেন যে, একটি নতুন সংক্রমণের ঢেউ আবার এগিয়ে আসছে। কিন্তু যেভাবে পুজো কাটল, তাতে আশা, সংক্রমণের হার হয়তো বাড়বে না। এই আশা যদি অলীক না হয়, তবে থাইল্যান্ডের মতো আমরাও হয়তো কিছুটা আলোর সন্ধান পাব।
কিন্তু পাশাপাশি মনে রাখতে হবে যে, এই জনমানবহীন পুজোয়, এমনকী, ফুচকাওয়ালারও বিক্রি হয়তো কম হয়েছে। সেই অতিসাধারণ উৎপাদকটির জীবিকা সরকারি অনুদানের ফলে কিছুটা রক্ষিত হলেও ব্যাপারটা দীর্ঘস্থায়ী হবে না। তাই যতদিন না ওষুধের আবির্ভাব হচ্ছে, থাইল্যান্ডের জনতার মতো মাস্কের ঢাল দিয়ে কোভিডের সঙ্গে লড়াই চালানোটা একান্ত জরুরি। ওষুধ আসার আগে পর্যন্ত এই পথে চললে অর্থনীতি সামান্য হলেও ঘুরে দাঁড়াবে।
(মতামত নিজস্ব)
লেখক আইএসআই-এর ভূতপূর্ব অধ্যাপক
[email protected]
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.