বাজেট-বক্তৃতার পর অনেকেই বিপাকে, আয়করে কত ছাড় পাবে কি পাবে না। এই বিভ্রান্তি দূর করতেই আয়কর বিশেষজ্ঞর টুপি মাথায় গলানো। ধরা যাক, আপনার বাৎসরিক আয় ৮ লক্ষ টাকা। তাহলে কি আপনাকে কেবল ৮ লক্ষ টাকার উপর আয়কর দিতে হবে? প্রশ্নের উত্তর হল, না। লিখছেন দীপংকর দাশগুপ্ত
আমি আয়কর বিশেষজ্ঞ নই, যদিও অনেকেই ‘অর্থনীতিবিদ’ ও ‘আয়কর বিশেষজ্ঞ’-র মধ্যে বিশেষ কোনও তফাত দেখেন না। অবশ্য অর্থনীতিবিদের সঠিক সংজ্ঞা দেওয়া আমার উদ্দেশ্য নয়, অন্তত এই লেখায়। আজকের ‘অর্থনীতিকথা’ হয়তো বা কোনও আয়কর বিশেষজ্ঞেরই লেখা উচিত ছিল। আমার জানা নেই, এমন হতেই পারে যে, আয়কর বিশেষজ্ঞরা এ বিষয়ে লিখেছেন। লিখে থাকুন আর না-ই থাকুন, আমি তাঁদের টুপি মাথায় দিতে বাধ্য হলাম, কারণ এই কলামের জনৈক পাঠক আমাকে অনুরোধ করেছেন এ বিষয়ে কিছু আলোকপাত করতে। পাঠক মহাশয় জানিয়েছেন যে, তিনি বরিষ্ঠ নাগরিক (আমি নিজেও তাই) এবং ১ ফেব্রুয়ারির বাজেট বক্তৃতা শুনে তিনি বুঝতে পারছেন না তিনি আদৌ আয়কর (Income Tax) খাতে ৭ হাজার টাকা ছাড় পেতে পারেন কি না।
তঁার এই প্রশ্নের জবাব দিতে গেলে কর-কাঠামো সম্পর্কে দু’-চারটি কথা বলে নেওয়া প্রয়োজন। প্রথমেই যে-কথাটা বুঝে নেওয়া দরকার, তা হল আয়করের পরিপ্রেক্ষিতে ‘আয়’ শব্দটার অর্থ কী। ধরা যাক, আপনার বাৎসরিক আয় ৮ লক্ষ টাকা। তাহলে কি আপনাকে কেবল ৮ লক্ষ টাকার উপর আয়কর দিতে হবে? প্রশ্নের উত্তর হল, না। সঠিক উত্তর জানতে হলে প্রথমে আপনার ‘করযোগ্য আয়’ কত, সেটির হিসাব করতে হবে।
বর্তমানে, দু’টি কর কাঠামো চালু আছে। এদের আমরা ‘পুরনো’ ও ‘নতুন’ বলে উল্লেখ করব। পুরনো কাঠামোয় আয়করের উপর নানা জাতীয় বিনিয়োগ সংক্রান্ত ছাড় পাওয়া যায়– যেমন মেডিক্লেম, পাবলিক প্রভিডেন্ট ফান্ড, স্ট্যান্ডার্ড ডিডাকশন ইত্যাদি। এসব মিলিয়ে ১ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা অবধি ছাড় পাওয়া সম্ভব, যদিও নতুন কাঠামোয় ছাড়ের নিয়ম সম্পূর্ণ আলাদা। সে-সম্পর্কে পরে বলছি। আপাতত পুরনো কাঠামো অনুযায়ী ধরে নেওয়া যাক যে, বিভিন্ন ছাড় বাবদ আপনি অর্থবর্ষে ১ লক্ষ টাকা বিনিয়োগ করেছেন। সেক্ষেত্রে আপনার মোট ৮ লক্ষ টাকা আয় থেকে ১ লক্ষ টাকা বাদ দিয়ে যে বিয়োগফলটি পড়ে থাকে, তাই হল আপনার করযোগ্য আয়। পুরনো কাঠামোয় এই ৭ লক্ষ টাকার উপর কিন্তু আপনাকে কর দিতে হয়।
কত কর দিতে হয়? পুরনো কাঠামোয় আপনার করযোগ্য আয়ের উপর ২ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত করের হার শূন্য। ২ লক্ষ ৫০ হাজার থেকে ৫ লক্ষ অবধি করের হার ৫ শতাংশ। ৫ লক্ষ থেকে ১০ লক্ষের উপর কর ২০ শতাংশ, এবং ১০ লক্ষের উপর করের হার ৩০ শতাংশ। তাহলে আপনার ৭ লক্ষ টাকার উপর কত কর ধার্য হল? ২ লক্ষ ৫০ হাজার অবধি কর নেই। ২ লক্ষ ৫০ হাজার থেকে ৫ লক্ষ পর্যন্ত কর ১২ হাজার ৫০০ টাকা। এবং ৭ লক্ষ টাকা থেকে ৫ লক্ষ টাকার বিয়োগফলের উপর ২০ শতাংশ হারে কর হবে ৪০ হাজার টাকা। অর্থাৎ, আপনার দেয় কর হবে ৫২ হাজার ৫০০ টাকা। এর বাইরেও করের উপর ৪ শতাংশ কর আছে। এটিকে ইংরেজিতে ‘সার-ট্যাক্স’ (surtax) বলা হয়। সেটি ধরে নিলে আপনাকে আরও ২ হাজার ১০০ টাকা কর দিতে হবে, অর্থাৎ সব মিলিয়ে ৫৪ হাজার ৬০০ টাকা।
এই উদাহরণটি থেকে যা বুঝলাম, তা হল, পুরনো কাঠামো ধরে এগলে ১ ফেব্রুয়ারির বাজেট আপনার ৮ লক্ষ টাকা আয় থেকে ৭ লক্ষ টাকা বিয়োগ করে কেবলমাত্র ১ লক্ষ টাকার উপর কর দেওয়ার সুযোগ দেয়নি। এবার নতুন কর-কাঠামোয় আসা যাক। ২০২১-’২২ অর্থবর্ষ থেকে করদাতাদের জন্য পুরনো কর-কাঠামোর পাশাপাশি একটি ‘বিকল্প’ নতুন কর কাঠামো চালু হয়েছে। নতুন কাঠামোয় করের হার বদলেছে। এছাড়া বিভিন্ন খাতে যে সমস্ত বিনিয়োগ বাদ দিয়ে করযোগ্য আয় হিসাব করার প্রথা ছিল, সেগুলিও উঠিয়ে দেওয়া হয়। এবং ৫ লক্ষ টাকা করযোগ্য আয় অবধি আয়কর উঠে যায়। (হে পাঠক/ পাঠিকা, আয় এবং করযোগ্য আয়ের মধ্যে তফাত ভুলে পথ হারাবেন না।) এই বছর বাজেটে নতুন কী হল? সবচেয়ে বড় কথা হল, নতুন কর-কাঠামোর পরিবর্তন। পুরনো কাঠামো যা ছিল, তা-ই থাকল। নতুন কাঠামোয় আবার ছাড় ফিরে এল। সবরকম ছাড় নয়, কেবল ‘স্ট্যান্ডার্ড ডিডাকশন’। যেটুকু বোঝা গিয়েছে, নতুন কাঠামোয় আপনার ৮ লক্ষ টাকা আয় থেকে স্ট্যান্ডার্ড ডিডাকশন বাবদ ৫০ হাজার টাকা বাদ দিয়ে ‘করযোগ্য আয়’ হিসাব করার সুযোগ পেলেন। আর কোনও ছাড় নেই। তাহলে আপনার করযোগ্য আয় হল ৭ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা। এছাড়া করের হারেও পরিবর্তন এসেছে। এবার এই করযোগ্য আয়ের উপর করের হার লাগিয়ে আপনি কর দেবেন।
বিত্তমন্ত্রীর উদাহরণে করদাতার মোট করযোগ্য আয় ধরা যাক ১৫ লক্ষ টাকা। গত বছরের নতুন কর-কাঠামোয় যেহেতু কোনও ছাড় ছিল না, তাই আয় এবং করযোগ্য অায়ের মধ্যেও তফাত নেই। গত বছর যঁারা নতুন কর কাঠামো অনুযায়ী চলেছিলেন, ২০২২-’২৩ অর্থবর্ষে যদি তাঁরা পুরনো কাঠামোয় না ফিরে যান, তবে তাঁদের মোট আয় ধরে নিতে হবে ১৫ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা। স্ট্যান্ডার্ড ডিডাকশনের ফলে করযোগ্য আয় হবে বিত্ত মন্ত্রীর উদাহরণ অনুযায়ী ১৫ লক্ষ টাকা। গত বছর তাঁরা যেমন চলেছিলেন, সেই একই নিয়মে এই বছরেও কর দেবেন। যদিও করের হারে পরিবর্তন আছে। (আবারও বলি, পথ হারাবেন না। ১ ফেব্রুয়ারির ঘোষণা অনুযায়ী, কর ধার্য হবে ২০২৩-’২৪-এর আয়ের উপর। কিন্তু সেই আয়কর রিটার্ন জমা হবে ২০২৪-এ)। তঁারা পুরনো কাঠামোতেও ফিরে যেতে পারেন। সে হবে অপর এক হিসাব।
তবে আমার অনুমান, পুরনো কাঠামো আস্তে আস্তে উঠে যাবে। দেখা গিয়েছে, নতুন কর কাঠামো ধরে চললে, মোট ১৫ লক্ষ টাকার উপর কর ২০ শতাংশ কমে যাবে, ১ লক্ষ ৮৭ হাজার ৫০০ টাকা থেকে ১ লক্ষ ৫০ হাজারে। পুরনো কাঠামো ধরে চললে, আয়কর হবে ২ লক্ষ ৩২ হাজার ৫০০ টাকা। এবং এই তিনটি সংখ্যার উপরেই ৪ শতাংশ সার-ট্যাক্স থাকবে। যে বরিষ্ঠ নাগরিক আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন, তঁার জন্য আরও একটি খবর আছে। বরিষ্ঠ নাগরিকদের জন্য বেশি সুদে ১৫ লক্ষ টাকার স্থায়ী আমানতের ব্যবস্থা সরকার থেকে করা হয়েছিল। সেই বিনিয়োগের সুযোগও বেড়ে ৩০ লক্ষ টাকা হয়ে যাবে, খুব সম্ভবত ১ এপ্রিল থেকে। এই আমানতের সুদের উপর অবশ্যই কর বসবে। বাজেটে কর নিয়ে আরও আলোচনা রয়েছে। কিন্তু আজকের আলোচনায় আমি কেবল যে-প্রশ্নটি পাঠক মহাশয়ের কাছে পেয়েছি, তারই উত্তর দেওয়ার প্রয়াস পেলাম।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.