Advertisement
Advertisement
Padma bridge

প্রমত্ত পদ্মার বুক চিরে

কেউ বলছে স্বপ্নের সেতু, কেউ বলছে গর্বের।

Taming the Padma river, a bridge of Bengali prowess | Sangbad Pratidin
Published by: Monishankar Choudhury
  • Posted:June 23, 2022 1:38 pm
  • Updated:June 23, 2022 1:38 pm  

বাংলাদেশের উন্নয়নের ইতিহাসে ‘পদ্মা সেতু’ শুধু এক চমকপ্রদ অধ্যায়ই নয়, এক দুরন্ত মাইলফলক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চোখে যারা ‘ষড়যন্ত্রকারী’, ‘অসহযোগী’, পদ্মা সেতু উদ্বোধনে তাদের সবাইকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তিনি। এই শিষ্টাচারিতা নিঃসন্দেহে রাষ্ট্রীয় স্বার্থে গঠনমূলক রাজনীতির ইঙ্গিতবাহী। প্রকৃত গণতন্ত্রের বিকাশ ও আইনের শাসনের সুপ্রতিষ্ঠা, যে-দুই বিষয়ে হাসিনা সরকার এখনও প্রশ্নবিদ্ধ, সমালোচনার সেই ব্যুহভেদ আসন্ন। লিখছেন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়

 

Advertisement

কেউ বলছে স্বপ্নের সেতু, কেউ বলছে গর্বের। অস্থিরমতি, প্রবল খরস্রোতা, প্রমত্ত পদ্মা শাসন করে অবশেষে যে সেতু বাংলাদেশের সাফল্যের মুকুটে ঝলমলে পালক হতে চলেছে, তা বাঙালির আত্মনির্ভরতার প্রতীক। বাঙালি কী পারে, কত নিপুণভাবে পারে, ‘পদ্মা সেতু’ তা দেখিয়ে দিল। আগামী শনিবার, ২৫ জুন, পদ্মা সেতুর উদ্বোধন অবশ্যই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাড়তি শ্লাঘা। তাঁর জেদ ও একাগ্রতা বাংলাদেশের শুধু মর্যাদাই বাড়ায়নি, প্রমাণ করেছে হাজার প্রতিকূলতা সত্ত্বেও একাগ্রচিত্তে লক্ষ্যে অবিচল থাকলে অসম্ভব কিছুই নয়।

সেতু বহু আছে। প্রতিটি সেতুর সঙ্গেই জড়িয়ে ভাল-মন্দ, কথিত-অকথিত বহু কাহিনি। পদ্মা সেতুও ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু এর বিশেষত্ব ভিন্ন। পদ্মা এত খরস্রোতা যে, তাকে শাসন করা অত্যন্ত কঠিন। ৩০ বছরে এই নদী আড়াআড়িভাবে ১৫ থেকে ২০ কিলোমিটার গতিপথ পরিবর্তন করেছে। ১৫-২৫ মিটারের স্বাভাবিক গভীরতা বর্ষায় বেড়ে হয় ৬০ মিটার। নদীর তলদেশে পাথর না-থাকায় সেতুর পাইলিং ছিল সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। কাদামাটির কারণে ১২২ মিটার গভীরে পাইল বসাতে হয়েছে। পৃথিবীর আর কোনও নদীতে এত গভীরে পাইল বসানো হয়নি। ভূমিকম্পের ঝুঁকি কমাতে ব্যবহৃত হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ও শক্তিশালী পেন্ডুলাম বিয়ারিং। ৩ হাজার ৬০০ টন ভার তোলার ক্ষমতাসম্পন্ন ভাসমান ক্রেন দিয়ে বসানো হয়েছে ইস্পাতের স্প্যান। জার্মানি থেকে বানিয়ে আনা হয়েছে বৃহত্তম ও সবচেয়ে শক্তিশালী হ্যামার। প্রকৌশলীদের কাছে পদ্মা সেতু নির্মাণ শুধু কঠিনই ছিল না, ছিল অতীব দুঃসাহসের কাজ।

[আরও পড়ুন: ‘জঙ্গি রোখার চেয়ে কঠিন মায়ের ফোন’, বলছেন ভূস্বর্গে মোতায়েন বাঙালি জওয়ানরা]

বিস্ময়কর প্রযুক্তি যদি হয় পদ্মা সেতুর প্রধান বিশেষত্ব, দ্বিতীয়টি নিজের অর্থায়নে তা নির্মাণ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শ্লাঘা এটাই, একপয়সাও বিদেশি সাহায্য নেননি। এর মধ্য দিয়ে অনেক ‘আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র ও অপমান’-এর জবাবও তিনি দিয়েছেন। বাংলাদেশের উন্নয়নের ইতিহাসে পদ্মা সেতু তাই শুধু চমকপ্রদ অধ্যায়ই নয়, এক দুরন্ত মাইলফলকও।

যমুনার উপর ‘বঙ্গবন্ধু বহুমুখী সেতু’ তৈরির সময় ঋণ দিয়েছিল ‘বিশ্ব ব্যাংক’। পদ্মা সেতুতেও অর্থ জোগানোর ভার নিয়েছিল তারা। ২০০১ সালের ৪ জুলাই মুনশিগঞ্জের মাওয়ায় পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিপর্যয়ের পালা শুরু ২০১২ সালে, বিশ্ব ব্যাংক যখন ঋণ দিতে অস্বীকার করে। তাদের অভিযোগ, সেতু তৈরিতে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে ও হচ্ছে। বিশ্ব ব্যাংক সরে দাঁড়ানোয় অন্য সংস্থাগুলোও সরে আসে। ফলে পুরো প্রকল্পটি পড়ে পদ্মার বিশ বাওঁ জলে।

সেই ঘোলাজলের ‘রূপ’ ও ‘ষড়যন্ত্রের চরিত্র’ কেমন ছিল, হাসিনা সম্প্রতি বাংলাদেশের সংসদে তা বর্ণনা করলেন। তাঁর অভিযোগ, ওই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল ‘গ্রামীণ ব্যাংক’-এর এমডি পদে নোবেলজয়ী মহম্মদ ইউনুসের থাকা না-থাকার প্রশ্নটি। ইউনুসকে বহাল রাখতে ফোন করেছিলেন হিলারি ক্লিন্টন, ব্রিটেনের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের স্ত্রী শেরি, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের প্রতিনিধি। প্রত্যেকের এক কথা- ইউনুসকে এমডি পদ থেকে সরানো যাবে না। খোদ প্রধানমন্ত্রী যখন সংসদে দাঁড়িয়ে বলেন, আমেরিকার বিদেশমন্ত্রক তাঁর পুত্র জয়কে ডেকে ইউনুসের জন্য ভয় দেখিয়েছিল, তখন তা শুধুমাত্র অভিযোগ থাকে না। রূপ নেয় ‘আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র’র। হাসিনার বিশ্বাস, সেই চাপের মুখে মাথা না-নোয়ানোয় দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্ব ব্যাংক পদ্মা সেতুর অর্থায়ন থেকে পিছিয়ে এসেছিল। ঋণদাতা সংস্থাগুলির চাপে তৎকালীন যোগাযোগ মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল। গ্রেপ্তার হয়েছিলেন তৎকালীন সেতু সচিব মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়া ও সেতু তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী কাজি ফেরদৌস।

হাসিনার কথায়, ‘দুর্নীতির অভিযোগ থেকে আমি, আমার বোন রেহানা, আমার ছেলে, কেউ বাদ যাইনি। অসত্য অপবাদ দিয়ে তারা যখন টাকা বন্ধ করে দিল, তখন বলেছিলাম, এই সেতু আমরা নিজেদের টাকাতেই করব।’ তখন যারা মনে করেছিল, এই কাজ অসম্ভব, আজ তারা দেখতে পাচ্ছে- বাঙালি কী করতে পারে। হাসিনা সেইদিন যতটা আত্মবিশ্বাসী ছিলেন, আজও ততটাই।

অভিযোগ ছিল, কানাডার এক প্রতিষ্ঠান সেতুর বরাত পেতে বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের ৫ কোটি ডলার ঘুষ দিয়েছিল। যদিও কানাডার আদালতে তা প্রমাণ হয়নি। দুর্নীতির অভিযোগের মোকাবিলা কীভাবে করেছিলেন, তার বর্ণনায় হাসিনা বলেন, ‘আমিও ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ও আমেরিকানদের বলেছিলাম, হিলারি ক্লিন্টন আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। কোনও কোনও কোম্পানির হয়ে তদবির করেছিলেন। বলেছিলেন, তাদের কাজ দিলে এত পার্সেন্ট পাওয়া যাবে। আমার ডায়েরিতে সেসব লেখা আছে। দেব না কি সব প্রকাশ করে? তখন ওরা চুপ করে গিয়েছে।’ গর্বিত হাসিনা বলেছেন, ‘এই সেতু আমাদের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করেছে। দেখিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ কী করতে পারে।’

স্বাধীনতার লগ্নে যে দেশ তৎকালীন মার্কিন নেতাদের চোখে ছিল ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’, তার এই উত্তরণ শুধু অভাবনীয় ও বিস্ময়করই নয়, পশ্চিমি দুনিয়ার কাছে গবেষণারও বিষয়। ২০১০ সালের শেষে ‘দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’ বাংলাদেশের সাফল্য-নিবন্ধের শিরোনাম দিয়েছিল- “বাংলাদেশ, ‘বাস্কেট কেস’, নো মোর”। ওই শিরোনাম ছিল ক্ষমাপ্রার্থনার নামান্তর। ভবিষ্যতের বাংলাদেশকে তারা আগাম নিরীক্ষণ করেছিল। ভুল কিছু করেনি। বন্যা ও দুর্ভিক্ষে জর্জর যে-দেশটা ছিল পরনির্ভরতার প্রতীক, সাত কোটি বাঙালিকে দু’বেলা খাওয়াতে হিমশিম খাচ্ছিল, আজ তাদের খাদ্য উদ্বৃত্ত। বাংলাদেশ আজ চাল রপ্তানি করছে। ফল, সবজি, মাছ ও দুধ উৎপাদনেও স্বনির্ভর। তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বিশ্বে দু’নম্বর। মাথাপিছু আয়ে প্রতিবেশীদের ছাড়িয়েছে। নিজেদের প্রতি বিশ্বাস এতই গভীর যে, ১২ লক্ষ রোহিঙ্গার উপস্থিতি সত্ত্বেও অবিচলিত হাসিনা বলতে পারেন, “আমরা দু’মুঠো খেলে ওরাও খাবে।”

আজ আদিগন্ত বিস্তৃত প্রমত্ত পদ্মার বুক চিরে জেগে ওঠা পদ্মা সেতুর দিকে তাকালে তার প্রতিটি স্প্যান থেকে ঠিকরে বের হতে দেখা যাবে আত্মনির্ভর বাংলাদেশের দ্যুতি। ৩০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে তৈরি প্রায় সওয়া ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এই স্থাপনা বাংলাদেশের বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার বাড়িয়ে দেবে দেড় থেকে ৩ শতাংশ। জাত হিসাবে বাঙালির এ বড়ই গর্বের। স্পর্ধার। অহংকারের। মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার পর শেখ হাসিনার আত্মনির্ভর বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মূল্যায়নে ২০৩৬ সালের মধ্যে বিশ্বের ২৪তম অর্থনীতি হতে চলেছে।

গরু পাচার ৭০ শতাংশ বন্ধ হওয়ার পর, ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশিদের গরুর মাংস খাওয়া ভুলে যেতে হবে।’ ওদেশে গোমাংস খাওয়া কেউ ছাড়েনি। বরং গড়ে উঠেছে শ’য়ে শ’য়ে খামার। গো-পালনেও আজ বাংলাদেশ স্বনির্ভর, এদিকে ভারতে পরিত্যক্ত গরু মূর্তিমান সমস্যা। বঙ্গবন্ধুর ‘সবার সঙ্গে বন্ধুতা, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’, নীতির সার্থক প্রয়োগে সফল হাসিনা ভারত ও চিনের মধ্যে চমৎকার ভারসাম্য রক্ষা করে চলেছেন। অর্থনীতিকে যেভাবে গতিশীল করেছেন, তা অপ্রতিরোধ্য। ভারতের বণিকসভার সদস্যদের সমাবেশে বিদেশমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন আজ তাই বলতে পারেন, ‘আপনাদের লগ্নির সেরা ঠিকানা বাংলাদেশ। আসুন। বিনিয়োগ করুন। লাভবান হোন।’

তাঁর চোখে যারা ‘ষড়যন্ত্রকারী’, ‘অসহযোগী’, সেতু উদ্বোধনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের সবাইকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। এই শিষ্টাচারিতা রাষ্ট্রীয় স্বার্থে ভেদাভেদ ভুলে গঠনমূলক রাজনীতির ইঙ্গিতবাহী। প্রকৃত গণতন্ত্রের বিকাশ ও আইনের শাসনের সুপ্রতিষ্ঠা, যে-দুই বিষয়ে হাসিনার সরকার এখনও প্রশ্নবিদ্ধ, সমালোচনার সেই বূ্যহভেদের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ একমাত্র তাঁর পক্ষেই সম্ভব। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের শুভক্ষণ থেকে শুরু হোক সেই শুভযাত্রার অঙ্গীকার। আধুনিক, উন্নত, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে শেখ হাসিনার একমাত্র বিকল্প যে তিনিই।

[আরও পড়ুন: আত্মনির্ভরতা কোন পথে, শুধু সুদ বাড়িয়ে কি মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সক্ষম রিজার্ভ ব্যাংক?]

২০২৪ এর পূজা সংক্রান্ত সমস্ত খবর জানতে চোখ রাখুন আমাদের দেবীপক্ষ -এর পাতায়।

চোখ রাখুন
Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement