কোথায় দলিত নিগ্রহ? কোথায় গরু নিয়ে রাজনীতি? প্রবল জাতীয়তাবাদী হাওয়ায় অস্ত্রশস্ত্রে ঝনঝনিয়ে উঠছে দেশ৷ আর ব্যাকফুটে চলে যাওয়া শাসকদল পাচ্ছে নতুন অক্সিজেন৷ তবে কি উরি হামলা শাপে বর হল মোদির কাছে? উত্তরের খোঁজে সরোজ দরবার
Advertisement
-আপনার ছাতি কত?
-১০০ ইঞ্চি৷
-কোমর?
-ওই ১০০ ইঞ্চি৷
কোনও মোদিভক্তর সঙ্গে জটায়ুর দেখা হলে এরকম একটা কাল্পনিক সংলাপ হতে পারত৷ পরের সংলাপটা অবশ্য অবধারিত থাকছে না(সিডিশন চার্জ বলেও তো কিছু একটা আছে)৷ সে যাকগে, প্রসঙ্গ তো সেটা নয়৷ প্রসঙ্গ হল, মোদি স্বীকার করুন বা না করুন, এই ১০০ ইঞ্চি ছাতি এখন তাঁর বড় সম্বল হয়ে উঠেছে৷ সৌজন্যে, অবশ্যই সার্জিক্যাল স্ট্রাইক৷ হতে পারে তিনি অনুগামীদের বলেছেন, তা নিয়ে বেশি বড়াই না করতে৷ কিন্তু তা কী আর সম্ভব? উপরমহল মুখে সংযমের সেলোটেপ আঁটলেও, নীচের তলার উচ্ছ্বাস চেপে রাখে সাধ্যি কার৷ অতএব প্রবল ভাবে ফুঁসে উঠেছে ১০০ ইঞ্চি ছাতি৷ আর তার আড়ালে কী কী চলে গেল? উনায় দলিত নিগ্রহ প্রায় ভুলেই গিয়েছে প্রবল জাতীয়তাবাদী ‘পাব্লিক’৷ গো-রক্ষকদের বাড়াবাড়ি নিয়ে যেরকম ব্যাকফুটে চলে গিয়েছিল শাসকদল, সেখান থেকে একেবারে ফিনিক্সের মতো প্রত্যাবর্তন৷ বস্তুত সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের সাফল্যের কাছে বাকি সব ইস্যুই খড়কুটোর মতো উড়ে গিয়েছে প্রায়৷
এই ক’দিন আগেও গুজরাতে গদি রক্ষা হবে কি না, সে ভাবনায় বড় ভাঁজ পড়েছিল শাসকদলের কপালে৷ দলিত নিগ্রহের সঙ্গে যেভাবে পরোক্ষভাবে নাম জড়াচ্ছিল তাতে বিপাকের সিঁদুরে মেঘ দেখতে ভুল করেননি তুখোড় বিজেপি নেতারা৷ প্রবলভাবে প্রধানমন্ত্রী নেমে পড়েছিলেন ‘স্বঘোষিত’ গো-রক্ষক বাহিনীকে শাসন করতে৷ কিন্তু লাগামছাড়া গো-রক্ষকরা একবার যে স্বাধীনতা পেয়েছে, তাতে কিছুতেই হস্তক্ষেপ হোক চাইছিল না৷ পাল্টা তোপ দাগছিল প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধেই৷ সেই ইস্যুকে সম্বল করে ধর্মনিরপেক্ষ তৃতীয় ফ্রণ্ট জাতীয় মহলে নিজেদের জোর বাড়াতে কোমর বেঁধে নেমেছিল৷ সমীকরণটা প্রায় বদলে বদলেই যাচ্ছিল৷ এমন সময় শাপে বর হয়ে এল, উরিতে পাক জঙ্গির হানা ও ১৯ জওয়ানের মৃত্যু৷ হ্যাঁ, জওয়ান মৃত্যুর সঙ্গে ‘শাপে বর’ শব্দ বেমানান হলেও দেশের এই মুহূর্তের রাজনৈতিক বাস্তবতা কিন্তু তা অনুমোদন করছে৷ মোদির সামনে সুযোগ এল, নিজের জাতীয়তাবাদী ভাবমূর্তিটিকে জোরদার করার৷ এই তো লোকসভা নির্বাচনের সময় অমিত শাহরা বড়মুখ করে বলেছিলেন, মোদি কুর্সিতে বসলে সীমান্ত দিয়ে ইঁদুরও গলতে পারবে না৷ আর সেখানে কি না, চার জঙ্গি কাঁটাতার কেটে সেনা ছাউনি নাস্তানাবুদ করে দিয়ে গেল! অতএব কালবিলম্ব না করে সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের সিদ্ধান্ত৷ এবং সাফল্য৷ এবং পাবলিকের নজর সরে যাওয়া ও ১০০ ইঞ্চি ছাতির আত্মপ্রকাশ৷
বস্তুত পাকিস্তান নামে যে ক্রনিক অসুখের শিকার ভারত, সার্জিক্যাল স্ট্রাইক তার প্রতিকার তো নয়ই, উপশমও নয় তেমন৷ কেননা এর পর আরও প্রত্যাঘাতের জন্য তৈরি থাকতে হবে প্রশাসনকে৷ এবং তা হচ্ছেও৷ লাগাতার সীমান্ত চুক্তি লঙ্ঘন করছে পাক জঙ্গিরা৷ কূটনৈতিকভাবে পাকিস্তানকে একঘরে করার প্রয়াসে খানিকটা সাফল্য এসেছে বটে৷ সার্ক ভেস্তে যাওয়া তার বড় নমুনা৷ কিন্তু মুশকিল হল, তাও সমাধান নয়৷ রাশিয়া ভারতের সার্জিক্যাল স্ট্রাইক সমর্থন করেছে বটে কিন্তু তার মানে এই নয় যে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক শেষ করেছে৷ বরং তা আরও বেড়েছে৷ চিনও ধরি মাছ না ছুঁই পানি করে কাজ সেরেছে৷ মার্কিন কংগ্রেসে যতই পাকিস্তানকে সন্ত্রাসবাদী রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণার বিল পেশ হোক না কেন, তা প্রতিষ্ঠা পাওয়া আপাতত বহুদূরের ব্যাপার৷ তাছাড়া ওমাবার সঙ্গে মোদির সখ্যতা যতই ফটোফিচার হোক না কেন, ক্ষমতা বদলের পর ভারত-আমেরিকা সম্পর্ক কী হবে তা কেউ জানে না৷ ফলত আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মোদি যে খুব সাফল্য পেয়েছেন তা নয়৷ সারা পৃথিবী তিনি প্রায় চষে ফেলেছেন, কিন্তু রাজদ্বারে যাঁদের পেয়েছেন শশ্মানেও তাঁরা থাকবে, এমন বন্ধু বিশেষ পাননি৷
এদিকে পাক প্রত্যাঘাত রক্ষা করতে অস্ত্রের ভাণ্ডার বাড়াতে হচ্ছে৷ এই মুহূর্তে ভারতই পৃথিবীতে সবথেকে বড় অস্ত্র আমদানিকারী দেশ৷ অর্থাৎ বিপুল অর্থ ব্যয় হচ্ছে সে খাতে৷ যার কিয়দংশ উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ হলে দেশের অভ্যন্তরে অনেক ক্ষোভ-বিক্ষোভই মিটে যেতে পারত৷ কিন্তু যে লার্জার দ্যান লাইফ ইমেজ নিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন মোদি, তা ধরে রাখতে গেলে সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের মতো বড়সড় সিদ্ধান্ত তাঁকে নিতেই হত৷ প্রত্যাশিতভাবে তা তিনি নিয়েওছেন৷ তাতে পাকিস্তান সমস্যার সমাধান না হোক, ঘরোয়া রাজনীতিতে মোদি নতুন অক্সিজেন পেয়েছেন৷
এই মুহূর্তে প্রবল জাতীয়তাবাদী হাওয়ায় উনা উড়ে গিয়েছে প্রায়৷ সামনেই উত্তরপ্রদেশ নির্বাচন৷ কিন্তু যাদবদের ঘরের কোন্দল এমন মাথাচাড়া দিয়েছে যে, ঘর সামলাতেই সময় কাটছে৷ মোদি বিরোধিতা তেমন জোরদার হবে বলে মনে হচ্ছে না৷ পাঞ্জাব ও গুজরাত নির্বাচনেও এরপর শাসকদলের খুব একটা অসুবিধা হবে বলে মনে হয় না৷ কেননা ওই ১০০ ইঞ্চি ছাতি৷ আপাতত সব ইস্যুই পিছনে চলে গিয়েছে প্রবল দেশপ্রেমিকদের প্রচারে৷ বলা বাহুল্য জঙ্গি বা জেহাদিরা যে অর্থে দেশের জন্য জীবন বিসর্জন দিতে পারেন, এই দেশপ্রেমিকরা তেমনটা নয়৷ সীমান্তে না দাঁড়াক, এই দেশপ্রেমিকরা অনায়াসে নির্বাচন জিতিয়ে দিতে পারে প্রচারের ঢক্কানিনাদে৷ অতএব অস্ত্রশস্ত্রে ঝনঝন করে বেজে উঠেছে দেশ৷ পিছু হটেছে দেশের মারণরোগের মতো সমস্যাগুলো৷ কিন্তু সে তো সারেনি৷ অতএব আরও পচন আসবে, আরও ভয়াবহ হবে পরিস্থিতি৷ কিন্তু তাতে কী! সে সবরে উপর দিয়ে জাতীয়তাবাদী হাওয়ায় বিজয়রথের ধ্বজা উড়তে কোনও বাধা থাকবে না৷
সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের প্রমাণ যাঁরা চেয়েছেন তাঁরাই দেশদ্রোহী হয়ে উঠেছেন৷ কেজরিওয়ালের গায়ে তো কালিও ছেটানো হয়েছিল৷ ভদ্রলোক ঘুরিয়ে স্রেফ বলেছিলেন, প্রমাণ দেখিয়ে পাকিস্তানের মুখ বন্ধ করতে৷ তার আগে প্রধানমন্ত্রীকে কুর্নিশ জানিয়েছিলেন৷ রাহুল গান্ধীও বোধহয় জীবনে প্রথমবার মোদির প্রশংসা করেছিলেন৷ কিন্তু তিনিও শেষমেশ বলে ফেললেন, জওয়ানের রক্ত নিয়ে দালালি করছেন মোদি৷ তা মোদি যদি ‘মওত কি সওদাগর’ হন, তা নিয়ে বিরুদ্ধ রাজনীতিও তো সওদার বাইরে আর কিছু নয়৷ তাহলে ১৯ জওয়ানের মৃত্যু আর সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের মোট ফল কী দাঁড়াল? ঘরোয়া রাজনীতির স্থানিক সমস্যাকে পিছনে ফেলে নতুন একটা ইস্যু পাওয়া৷ যে ইস্যুতে যত প্রচার হবে ততো লাভ হবে মোদিরই৷ মৃত জওয়ানের ছবি শেয়ার করা গরিষ্ঠসংখ্যক দেশবাসীর মোদির সমস্ত ক্ষতে যত্ন করে লাগিয়ে দেবেন সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের ‘মলম’৷ আর পাকিস্তান সমস্যা? দলিত নিগ্রহ? গোরক্ষকদের লাগামছাড়া অত্যাচার? গরু নিয়ে রাজনীতি? আপাতত সব পিছনে৷ আসলে এ দেশে নাকের বদলে নরুণ পাওয়ার গল্প তো নতুন কিছু নয়৷
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.