সুমন ভট্টাচার্য: ১৯৯০ সালের মহাষষ্ঠীর দিন প্রফুল্লচন্দ্র সেন মারা যান। মিডলটন রো-র যে ফ্ল্যাটে উনি জীবনের শেষ কয়েক বছর থাকতেন, আমি সেখানে গিয়েছিলাম। এই বঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর (সময়কাল ১৯৬২-’৬৭) শেষযাত্রায় কতজন লোক ছিলেন, হাতে গুনে বলে দেওয়া যাচ্ছিল। গান্ধীবাদী, অনাড়ম্বর জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত প্রফুল্লবাবু থাকতেন তাঁর এক অনুগামীর ফ্ল্যাটে। সম্বল বলতে ছিল একটি ট্রাঙ্কে রাখা কয়েকটি পাঞ্জাবি। শ্মশানে রওনা হওয়ার আগে এক ঘনিষ্ঠ কংগ্রেস নেতা আমার কাঁধে হাত রেখে বলেছিলেন, ছয়ের দশকে এই ভদ্রলোককে ‘চোর’ থেকে শুরু করে কত কী না বলা হয়েছিল, তা একবার খবরের কাগজের আর্কাইভ ঘেঁটে দেখে নিস। দেওয়ালে দেওয়ালে লেখা হত: প্রফুল্ল সেন স্টিফেন হাউস কিনে নিয়েছেন।
প্রফুল্লচন্দ্র সেন কি এই ‘মিডিয়া ট্রায়াল’ নিয়ে কোনওদিন কিছু বলেছিলেন? বা, বলার সুযোগ পেয়েছিলেন? বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রফুল্লচন্দ্র সেনকে নিয়ে যে চমৎকার স্মৃতিকথাটি লিখেছেন, তাতেও কোথাও এই বিষয়ে উল্লেখ নেই। সেদিন ফেসবুকের ‘ওয়াল’ ছিল না, কিন্তু পাড়ায় পাড়ায় দেওয়ালে লেখা হত: স্টিফেন হাউসের মালিক চোর প্রফুল্লচন্দ্র সেনকে চিনে নিন। আজ, এই ২০২০-তে, মহাকরণ থেকে ঢিল-ছোড়া দূরত্বে যাঁরা স্টিফেন হাউসকে দেখেন, তাঁরা কি জানেন প্রফুল্লচন্দ্র সেনকে ব্যক্তিগত স্তরে কতখানি গঞ্জনা ও অপমান সহ্য করতে হয়েছিল?
’৯০-এ যখন প্রফুল্লচন্দ্র সেন মারা যাচ্ছেন, তার বছরখানেক আগে কংগ্রেসের আর-এক নেতাকে ‘চোর’ বদনাম নিয়ে ক্ষমতা থেকে সরে যেতে হয়েছিল। একইভাবে দেওয়াল ভরে গিয়েছিল লিখিত স্লোগানে: গলি গলি মে শোর হ্যায়,/ রাজীব গান্ধী চোর হ্যায়। বোফর্সের টাকা ইন্দিরা-তনয় কীভাবে নিয়েছেন, কোথায় কোথায় রেখেছেন, তা নিয়ে নিত্যদিন খবরের কাগজে চিত্তাকর্ষক প্রতিবেদন বেরত। ওটাকে কি ‘মিডিয়া ট্রায়াল’ বলবেন, না কি বলবেন না? যদি ‘ডাইনি খোঁজা’ বলেন, তাহলে সেই ‘ডাইনি’ হিসাবে তথাকথিত প্রগতিশীল মেনস্ট্রিম মিডিয়া কিন্তু একজন ইতালীয় রমণীকে আবিষ্কার করে ফেলেছিল, যিনি গান্ধী পরিবারে অ-ভারতীয় বধূ হয়ে এসেছিলেন। বিদেশে সেই ইতালীয় মহিলার কোন আত্মীয় কী করেন, কার কোন ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট রয়েছে, তার হদিশ দিয়ে ‘খবর’ হত। গত শতাব্দীর শেষ দুই দশক জুড়ে অবশ্য এটাকে ‘উইচ হান্ট’ বলা হত না আর। বদলে, একটা প্রগতিশীল প্রতিশব্দ পেয়েছিলাম আমরা: ‘ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম’।
ইতিহাসের কী আশ্চর্য সমাপতন, কারগিলে যেদিন টাইগার হিল দখলের জন্য সব কামানের মুখ একদিকে ঘোরানো হচ্ছে, তখন দ্রাসে দাঁড়িয়ে কমান্ডিং অফিসার কর্নেল ডেভিডকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এগুলো সব বোফর্স? দক্ষিণী সেনা অফিসার মিষ্টি হেসে বলেছিলেন, ‘ইয়েস, মাই বয়। মোস্ট এফিসিয়েন্ট হাউইৎজার উই হ্যাভ।’ টাইগার হিলে বোফর্সের দুর্দমনীয় অকাল দেওয়ালি দেখতে দেখতে মাথার ভিতরে ‘ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম’ থুড়ি ‘মিডিয়া ট্রায়াল’, সবকিছুর অর্থ বা অর্থহীনতা গুলিয়ে যাচ্ছিল। (রাজীব গান্ধী কি আর জানতেন যে ‘বোফর্স’ লিখে সার্চ দিলে ভবিষ্যতে এই শব্দটার সঙ্গে ইন্দিরা-পুত্রের সবচেয়ে বেশি অ্যাসোসিয়েটেড সার্চ
পাওয়া যাবে! অথচ, কারগিল রণাঙ্গনে ভারতীয় সেনার শৌর্যের প্রতীক হয়ে উঠেছিল বোফর্স!)
‘মিডিয়া ট্রায়াল’ আর ‘ব্যক্তিগত জীবন’ নিয়ে যাঁরা ইদানীং ভীষণ সোচ্চার ও উদ্বিগ্ন, তাঁদের জন্য কারগিল থেকে ক্যালিফোর্নিয়া জুড়ে কত না টুকরো টুকরো গল্পের স্মৃতি ছড়িয়ে আছে! এই শতাব্দীর প্রথম দশকে নিউ ইয়র্কে ঘুরছি মার্কিন সরকারের একটা কোর্স করতে। ম্যানহাটনের একেবারে শেষ মাথায় একটা ফ্ল্যাট দেখিয়ে গাইড যে-ই বললেন, উপরের একটি তলে মনিকা লিউনস্কি থাকেন, প্রত্যেকের মাথা একেবারে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেল যেন। তখনও মোবাইলে ছবি তোলার যুগ আসেনি। কিন্তু অবাক হয়ে দেখেছিলাম, হোয়াইট হাউস-কে সবচেয়ে বড় কেচ্ছা উপহার দেওয়ার জন্য দায়ী সাব্যস্ত মহিলা যে-অ্যাপার্টমেন্টে থাকেন, তার সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে ইউরোপীয় কিংবা আফ্রিকার কোনও দেশের সাংবাদিকের অসুবিধা নেই।
সুশান্ত সিং রাজপুতের অস্বাভাবিক মৃত্যু, রিয়া চক্রবর্তীর গ্রেপ্তারি, আড়াআড়িভাবে বিভক্ত হয়ে যাওয়া মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়ায় সব শিবিরের বক্তব্য শুনতে শুনতে মাঝে একটু অন্যরকম স্বাদ পেতে ‘নেটফ্লিক্স’-এ ‘মাসাবা মাসাবা’ দেখছিলাম। নীনা গুপ্তা আর তাঁর কন্যার বাস্তব জীবনের সংকট, একজন কৃষ্ণাঙ্গ মহাতারকা ক্রিকেটারের বান্ধবী রূপে সেই আটের দশকে ‘অবিবাহিত মা’ হওয়ার চ্যালেঞ্জের গল্পটা দেখতে দেখতে টের পেলাম, এটাও তো আসলে ‘মিডিয়া ট্রায়াল’-কে উলটোদিক থেকে দেখারই গল্প। নীনা নিশ্চয়ই ভুলে যাননি তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের গোপনতম তথ্যটি হাসপাতাল থেকে ফাঁস করে, কন্যাসন্তানটির বাবা যে ভিভ রিচার্ডস-ই, তা মানুষকে জানিয়ে, পত্রিকার বিক্রি বাড়িয়েছিলেন কোন সম্পাদক! অথচ, ইতিহাসের কী সমাপতন, সেই সম্পাদক-ই কিনা পরে শিবসেনার হয়ে রাজ্যসভার সদস্য হবেন! সেই শিবসেনার, যারা নাকি এই মুহূর্তে বলিউডের অভিনেত্রীদের ব্যক্তিগত জীবনের গোপনীয়তার সবচেয়ে বড় রক্ষাকর্তা। আর সেই প্রাক্তন সম্পাদক, যিনি মাসাবা গুপ্তার বার্থ সার্টিফিকেট হাসপাতাল থেকে বের করে এনে স্কুপ দিয়েছিলেন, তিনি রিয়া চক্রবর্তীর ব্যক্তিজীবনের গোপনীয়তা রক্ষা করা কেন উচিত, তাই নিয়ে শিবসেনার হয়ে ব্যাট ধরেছেন!
তাহলে ‘মিডিয়া ট্রায়াল’ কি সত্যিই নতুন কোনও পন্থা? প্রফুল্লচন্দ্র সেন বা রাজীব গান্ধীকে যার সম্মুখীন হতে হয়েছে, সোনিয়া গান্ধী বা নীনা গুপ্তার জীবন নিয়ে যত কাটাছেঁড়া হয়েছে, আজ কি তার চেয়ে ভিন্ন কিছু হচ্ছে? স্মার্টফোন আর সোশ্যাল মিডিয়া মিলে কি ক্রিকেট খেলাটাকেই রাগবি করে ছেড়ে দিল তবে? উত্তরটা ‘হ্যাঁ’ এবং ‘না’।
‘না’, কারণ আসলে আগে যা হত, এখনও তা-ই হচ্ছে। আবার, ‘হ্যাঁ’, কারণ, সোশ্যাল মিডিয়া জনগণকে যে-ক্ষমতা দিয়েছে, যেটাকে প্রগতিশীলরা ‘মব রুল’ বলে ছিছিক্কার করছেন, আসলে সেটাই ‘সাবঅলটার্ন’-এর ক্ষমতায়ন। ফলে খবরের কাগজে ‘উত্তর সম্পাদকীয়’ স্তম্ভের লেখকের যদি যৌন কেলেঙ্কারি থাকে, সেটাও যেমন ফাঁস হয়ে যাচ্ছে, তেমনই কোনও সিনেমা অপছন্দের হলে তাতে ডিসলাইকের সংখ্যা আগের সব রেকর্ড ভেঙে দিচ্ছে।
সংসদীয় গণতন্ত্র যেমন সবাইকে একটা করে ভোটাধিকার দিয়ে সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার গোড়াপত্তন করেছিল, তেমনই সোশ্যাল মিডিয়ার একটি অ্যাকাউন্ট সবাইকে মতামত প্রকাশের অধিকার দিয়ে দিয়েছে। ‘আমি প্রগতিশীল, আমিই সত্য এবং আমিই ন্যায়ের বিচারক, আমিই একমাত্র আমার বিজয়ের আখ্যান রচনা করব’– এই মৌরসিপাট্টার দিন শেষ। প্রফুল্লচন্দ্র সেনের যুগে যে-দক্ষিণপন্থীরা দেওয়াল দখলের যুদ্ধে হেরে গিয়েছিলেন, তঁারা-ই আজ ফেসবুকের ওয়ালে, টুইটে সমানে সমানে টক্কর দিচ্ছেন। এরপরের বিচারটা বরং ইতিহাসের হাতে ছেড়ে দিই।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.