সুখেন্দুশেখর রায়: ১৯৮০-’৮১। মাত্র ৪-৫ বছর হল কলকাতা হাই কোর্টে ওকালতি শুরু করেছি। সে সময় খিদিরপুর ডকের ‘আইএনটিইউসি’-এর বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীর ইউনিয়নের তরফে হাই কোর্টে একটি মামলা করা হয়েছিল। কর্মীদের মাইনেপত্তর আটকে থাকা, সঙ্গে ছাঁটাই এসব নিয়েই মামলা। আমাকে ধরেন তাঁরা।
আমি মামলা লড়তে রাজি হইনি। প্রথমত, আমার অভিজ্ঞতা তখন বেশ কম। দ্বিতীয়ত, এরকম একটা সংবেদনশীল মামলায় সিনিয়র ও জাঁদরেল আইনজীবী কাউকে দরকার বলে মনে হয়েছিল। এক জুনিয়র বন্ধু তখন সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের নাম করেন। কিন্তু এত বড় আইনজীবী ‘আইএনটিইউসি’-র বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীর হয়ে লড়বেন! ঘোরতর সন্দেহ ছিল। শেষে কিন্তু-কিন্তু করে রাজি হলাম। আমার বন্ধুটির সঙ্গে সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের ক্লার্কের যোগাযোগ ছিল। সেই সুবাদে দেখা করার অবকাশ পেলাম। মিনিট পাঁচেক সময় বরাদ্দ করেছিলেন তিনি।
ওই ক্লার্ক ভদ্রলোক আমাকে বলেছিলেন, ‘পড়াশোনা করে যাবেন। স্যর কিন্তু প্রশ্ন করেন। না পারলে দুচ্ছাই করে দেবেন।’ যথাসাধ্য প্রস্তুতি নিয়ে গেলাম। ‘কী ব্যাপার?’ জানতে চাইলেন চিরায়ত জলদগম্ভীর স্বরে। ‘আইএনটিইউসি’-র ব্যাপারটা খোলসা করিনি। বাকিটা বললাম। বললেন, ‘তুমি পড়েছ? ফ্যাক্টস বলতে হবে না, বলো কী কী ল পয়েন্ট রয়েছে?’ ৪-৫টা পয়েন্ট বললাম। শুনে মাথা নাড়লেন। বললেন, ‘ভালই তো! কিন্তু তুমি লড়ছ না কেন?’ বললাম, ‘বিরুদ্ধে বড় বড় আইনজীবী রয়েছেন।’ শুনে বললেন, ‘ভয় পেলে বড় ল-ইয়ার কখনও হতে পারবে না। ঠিক আছে, আমি দেখছি বিষয়টা।’
নির্দিষ্ট দিনে কোর্টে এলেন। এবং আক্ষরিক অর্থেই জয় করলেন। বড়জোর ৫-৭ মিনিট। তাতেই কেল্লা ফতে। ল পয়েন্টগুলো এমন নিপুণভাবে পেশ করলেন, ছাঁটাই স্থগিত হয়ে গেল। খিদিরপুর ডকের গরিব শ্রমিকরা এক-দু’টাকা করে চাঁদা তুলেছিলেন ওঁর ফি দেওয়ার জন্য। মামলার পরে লজ্জায় মাটিতে মিশে গিয়ে ওঁকে বললাম, “স্যর, এঁরা অত্যন্ত দরিদ্র। তায় ‘বিক্ষুব্ধ’ আইএনটিইউসি। ক্ষমতা সীমিত। সামান্য অর্থই জোগাড় করতে পেরেছেন।” এই কথায় তিনি যে জবাব দিয়েছিলেন কখনও ভুলব না। বলেছিলেন, ‘শ্রমিক শ্রমিকই! ওঁরা যে ফি দিতে পারবেন না, আমি জানতাম। শুধু দেখুন, কিছু টাকা আমার ক্লার্ককে দেওয়া যায় কি না।’ শ্রমিকরা চাঁদা তুলে ৫০০ টাকা দিয়েছিলেন ক্লার্ককে।
এই হলেন সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়!
উদার, নীতিমনস্ক, শক্ত মেরুদণ্ডের লোক। আর তেমনই বিদগ্ধ। মানুষের সঙ্গে মেশার সময় রাজনীতির রং দেখেননি।
[তিনি ইংরেজের ইংরেজ, তিনি ইংরেজের ঈর্ষা হয়েই বাঁচবেন]
ওঁর বাবা ছিলেন নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ‘হিন্দু মহাসভা’র সঙ্গে জড়িত ছিলেন। উনিও মস্ত আইনজীবী। আমার বাবাও ছিলেন আইনজীবী। নির্মলবাবুকে চিনতেন। ওঁদের থিয়েটার রোডের বাড়িতে যাতায়াত ছিল বাবার। তখনই বাবা বলতেন, ‘নির্মলবাবুর ছেলেটা কিন্তু খুব বড় ব্যারিস্টার হবে একদিন! সবসময়ই পড়াশোনা নিয়ে মেতে রয়েছে।’
আটের দশকের শুরু থেকেই আমার দিল্লিতে যাতায়াত বাড়ে। আর দিল্লি গেলেই নেশা ছিল, লোকসভা-রাজ্যসভার ভিজিটার্স গ্যালারিতে বসে বড় বড় বক্তার ভাষণ শোনার। এখন অবশ্য সংসদে ৩০ মিনিটের বেশি কাউকে ভিজিটার্স গ্যালারিতে অ্যালাও করে না। তখন সেসব ছিল না। সারাদিন থাকা যেত। থাকতামও। বাঘা বাঘা বক্তা বলতেন। আর, বাংলা থেকে তখন কেউ বলছেন মানেই অব্যর্থভাবে তিনি সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়। প্রখর যুক্তিতে শানিয়ে বক্তব্য রাখতেন। তাঁকে কাউন্টার করার সাধ্যি ছিল না কারও।
স্পষ্টবাদী ছিলেন। সত্যকথনে কুণ্ঠা ছিল না। যে কারণে অনেকের কাছে ‘অপ্রিয়’ও হয়েছিলেন বিভিন্ন সময়ে। প্রেসকে যেমন একবার বিবৃতি দেন এই মর্মে যে, ‘আমাদের দেশে বিচার কেনা যায়।’ চারিদিকে হইহই পড়ে গেল। সকলেই ভাবছেন, এবার নিশ্চয় আদালত অবমাননার দায়ে পড়তে হবে তাঁকে। কিন্তু কিছুই হয়নি। সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে চ্যালেঞ্জ করলে তিনি যে বিপরীতে একশোটা উদাহরণ সাজিয়ে দিয়ে অকাট্য যুক্তি পরিবেশন করতে পারেন অনায়াসে, তা সকলেই জানতেন।
২০০৪ সালে সর্বসম্মতভাবে লোকসভার অধ্যক্ষ নির্বাচিত হন। ওঁর মতো সত্যভাষী, নিরপেক্ষ ও বলিষ্ঠ চরিত্রের স্পিকার প্রায় দেখিনি বললেই চলে। পি. এ. সাংমা-ও ভাল। কিন্তু তাঁকেও ছাড়িয়ে গিয়েছেন সোমনাথবাবু। প্রশ্নোত্তর পর্বে সাংসদরা কী ধরনের প্রশ্ন রাখছেন, সরকার পক্ষ তার কী উত্তর দিচ্ছে- এই পুরো সেশনটা তিনি ‘লাইভ’ সম্প্রসারণের ব্যবস্থা করে দেন। যুগান্তকারী পদক্ষেপ। ‘লোকসভা টিভি’ও তাঁর মস্তিষ্কপ্রসূত। ২০০৫ সালে একটি বেসরকারি চ্যানেল একটা স্ট্রিং অপারেশন করেছিল। কয়েকজন সাংসদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছিল। তাঁদের বহিষ্কারের দাবি ওঠে। শেষে ধ্বনিভোটের মাধ্যমে ফল যায় বহিষ্কারের সপক্ষেই। সংসদ ভবনের সদস্যপদ খারিজ হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বহিষ্কৃত সাংসদরা সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হন। এবং সুপ্রিম কোর্ট হস্তক্ষেপ করে। বহিষ্কারের কার্যকারণ খতিয়ে জানতে চেয়ে যেদিন সুপ্রিম কোর্টের নোটিস যায় সরকার, ইলেকশন কমিশন ও স্পিকার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে- সেদিনই সোমনাথবাবু প্রেস কনফারেন্স করে বলে দিয়েছিলেন: আমি এই নোটিসের প্রত্যুত্তর দেব না। আবার নিজের অবস্থান থেকে সরেও আসব না।
[প্রথমত চাই আরও শান্তি-সারসওয়ালা]
ওঁর যুক্তি ছিল, ভারতের সংবিধানই ক্ষমতার পৃথকীকরণের মাধ্যমে পার্লামেন্ট ও সুপ্রিম কোর্টের কাজের জায়গায় স্পষ্ট ভেদরেখা টেনে দিয়েছে। সুতরাং পার্লামেন্টের কাজে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের হস্তক্ষেপ করার অধিকার নেই।
এমন দৃঢ়চেতা এবং আইন-সচেতন স্পিকারের কর্মকাণ্ডে সেদিন বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম। ‘স্পিকার’-এর ঔদ্ধত্য থেকে তিনি এমন পদক্ষেপ করেননি। তিনি আসলে একটি প্রতিষ্ঠানকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন। চেয়েছিলেন সেই প্রতিষ্ঠানের স্বকীয়তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে।
ভারত-মার্কিন পরমাণু চুক্তি নিয়ে তাঁর নিজের দলের সঙ্গে ওঁর মতের সংঘাত ভীষণই চর্চিত একটা বিষয়। এক্ষেত্রেই দেশের স্বার্থে তিনি দলীয় অনুশাসন অগ্রাহ্য করতে দ্বিধা করেননি। সাফ জানিয়েছিলেন, ‘আমি যেদিন থেকে স্পিকার হয়েছি, সেদিনই আমি দলের আনুগত্য ছেড়ে বেরিয়ে এসেছি।’ শিখিয়েছিলেন, দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে কীভাবে দেশের স্বার্থ রক্ষা করতে হয়। অথচ ১০ বারের সাংসদের প্রতি তাঁর দল সুবিচার করতে পারেনি। দল তাঁকে বহিষ্কার করায় একাকী অশ্রুপাত করেছেন। তবু দলের নামে কোনও কুকথা বলেননি। এই ‘ডিগনিটি’ও কি আজকের এই মূল্যবোধ দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার সময়ে শেখার মতো নয়?
লেখক রাজ্যসভার সদস্য
[কিং হতে চাননি, ছিলেন কিংমেকার]
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.