রাজ্যপাল বদলের ভার কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের হাতে। অমিত শাহ মনে করলেই নতুন রাজ্যপাল আসবে। আনন্দ বোস চলে গেলে শুধু তৃণমূল সরকার নয়, খুশি হবেন রাজ্য বিজেপি নেতারাও। বোস তাঁদের প্রিয় হয়ে উঠতে পারেননি। ধনকড়ের আমলে রাজভবনে যে মৌরসিপাট্টা তাঁরা ভোগ করেছিলেন, তা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে আনন্দধামে। লিখছেন কিংশুক প্রামাণিক।
ধর্মবীর থেকে জগদীপ ধনকড়, লাল আমল থেকে নীল শাসন, রাজ্য সরকারের সঙ্গে রাজভবনের সংঘাত ও সংঘর্ষ নতুন কোনও ঘটনা নয়। বরং যুগে-যুগে এই স্নায়ুযুদ্ধ ‘ছিল’, ‘আছে’ এবং যতক্ষণ পদটির বিলোপ না হচ্ছে ততক্ষণ ‘থাকবে’-ও।
এই সংঘাতে অগ্নু্যৎপাতের হলকা খানিক থাকে বটে, কিন্তু লাভা উদ্গিরণের তাণ্ডব ঘটে না। কারণ, সংবিধান রাজ্যপালকে ততটা ক্ষমতা দেয়নি, যতটা তিনি প্রয়োগ করে একটি নির্বাচিত সরকারকে চ্যালেঞ্জ করে জয়ী হতে পারেন। অাক্ষরিক অর্থে ঠুঁটো জগন্নাথ। আদতে, ‘সোজা’ অথবা ‘উল্টো’ কোনও যাত্রার ক্ষমতাই রাজ্যপালের নেই। তিনি আয়েশের রথে শোভিত। একটু সমালোচনা করে বললে, কেন্দ্রের মদতে বিরোধী দলের সরকারকে বিপাকে ফেলা, অথবা সরকারকে বিপদে ফেলার বহুমাত্রিক ষড়যন্ত্রে শামিল হওয়া ছাড়া তিনি নির্বাচিত প্রশাসনে নাক গলাতে পারেন না।
বাবাসাহেব অাম্বেদকরের প্রণীত সংবিধানকে সামনে রেখে যখন ভারতীয় গণতন্ত্রের জয়যাত্রা শুরু হয়, তখন কারা রাজ্যপাল হবেন, তা নিয়ে একটি সম্যক নীতি মেনে চলা হত। বলা হয়েছিল, দেশ তথা জাতির সুযোগ্য, প্রাজ্ঞ ও অভিজ্ঞরাই এই পদ অলংকৃত করবেন। রাজ্যপাল কখনও রাজনৈতিক দলের সেবক হবেন না, রাজনৈতিক পরিচয়ও ব্যবহৃত হবে না। তঁার বিচারধারায় থাকবে নিরপেক্ষতা এবং বিবেক। রাজ্যের উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে তঁার পরামর্শ হবে উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। রাজ্যপাল খানিকটা মুখ্যমন্ত্রীর অভিভাবকের মতোই। তিনি নীতিজ্ঞান দিতে পারবেন, কিন্তু ক্ষমতা দেখাবেন না।
নিন্দুকরা অবশ্য বলে, প্রবীণ ও বিশিষ্টদের সম্মানজনক পুনর্বাসনের দিতেই তৈরি হয়েছিল রাজ্যপাল পদ। পরে রাজভবনগুলি দলীয় মার্গদর্শকদের পুনর্বাসন কেন্দ্র হয়ে ওঠে। বিধানসভায় পাস হওয়া সরকারি বিলে সুবোধ বালকের মতো স্বাক্ষর করা এবং রাজ্যের কাজে নজরদারি করে কেন্দ্রকে তথ্য সরবরাহ করা
ছাড়া কোনও সাংবিধানিক দায়িত্ব রাজ্যপালদের দেওয়া হয়নি।
কিন্তু রাজনৈতিক জনরায় পদদলিত করে ক্ষমতা ‘দখল’ করার স্বৈরতন্ত্র যবে থেকে দস্তুর হয়ে উঠল, তবে থেকে রাজ্যপাল হতে লাগলেন সেসব ব্যক্তি, যঁারা দিল্লির শাসকের তঁাবেদার। মেধা, যোগ্যতার মাপকাঠি চলে গেল পিছনে। কালক্রমে রাজ্যপালরা হয়ে উঠলেন কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক প্রতিনিধি। পদের গরিমা যা-ই বলা হোক, আসলে ভারতীয় গণতন্ত্রে রাজ্যপাল হলেন সেই ‘রোবট’, যঁার কাজ ‘বস’ কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশ পালন করা।
যদি একই দলের রাজ্য সরকার হয়, তাহলে রাজ্যপাল হবেন মোমের পুতুলের মতো। নখ-দঁাতহীন এক কার্যকাল। পদের সুখভোগ ছাড়া তঁার আর কোনও কাজ নেই। কিন্তু যদি অঙ্গরাজ্যে বিরোধী দলের সরকার হয়, তাহলে সেখানে রাজ্যপালের অন্য রূপ। তঁার কাজ প্রতিনিয়ত রাজ্য সরকারকে বিব্রত করা। সমান্তরাল ক্ষমতা প্রদর্শন করে দাদাগিরি ফলানো। ব্যাপারটা খানিক একান্নবর্তী পরিবারে বাল্যবিধবা অথবা বিয়ে না-হওয়া ননদের খবরদারির মতো। পরিবারের কর্তার বদান্যতায় সংসারের সব কাজে নাক গলানো, বাধা দেওয়া, কর্তৃত্ব ফলানো। বাস্তবে কোনও অধিকারই তার সংসারে নেই। গৃহকর্ত্রীরই হাতে হেঁশেলের চাবি।
এ-ই হল রাজ্যপালেদের অবস্থা। প্রতিনিয়ত কেন্দ্র বনাম রাজ্যের যুদ্ধে দাবার বোড়ে হয়ে রাজভবন অতিসক্রিয়। সাম্প্রতিক সময়ে রাজ্যপালদের বেশ কিছু ন্যক্কারজনক ভূমিকা গণতন্ত্রকে আঘাত করেছে। রাজ্যপালরা রাজনৈতিক নেতার মতো কাজ করেছেন নিজেদের কেরিয়ারের দিকে তাকিয়ে। জম্মু-কাশ্মীরের প্রাক্তন রাজ্যপাল ‘বিদ্রোহী’ হয়ে ওঠার পর পুলওয়ামায় জওয়ানদের রক্তস্নান নিয়ে যে ‘গোপন তথ্য’ ফঁাস করেছেন, তা সত্যি হলে ভয়ংকর। তবে কেউ ধোয়া তুলসীপাতা নয়। রাজ্যপালকে দিয়ে রাজ্যের বিরোধী দলের সরকারকে জব্দ করার কাজটা শুরু করেছিল কংগ্রেস। বিজেপি সেই চটি পায়ে গলিয়ে রাজভবনকে দলীয় দফতর বানিয়ে ছেড়েছে।
পশ্চিমবঙ্গ এমন একটি রাজ্য যেখানে বিগত ৪৭ বছর কেন্দ্রবিরোধী সরকার ক্ষমতায় রয়েছে। বিজেপির ভাষায় ‘ডাব্ল ইঞ্জিন সরকার’ যাকে বলে, তা নেই বাংলায়। ৩৪ বছরের বাম শাসনের বেশিরভাগ সময় কংগ্রেস ছিল কেন্দ্রের ক্ষমতায়। ভি. পি. সিং ও চন্দ্রশেখরের জনতা সরকার ছিল দু’-বছর। এইচ. ডি. দেবেগৌড়া ও ইন্দর কুমার গুজরালের যুক্তফ্রন্ট সরকারও ছিল কমবেশি দু’-বছর। আর অটলবিহারী বাজপেয়ীর সময় ১৩ মাস ও পঁাচ বছর এনডিএ সরকার। জনতা ও যুক্তফ্রন্টের সময়টা বামেরা বন্ধু-সরকার পেয়েছে। প্রথম ইউপিএ সরকারের সাড়ে তিন বছরও কংগ্রেসকে সমর্থনের সুবাদে রাজভবন মাথাব্যথা হয়নি জ্যোতি বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যদের। কিন্তু অন্য সময় রাজ্যপালের সঙ্গে তীব্র সংঘাত হয়েছে আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের।
মমতা বন্দে্যাপাধ্যায়ের ১৩ বছরের মধ্যে ১০ বছর ‘বিজেপির রাজ্যপাল’-কে সামলাতে হচ্ছে। সংঘাত সপ্তমে উঠেছিল জগদীপ ধনকড়ের সময়। মুখ্যমন্ত্রীর মতো জেলায় গিয়ে সমান্তরাল প্রশাসনিক বৈঠক ডাকতেন তিনি। বিরক্ত মুখ্যমন্ত্রী একবার কেন্দ্রকে বলেছিলেন ধনকড়কে সরিয়ে নিতে। এই পরম্পরায় সি. ভি. আনন্দ বোসের অধ্যায় যে একই খাতে প্রবাহিত হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই প্রাক্তন সরকারি আমলাকে বাংলায় আনা-ই হয়েছিল ধনকড়ের যোগ্য উত্তরসূরি হয়ে ওঠার জন্য। কিন্তু কালক্রমে অদ্ভুত এক পরিস্থিতি তৈরি হয়! অাইনসভায় পাস হওয়া বিলে সই না-করা অথবা দুই নির্বাচিত বিধায়কের শপথ আটকে দেওয়ার মতো উদ্ভট কাণ্ডই শুধু নয়, রাজ্যকে উপেক্ষা করে যাকে-তাকে উপাচার্য নিয়োগ থেকে শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়ার বহু ঘটনা তিনি ঘটিয়েছেন। এমনকী, দুই পুলিশ কর্তার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করার জন্য দিল্লিতে সুপারিশও করে বসেছেন সম্প্রতি।
এই অবধি ঠিক ছিল। কিন্তু সহসা রাজভবনের এক মহিলা কর্মী অভিযোগ করলেন তঁার শ্লীলতাহানি করেছেন আনন্দ বোস। এককথায় ভয়ংকর অভিযোগ। রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধান কাঠগড়ায়। ব্রিটিশ আমল থেকে রাজভবনের বাড়িটি অনেক ঘটনার সাক্ষী। বড়লাটদের সুখভোগের কীর্তিকলাপের সরস কাহিনি সুবিদিত। কিন্তু তাই বলে স্বাধীন দেশে এমন কাণ্ড! যতক্ষণ না পূর্ণাঙ্গ তদন্ত হবে ততক্ষণ কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা যায় না। কিন্তু একজন মহিলা যখন অভিযোগ করছেন, তখন কেন পদক্ষেপ করা যাবে না? তিনি রাজ্যপাল বলে? গণতান্ত্রিক দেশে কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। সবার জন্য আইন এক। সেই আইনে বোস যদি বেকসুর প্রমাণিত হন, তাহলে খুবই ভাল। কিন্তু তদন্ত করা যাবে না কেন? ঘটনার পর স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, তিনি আর রাজভবনে যাবেন না। তঁার বক্তব্য, সেখানে মহিলারা নিরাপদ নয়। তিনিও নিরাপত্তার অভাববোধ করছেন। রাজ্যপালের সঙ্গে কথা বলার দরকার হলে বাইরে বলবেন।
জগদীপ ধনকড়ের সঙ্গেও মমতা বন্দে্যাপাধ্যায়ের বিরোধ হয়েছে। দু’জনের কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। অনুষ্ঠানে একজন অপরজনকে পাশ কাটিয়ে গিয়েছেন। কিছু দিন পরে সমস্যা মিটে গিয়েছে। মমতাকে ছোট বোন বলে চা খেতে আমন্ত্রণ করেছেন ধনকড়। কিন্তু আনন্দ বোস মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সেই সম্পর্ক রাখতে পারলেন না। মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করে বসলেন।
অথচ শুরুটা খারাপ করেননি। স্ব-ইচ্ছায় গ্রহণ করা ‘বোস’ পদবির নেপথে্য নেতাজি-প্রীতি জড়িয়ে বঙ্গবাসীর আবেগে টোকা দিয়েছিলেন। রাজভবনে বাংলা শেখার হাতেখড়ি নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সহযোগিতার কথা বলেছিলেন। কিন্তু আজ তঁার আম ও ছালা দুই যাওয়ার উপক্রম। কেন? কেননা সি. ভি. আনন্দ বোসের দুর্ভাগ্য তিনি শুধু কলকাতা নয়, একই সঙ্গে দিল্লির আস্থা হারাচ্ছেন। যে ‘কাজ’-এ তঁাকে বাংলায় পাঠানো হয়েছিল, তা করে দেখাতে তিনি ব্যর্থ বলে বিজেপির অন্দরে গুঞ্জন। ফলে শীঘ্রই তঁাকে সরিয়ে নতুন কাউকে আনার ভাবনা নাকি শুরু হয়ে গিয়েছে।
রাজ্যপাল বদলের ভার কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের হাতে। অমিত শাহ মনে করলেই নতুন রাজ্যপাল আসবেন। আনন্দ বোস চলে গেলে শুধু তৃণমূল সরকার নয়, খুশি হবেন রাজ্য বিজেপি নেতারাও। বোস তঁাদের প্রিয় হয়ে উঠতে পারেননি। ধনকড়ের আমলে রাজভবনে যে মৌরসিপাট্টা তঁারা ভোগ করেছিলেন, তা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে আনন্দধামে। ধনকড় দুঁদে রাজনীতিক ছিলেন। তঁার পরামর্শ এবং গাইডলাইন রাজ্য বিজেপির নেতারা পেতেন রাজভবন থেকে। সবার অবাধ গতি ছিল। স্বভাবতই রাজ্য বিজেপি নেতাদের একটি অংশ চাইছে দেড় বছর পর যেহেতু বিধানসভা ভোটের প্রস্তুতি শুরু হবে, সেজন্য রাজভবনে এমন কেউ আসুক,
যিনি ধনকড়ের মতো অতিসক্রিয়। এই প্রেক্ষাপটে অনেকগুলি নাম ভাসছে। ’২৬-এর ভোটের আগে একজন শক্তিশালী ব্যক্তি খুঁজছে বিজেপি।
তবে আনন্দ বোস বেঁচে যেতে পারেন রাজনীতির বিপরীত প্রতিক্রিয়ায়। বর্তমান প্রেক্ষাপটে যদি মেয়াদ শেষের আগেই বোসকে সরানো হয়, তাহলে রাজ্যের শাসক দলও খুশি হবে। তাদের সব অভিযোগ মান্যতা পেয়ে যাবে। রাজ্যপাল না-থাকলে বোসের ‘রক্ষাকবচ’-ও
যাবে উঠে। তখন রাজ্য প্রশাসন পদক্ষেপ করতে পারবে। মুখ পুড়বে দিল্লির। বিজেপি নেতৃত্বকে ভাবাবে এই পর্ব। তাই শেষ পর্যন্ত কী হয়, একটু অপেক্ষা করতে হবে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.