মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দাপ্রধান তুলসী গ্যাবার্ড দিল্লি এসে যা বললেন, তাতে ঢাকার কপালে চিন্তার ভাঁজ গভীর হয়েছে। যে-আশঙ্কার কথা জো বাইডেনকে বোঝানোর চেষ্টা করেও মোদি ব্যর্থ হয়েছিলেন, এত দিনে ‘প্রিয়বন্ধু’ ট্রাম্প সেই যুক্তি ‘অকাট্য’ বলে মেনে নিলেন। ‘ভারতের চোখ দিয়ে’-ই বাংলাদেশ সমস্যা দেখবে আমেরিকা। লিখছেন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়।
‘বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ’-এর মতো শুরুতেই বলে নেওয়া দরকার, ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষেত্রে কোনও কিছুই চূড়ান্ত নয়। ওই যে কথায় বলে না, জোচ্চরের বাড়ি ফলাহার, না অঁাচালে বিশ্বাস নেই খেলাম কি খেলাম না, এটা অনেকটা সেইরকম। দ্বিতীয় ইনিংসে তিনি এতটাই ‘আনপ্রেডিক্টেবল’ যে একশো ভাগ নিশ্চিত না হয়ে কোনও ঘোষণা করাই উচিত নয়। তঁার অভিবাসী নীতি, শুল্ক নীতি, কূটনীতি বা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক শেষ পর্যন্ত কোন খাতে বইবে তা পুরোপুরি আন্দাজ করা অসাধ্য। সেই প্রমাণ তিনি বারবার রেখে চলেছেন। রাশিয়া, চিন, মেক্সিকো, কানাডা মায় ‘বেস্ট ফ্রেন্ড’ নরেন্দ্র মোদির ভারতও তাই এখনও বোঝার চেষ্টা চালাচ্ছে, ট্রাম্পের দুই প্লাস দুই শেষ পর্যন্ত চার হবে না বাইশ!
সবচেয়ে বেশি চিন্তা– একদা ভারতের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও বিশ্বস্ত প্রতিবেশী বাংলাদেশের। প্রায় সাত মাস ধরে তারা একটা বিষয়ই বোঝার চেষ্টা করছে, আঙ্কল স্যাম শেষ পর্যন্ত তাদের কোন চোখে দেখবে। বুঝতে চেয়েছে ভারতও– জো বাইডেনের দৃষ্টিতে ডোনাল্ড ট্রাম্প বাংলাদেশকে দেখবেন, না কি বাস্তববাদী হবেন। মেঘের কোলে রোদ হাসার মতো এত দিন পর মনে হচ্ছে, ডোনাল্ড ট্রাম্প হয়তো ভারতের চোখ দিয়েই বাংলাদেশের ঘটনাবলি দেখতে ও
বুঝতে চলেছেন। মোদির সফরের সময় প্রথমে ট্রাম্প কিছুটা রেখে-ঢেকে বলটা ভারতের কোর্টে ঠেলে দিয়েছিলেন। বুঝিয়েছিলেন, বাংলাদেশকে ভারতই সবচেয়ে ভাল বোঝে। তঁার সেই কথার অনেকরকম ব্যাখ্যা হয়েছিল। বিশেষ করে বাংলাদেশে। কিন্তু দিল্লি এসে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা প্রধান তুলসী গ্যাবার্ড খুল্লমখুল্লা যা বললেন, তাতে ওভাল অফিসের
বার্তার ভুল ব্যাখ্যা আর সম্ভবপর নয়। কূটনীতিতে সিদ্ধান্তের যৎকিঞ্চিৎই মৌখিকভাবে প্রকাশ করা হয়। কিন্তু তুলসী সে-রাস্তা মাড়াননি। যা বলেছেন, তাতে ঢাকার কপালে চিন্তার ভঁাজ গভীর হয়েছে। ভারতও স্বস্তির শ্বাস ফেলছে। প্রধানমন্ত্রী মোদি এখন নিজেই নিজের পিঠ চাপড়াতে পারেন। প্রতিবেশী দেশের জাতীয় সংসদের ভোটের আগে যে-আশঙ্কার কথা বাইডেনকে পইপই করে বোঝানোর চেষ্টা করেও তিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন, ট্রাম্প সেই যুক্তি অকাট্য বলে মেনে নিয়েছেন। অবশ্যই এটা মোদির শ্লাঘার বিষয়।
রাজনৈতিক পালাবদল-পরবর্তী বাংলাদেশ নিয়ে তুলসী দু’টি মন্তব্য করেছেন। একটি হল, সে-দেশে সংখ্যালঘুদের প্রতি অত্যাচার। এই ছবিটা প্রথম দিন থেকেই মোদি সরকার ও তাদের দল বিজেপি এঁকে চলেছে। বিষয়টি অবশ্যই বিতর্কিত। অভিযোগও একপেশে। এক যুগ যাবৎ বাংলাদেশ চর্চার কারণে এই অভিযোগ ধ্রুবসত্য বলে মেনে নিতে আমার ঘোর অনীহা। এই বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের দাবি মোটেই ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। হাসিনা সরকারের পতনের পর সে-দেশে যা ঘটেছে তার প্রায় পুরোটাই আওয়ামী লীগের নেতা-সমর্থক-কর্মীদের প্রতি ক্রোধ ও ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ।
সে-দেশের এক বিরাট অংশের চোখে সংখ্যালঘু হিন্দুও আওয়ামী লীগ সমার্থক। সেই ‘অপরাধের শাস্তি’ তাদের পেতে হয়েছে, সীমানার এধারে যা ‘হিন্দু নির্যাতন’ বলে চিত্রিত। গণরোষ ও গণপ্রহারে সাম্প্রদায়িকতার ছোবল একেবারেই যে ছিল না, তা নয়। কিন্তু সামান্য। বরং, দেখা গিয়েছে, ওই সময় সংখ্যালঘুদের রক্ষায় সব ধর্মের মানুষ জোটবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করেছে। প্রতিরোধে নেমেছে। হিন্দু পাড়া, মন্দির পাহারা দিয়েছে। এই বাস্তবতার কথা আমি এই স্তম্ভে লিখেওছি। এখনও বলছি। সংখ্যালঘু নির্যাতনের ক্যানভাস তুলে ধরার মধ্য দিয়ে এ দেশে ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতির প্রত্যক্ষ যোগাযোগ রয়েছে। এই ন্যারেটিভ
তুলসী কেন তুলে ধরেছেন তা তঁার অতীত মন্তব্য ও হিন্দুত্ববাদী চরিত্রের মধ্যেই প্রতিফলিত।
তুলসীর দ্বিতীয় বক্তব্য– ইসলামি সন্ত্রাসবাদ ও তার মতাদর্শ নিয়ে। তাঁর ভাষায়, ‘ইসলামি সন্ত্রাসবাদীদের হুমকি এবং বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীর বিশ্বব্যাপী তৎপরতা একই মতাদর্শ ও লক্ষ্য দ্বারা পরিচালিত। সেই লক্ষ্য হল ইসলামি খিলাফতের মাধ্যমে শাসন কায়েম করা। এই মন্তব্যের পিঠে তুলসী বলেছেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।’ বাংলাদেশের নাম করে তুলসী এরপর বলেন, ‘বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। বিশ্বের সর্বত্র ইসলামি সন্ত্রাসবাদ নির্মূল করতে ট্রাম্প প্রশাসন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
খুব স্বাভাবিক, একেবারে চঁাচাছোলা এই মন্তব্য বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের গাত্রদাহের কারণ হবে, হয়েওছে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সরকার ওই মন্তব্য খণ্ডন করেছে। বলেছে, তুলসীর মন্তব্য ‘বিভ্রান্তিকর, বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ও সুনামের জন্য ক্ষতিকর। বাংলাদেশে চিরকাল শান্তিপূর্ণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ইসলামের চর্চা হয়েছে। উগ্রপন্থা ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের লড়াইও অসাধারণ।’ তুলসীর দ্বিতীয় বক্তব্য পুরোপুরি অন্যায্য বলে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতির বিচারে। এ-কথা অনস্বীকার্য, উগ্র ইসলামি গোষ্ঠী ইদানীংকালে প্রবলভাবে মাথাচাড়া দিচ্ছে ও দেওয়ার চেষ্টা করছে।
হাসিনার আমলে যারা সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে প্রবল চাপে ছিল, পালাবদলের পর তারা গা-ঝাড়া দিয়ে উঠছে। জামায়েত ইসলামির নতুন আমির অন্যদের কাছে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে সচেষ্ট। নানা সময়ে যুক্তিপূর্ণ কথাও তিনি বলছেন। কিন্তু বাস্তবে তার প্রতিফলন সেভাবে দেখা যাচ্ছে না। ৩২, ধানমণ্ডি ভেঙে দেওয়ার সময় খোদ ঢাকায় আইসিসের পতাকা উড়তে দেখা গিয়েছে। নারায়ণগঞ্জে কালেমা-সহ আইসিসের পতাকা হাতে মিছিল করতে দেখা গিয়েছে যুবকদের। নিষিদ্ধ হিজবুত তাহরির কয়েকশো জনতা নিয়ে ঢাকায় মিছিল করেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের উপর এইসব জঙ্গি গোষ্ঠীর প্রভাব নিয়ে সে-দেশের গণমাধ্যমেও লেখালেখি হচ্ছে। অগুনতি মাজার ধ্বংস হয়েছে। আক্রান্ত হয়েছে লালন মেলা। সুফিবাদের সমালোচনা হচ্ছে খোলামেলা। হুমকি দেওয়া হচ্ছে নাচ-গান বন্ধের। চলচ্চিত্র নায়িকাদের দোকান বা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান উদ্বোধন না-করার ফতোয়া জারি হচ্ছে।
রবীন্দ্রনাথ এবং তঁার সৃষ্টি জাতীয় সংগীতের উপরেও চোরাগোপ্তা ‘আক্রমণ’ যে হয়নি তা নয়। এই মুহূর্তের বড় জিজ্ঞাসা, বাঙালি এবার নির্ভয়ে ও নির্ভার চিত্তে পয়লা বৈশাখের দিন নতুন বছর আবাহন করতে পারবে কি না।
মহম্মদ ইউনুসের সরকার তার টলমলে ভাব এখনও কাটাতে পারল না। ছাত্ররা নতুন দল গড়েছে ইউনূসের আশীর্বাদ নিয়ে। তিনি তাদের সাফল্যই শুধু কামনা করেছেন তা নয়, তাদের প্রতি আস্থাও রেখেছেন। ইসলামপন্থী দলগুলি চেষ্টা করছে একে-অন্যের কাছাকাছি আসতে। জামায়েত ইসলামির গর্জন যত, বর্ষণ তত নয়। এককভাবে সাড়ে ৪ শতাংশ ও জোটবদ্ধভাবে ৮ শতাংশের বেশি জনপ্রিয় ভোট তারা কখনও পায়নি। ইসলামপন্থী দলগুলোর রামধনু জোট গড়তে এবার তারা আগ্রহী। সবার নজর ভোটের দিকে। শক্তি সঞ্চয় করছে উগ্রপন্থী ইসলামি সংগঠনও। সরকার এখনও এমন কোনও দৃষ্টান্ত রাখতে পারেনি– যাতে বোঝা যায়, ইসলামি সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে রুখে দঁাড়াতে তারা আদাজল খেয়ে নেমেছে। হিজবুত তাহরির মিছিলে লাঠি চালিয়ে পুলিশ তার শিরদঁাড়া খোঁজার চেষ্টা করেছে ঠিকই, কিন্তু এখনও কোনও অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে পারেনি। উল্টে, জনতার কাছে পুলিশের শীর্ষকর্তার কাতর আহ্বান– প্লিজ, আমাদের আক্রমণ করবেন না। ভরসা করতে শিখুন।
তুলসী গ্যাবার্ডের কথাবার্তা ইউনুস সরকারের পছন্দ না হওয়ারই কথা। কিন্তু তাদের ভেবে দেখা দরকার, এখন যে পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা প্রধান এত বড় অভিযোগ করছেন, তা তাদেরই সৃষ্টি। সাত মাসে দেশবাসীকে আশ্বস্ত করার মতো কিছুই তারা উপহার দিতে পারেনি। পরবর্তী সাত মাসেও পারবে কি না সন্দেহ। ‘ইসলামি সন্ত্রাসী’দের কাছে বাংলাদেশ এখনও হয়তো ‘মুক্তাঞ্চল’ হয়ে ওঠেনি, কিন্তু সবাই জানে, সরকারহীনতা ও প্রশাসনিক স্থবিরতা চূড়ান্ত অরাজকতারই অঁাতুড় ঘর। ডেমোক্র্যাটদের স্নেহধন্য মুহাম্মদ ইউনূস নিজেই নিজেদের টেনে এনেছেন ট্রাম্পের আতসকাচের তলায়। অগত্যা তুলসী গ্যাবার্ড বুঝিয়ে দিলেন, বাংলাদেশকে তারা ভারতের চোখ দিয়েই দেখবেন।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.