বোরিয়া মজুমদার: ৭ মার্চ, রবিবার, BJP-র ব্রিগেডের দিন বাংলার আপামর সংবাদমাধ্যম যখন কী ঘটছে সেখানে তা তুলে ধরতে ব্যস্ত, তখনই পাখির চোখের মতো আরও একদিকে তাদের লক্ষ্য ছিল স্থির– সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় (Sourav Ganguly)। তিনি কি রাজনীতিতে যাবেন, না যাবেন না? সৌরভের রাজনীতিতে হাতেখড়ির দিন কি আসন্ন? হাওয়া কি তারই জানান দিচ্ছে? না কি তিনি রাজনীতির চেয়ে খেলাকেই প্রাধান্য দিয়ে আপাতত রাজনীতি থেকে দূরে থাকার সিদ্ধান্তেই অটল থাকবেন? সেদিন মিডিয়ার সঙ্গে যুক্ত বন্ধুদের অনেকেই ফোন করে জানতে চেয়েছিল, সৌরভের পরিকল্পনা সম্বন্ধে আমি ওয়াকিবহাল কি না। সৌরভের বেহালার বাড়ির সামনে সাংবাদিকরা রীতিমতো ওত পেতে ছিলেন, কারণ সেদিন তাঁর বাড়ি থেকে বের হওয়া এবং ব্রিগেডে যাওয়া যদি নিশ্চিত হয়, এই নির্বাচনে তার চেয়ে বড় খবর আর কী হতে পারে! সময় যত এগোতে থাকে তত পরিষ্কার হয়ে যায়– সৌরভ কোথাও যাচ্ছেন না। অবশ্য লোকজনের অনুমান থেমে থাকেনি, কেউ কেউ মনে করেছেন, তিনি হয়তো পরে রাজনীতির অন্দরমহলে প্রবেশ করবেন।
সৌরভের বিষয়ে চালু হওয়া ‘ন্যারেটিভ’ এককথায় ভীষণ আকর্ষণীয়। প্রথমে আমরা শুনলাম, BCCI-এর সভাপতি হওয়ার সময়েই তিনি নাকি গোপন চুক্তি করেছেন। খুবই সরল একটা চুক্তি, যাতে তিনি বলেছেন, তাঁকে বিসিসিআইয়ের সভাপতি করা হলেই তিনি বাংলায় বিজেপিতে যোগ দেবেন। সৌরভ অবশ্য চিরকালই এই চুক্তির কথা ‘ভিত্তিহীন’ বলে দাবি করে এসেছেন। শেষে অমিত শাহ-ও একটি সাক্ষাত্কারে চুক্তির গল্পটিকে উড়িয়ে দেন। অবশ্য তাতে গুজব-রটনা থেকে সৌরভ নিস্তার পাননি। নির্বাচনের দিন যত এগিয়েছে, গুঞ্জনের আঁচে তেতে উঠেছে চারদিক। রাজনৈতিক অঙ্গনে যেন সৌরভের নীরব উপস্থিতি টের পাওয়া যাচ্ছিল। পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপালের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতের পর রটনার আগুনে ঘি পড়ে। রাজ্যপাল সেদিন তাঁকে সাধারণভাবেই চা পানের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, কিন্তু আমজনতা এই ঘটনাটিকেও রাজনীতির রঙে রাঙিয়ে ‘উদ্দেশ্যমূলক’ আখ্যা দিতে পিছপা হয়নি।
ব্রিগেডের ওই সমাবেশের পরদিন, ৮ মার্চ, সৌরভের সঙ্গে আমার সাক্ষাতের সুযোগ আসে। দুপুর নাগাদ ওঁর অফিসে প্রায় ২ ঘণ্টা সময় কাটাই। প্রথমত, তাঁকে দেখে মনে হল তিনি সুস্থসবল আছেন, এটা আমাদের সকলের কাছেই স্বস্তিদায়ক। তাঁর চোখে-মুখে ক্লান্তি অথবা অস্বস্তির কোনও চিহ্ন নেই দেখে মনে মনে বেশ খুশিই হলাম। তিনি হালকা মেজাজে আমাকে বললেন, ‘বুঝলেন, আমি কিন্তু নতুন কিছুই অনুভব করছি না। বরং প্রত্যেক সপ্তাহেই অল্প অল্প করে সুস্থ হয়ে উঠছি। হ্যাঁ, স্টেন্ট বসানোর পরে প্রথম দিকে রাতে ঘুম নিয়ে একটা সমস্যা হত বটে, তবে এখন আর কোনও সমস্যা নেই। বিশেষ করে কাজে ফিরে আসতে পেরে পুরোপুরি সুস্থ বোধ করছি।’ এমনকী, সাক্ষাতের শেষে সেদিন আমরা একটা সুগার ফ্রি সন্দেশও ভাগ করে নিই, আমার জন্মদিন উপলক্ষে!
ভারত বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে ওঠার খবরে সৌরভ সেদিন দারুণ খুশি। সিরিজের ফাইনাল ম্যাচের জন্য তিনি ইংল্যান্ড যাবেন জানার পর আমিও নিশ্চিত হলাম, এখনও ওঁর কাছে খেলা ততটাই প্রিয়। সত্যি বলতে, সেদিন আমার মূল জিজ্ঞাস্য ছিল দুটো– প্রথমত, সৌরভের রাজনীতিতে যোগ দেওয়া বা না দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনও ভুল-ঠিকের বিচার আছে কি না? দ্বিতীয়ত, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের জায়গায় নিজেকে দাঁড় করানো কতটা কঠিন, যখন প্রত্যেকে প্রতিনিয়ত অনুমান করে চলেছেন, পরমুহূর্তে তিনি কী করতে চলেছেন? তিনি কি বাড়তি চাপ অনুভব করছেন? না কি অফ স্টাম্পের বাইরের বল ছেড়ে দেওয়ার মতো করেই এই পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ তিনি হাতের মুঠোয় রেখেছেন, যেমনটা করতেন ভারতীয় অধিনায়ক হয়ে?
প্রথম প্রশ্নের উত্তর হল– না, এখানে কোনটা ঠিক বা কোনটা ভুল, তা বিচার্য নয়। কারণ, দিনের শেষে এটি যার-যার নিজস্ব ব্যক্তিগত পছন্দের বিষয়। কেউ রাজনীতি দ্বারা অনুপ্রাণিত বোধ করবেন কি না, তা নির্ধারণ করা অন্যের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। কিন্তু আমার মনে একটা অন্য প্রশ্ন জাগল। সৌরভের ১৯ বছর বয়সি মেয়ে কিছুদিনের মধ্যেই উচ্চশিক্ষার জন্য ইউরোপ পাড়ি দেবে। সৌরভের পিতৃসত্তা কি তাঁর ব্যক্তিসত্তাকে ছাপিয়ে যেতে পারে? তিনি কি বাবা হিসাবে যখন তখন ইচ্ছেমতো লন্ডনে মেয়েকে দেখতে যেতে চাইবেন না? কিন্তু যদি তিনি রাজনীতিতে যোগ দেন, তাহলে কি তিনি একইভাবে মেয়ের সঙ্গে যখন ইচ্ছে দেখা করতে পারতেন? সেক্ষেত্রে কোনটা ঠিক হত, কোনটা ভুল?
আমি নিজেকে ওঁর জায়গায় রেখে বিচার করে বুঝলাম, একজন বাবা হিসাবে যখন ইচ্ছে মেয়েকে দেখার সুযোগ সবসময়ই থাকা উচিত। হয়তো একজন রাজনীতিবিদ-রূপে সৌরভের সেই স্বাধীনতা খানিক খর্ব হত। তবে, এরপরও সিদ্ধান্তের ঠিক-বেঠিক বিচার করার এক্তিয়ার আমাদের নেই। এটি সম্পূর্ণরূপেই একজনের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত, যা তাঁর উপরই ছেড়ে দেওয়া আমাদের কর্তব্য।
এখন প্রশ্ন হল, রাজনীতিতে যোগ দেওয়া নিয়ে এই লাগাতার চাপানউতোরে তাঁর উপর কি কোনও চাপ সৃষ্টি হয়েছিল? উত্তর– অবশ্যই ছিল, এবং এমনটা না হওয়াই বরং অস্বাভাবিক। তবে আমার দেখা মাথা ঠান্ডা মানুষের তালিকায় সৌরভ অন্যতম। গত ২৯ বছর ধরে একে-অপরকে চেনার সুবাদে, ওঁকে আমি কোনও দিন রাগের মাথায় চিৎকার করতে দেখিনি। এটাই ওঁর সবচেয়ে বড় শক্তি এবং সম্ভবত এর জেরেই যে কোনও পরিস্থিতিতেই তিনি আর-পাঁচজনের চেয়ে উন্নত বিবেচক হয়ে ওঠেন। এই শক্তিই হয়তো তাঁর চিন্তাধারায় আনে বাড়তি স্বচ্ছতা।
তাছাড়া, সম্প্রতি তাঁর শরীরের উপর দিয়ে যে ঝড় বয়ে গেল, তারপর নিজের স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে তিনি কি রাজনীতিতে শামিল হওয়ার কথা ভাববেন? যদিও তিনি এখন সম্পূর্ণ সুস্থ, এমনকী, সম্প্রতি আমেদাবাদও গিয়েছেন। তা সত্ত্বেও তাঁর শরীর সারাদিনব্যাপী প্রচারের ধকল নিয়ে নিজের ১০০ শতাংশ উজাড় করে দেওয়ার পরিস্থিতিতে রয়েছে কি না, তা বিবেচ্য। চিকিত্সকরা তাঁকে অনুমতি দিতেন কি না এবং তিনি নিজে কতটা মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলেন– তার কোনও পরিষ্কার নিশ্চিত উত্তর নেই আমার কাছে। তবে তাঁর স্ত্রী এবং কন্যা হাসপাতাল থেকে ফিরে আসার একমাসের মধ্যে সর্বৈবভাবে রাজনীতিতে তাঁর যোগদান সমর্থন করতেন বলে মনে হয় না।
এই লেখায় আমি একাধিকবার বলেছি, কিছু প্রশ্নের নির্দিষ্ট উত্তর আমার অজানা। এবং তিনি যথাযথভাবে, জেনেশুনেই সমস্ত প্রশ্নের আগল খোলা রেখে দিয়েছেন। আমি যখন তাঁকে তাঁর আগামীর পরিকল্পনা জিজ্ঞাসা করি, তিনি হেসে জবাব দিলেন, ‘দেখি না, জীবন আমাকে কোথায় নিয়ে যায়! আমি কোনও দিন ভাবিনি, আমি ভারতের অধিনায়ক হব। আমি অধিনায়ক হয়েছি, কারণ শচীন সেই সময় তাঁর পদ ছেড়ে দেয়। বাকিটা ইতিহাস। এমন একটা সুযোগ এল তখন, যা আমি কল্পনাতেও আনতে পারিনি কখনও। আমি শুধু আমার সাধ্যমতো সুযোগের মান রাখার চেষ্টা করেছি। আমি এটাও কখনও ভাবিনি, আমি বিসিসিআইয়ের সভাপতি হব। আমি সভাপতি হওয়ার আগের মুহূর্তেও জানতাম না, আমার জন্য কী অপেক্ষা করছে। তারপর যা হয়েছে, সেখানে আমি শুধুমাত্র চেষ্টা করেছি যাতে অন্তত কিছু বদল আনা যায়। আসলে কী জানেন, জীবন আমাদের অপেক্ষা আর ধৈর্যের শিক্ষা দেয়, যাতে আমরা সেই নির্ধারিত পথে এগিয়ে যেতে পারি।’
আমিও তাঁর সঙ্গে এ বিষয়ে একেবারে একমত। জীবনের পথে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তিনি কোনও চেনা ছকের ধার ধারেন না। জীবন যেন তাঁর নিজের চেনা ছন্দে প্রস্ফুটিত হওয়ার সুযোগ থেকে কখনও বঞ্চিত না হয়, তা নিশ্চিত করাই তাঁর একমাত্র লক্ষ্য। তাঁর এমন বর্ণময় ধূসর জীবন তাই সেলুলয়েডের হাত ধরে অমরত্বের দাবি রাখে। একথা ঠিক, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় হওয়া সহজ নয়, তবে এমন উত্তেজনায় ভরপুর জীবনই বা কত চোখে পড়ে! সৌরভ এই সত্যি সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল বলেই হয়তো তিনি নিজের মতো করে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারেন। আপামর বাংলা, ভারতবাসী এবং আমার তরফ থেকে তাঁর জন্য রইল আন্তরিক শুভকামনা।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.