ইজরায়েলি বন্দিদের নিগ্রহর পাশাপাশি উঠছে ‘ধর্ষণ’-এর অভিযোগ। সমকামিতার দায়ে ‘হামাস’-এর শীর্ষ নেতৃত্ব প্যালেস্তিনীয় সহযোদ্ধাদের মৃত্যুদণ্ডর বিধান দিয়েছে। উঠছে সমকামী-রূপান্তরকামীদের অধিকার নিয়েও প্রশ্ন। লিখেছিলেন ভাস্কর মজুমদার।
যুদ্ধের পুরস্কার,
তীব্র আকাঙ্ক্ষা ও জ্বলনে মৃত্যুর স্বাধীনতা,
আর আমাদের ভূমি, তার রক্তাক্ত রাতে,
যেন এক রত্ন যা দূরের থেকে দূরে, ঝলমল করে ওঠে
এবং বাহিরের সবকিছু আলোকিত হয়…
আমাদের জন্য, ভিতরে,
আরও বেশি শ্বাসরুদ্ধ হয়ে পড়ি!
(‘জন্মভূমির প্রতি’, মাহমুদ দারউইশ)
সম্প্রতি ‘দ্য নিউ ইয়র্ক পোস্ট’-এর একটি খবরে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। ভারতীয় কিছু সংবাদ সংস্থাও সে-খবর প্রকাশ করেছে। গত বছর ৭ অক্টোবর প্যালেস্তাইন ও ইজরায়েলের যুদ্ধ পুনরায় শুরু হওয়ার পরে, কিছু ইজরায়েলের সৈনিককে বন্দি করে, হামাসের সদস্যরা নাকি তাদের নানা অত্যাচারের পাশাপাশি ধর্ষণও করে। খুব দুঃখজনকভাবে যে কোনও যুদ্ধের রণকৌশল– ধর্ষণ। কিন্তু ব্যাপারটা সেখানেই থামেনি। কিছু উৎস থেকে ‘খবর’ এসেছে যে, হামাসের যেসব সদস্য ইজরায়েলের বন্দিদের উপর ধর্ষণ চালিয়েছিল– তাদের শুধু দল থেকে বহিষ্কার নয়, এমনকী, মৃত্যুদণ্ড অবধি দেওয়া হয়ে থাকতে পারে। তবে ‘মৃত্যুদণ্ড’-র বিধান কেবল এজন্য নয় যে, তারা ধর্ষক। এই চরম শাস্তি দেওয়া হয়েছে– তারা পুরুষদের ‘ধর্ষণ’ করেছে বলে। অর্থাৎ সেই ধর্ষকদের ‘সমকামী’ বলে চিহ্নিত করেই ‘মৃত্যুদণ্ড’-র ফতোয়া দেওয়া হয়েছে।
প্যালেস্তাইনের স্বাধীনতা নিয়ে আবিশ্বের মানুষ দু’টি বিভাগে বিভক্ত। কেউ মনে করে, ইজরায়েলের যুদ্ধ জায়েজ। আর কেউ বলে প্যালেস্তাইনের প্রতিবাদ আসলে তীব্র সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে রুখে দঁাড়ানো। তবে কোনও যুদ্ধেরই কোনও যৌক্তিকতা কখনওই থাকতে পারে না, কারণ ‘যুদ্ধ’ সাধারণ মানুষকেই ‘বলি’ করে বেশি। দশকের-পর-দশক ধরে চলা ইজরায়েল এবং প্যালেস্তাইনের এই সংঘর্ষ দু’-দেশের অগুনতি মানুষের প্রাণ কেবল কাড়েনি, তুলনামূলকভাবে প্যালেস্তাইনই ধ্বস্ত হয়েছে বেশি। প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তো বটেই ছোট-ছোট প্যালেস্তিনীয় শিশুর প্রাণ যেভাবে ইজরায়েল কেড়ে নিয়েছে, তাতে সভ্যতা নিয়ে আমাদের সন্দিহান থাকতে হয়।
কিন্তু কথা হল, একদিন যখন প্যালেস্তাইন সম্পূর্ণ রূপে স্বাধীন হবে, সেদিন সে-সমাজে সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষের জায়গা থাকবে কি? প্যালেস্তাইনে সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষের অধিকার মারাত্মকভাবে খর্ব হয় এমন কোনও ‘খবর’ অন্তত প্যালেস্তাইন থেকে আসেনি, যত না আমেরিকা থেকে এসেছে! তবে প্যালেস্তাইন প্রতি মুহূর্তে যেভাবে লড়ছে– সেই লড়াইয়ে সে-দেশের সমকামী-রূপান্তরকামী প্রতিবাদীরা অংশ নেবে না, তা কে বলতে পারে?
এখন পৃথিবীতে সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষের মুক্তি ও অধিকাররক্ষার চিত্র আসলে সার্বিক মানবাধিকারের এক ভীষণই গুরুত্বপূর্ণ মানদণ্ডরূপে পরিগণিত হয়। ইজরায়েলে সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষের জীবনযাপন থেকে শুরু করে বিবাহ, সম্পত্তি ও সন্তানপালনের সবরকম অধিকার থাকার ছবি প্রায়ই সংবাদমাধ্যমে ভেসে ওঠে। এমনকী, যুদ্ধক্ষেত্রেও তারা রামধনু-পতাকা ব্যবহার করেছে বলে ‘খবর’। কিন্তু সমাজের যৌনসংখ্যালঘু মানুষের সবরকম সমানতা প্রদান করা গেল মানেই হাজার-হাজার শিশুহত্যার রক্ত কি হাত থেকে মুছে ফেলা যায়? সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষের সারা বিশ্ব জুড়েই নিরলস সংগ্রামের ইতিহাস আছে। সেই সংগ্রাম এখনও থামেনি। তথাকথিত উন্নত দেশগুলি সমকামী-রূপান্তরকামী বিদ্বেষী হয়ে উঠছে ক্রমশ। আমেরিকার নতুন প্রেসিডেন্ট শপথ গ্রহণের দিনই ঘোষণা করেছেন, তঁার সরকার রূপান্তরকামী মানুষকে কোনওরকম স্বীকৃতি দেবে না। সামরিক-সহ সরকারি সমস্ত ক্ষেত্রে এখন সেখানে রূপান্তরকামী মানুষ ব্রাত্য। এমতাবস্থায় হামাসের সমকাম-বিদ্বেষী মনোভাবের বিচার করবে কে?
ইজরায়েলের রাজনৈতিক প্রচারের একটি মূল উপাদান প্যালেস্তাইনকে ‘বর্বর’ হিসাবে চিহ্নিত করা, যে, তারা কত সমকাম-বিদ্বেষী এবং নারী-বিদ্বেষীও। আর বিপরীতভাবে, ইজরায়েলকে একটি সমকামীবান্ধব, স্বাধীন ও নিরাপদ দেশরূপে উপস্থাপন করা। এই কৌশল, যাকে প্রায়শই ‘পিঙ্কওয়াশিং’ বলা হয়, শুধু একটি বিভ্রান্তি তৈরির কৌশল নয়, সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষের সামাজিক-রাজনৈতিক অধিকারকে গণহত্যার ন্যায্যতা হিসাবে ব্যবহার করারও প্রচেষ্টা। এর পাশাপাশি সমকামী-রূপান্তরকামী প্যালেস্তিনীয় মানুষের অস্তিত্ব মুছে ফেলার অপচেষ্টাও। যেন প্যালেস্তাইনে কুইয়্যার-জীবনের অস্তিত্ব সম্ভবই নয়। খুব বেশিদিনের ঘটনা নয়, গাজার ধ্বংসস্তূপের উপর একটি রামধনু-পতাকা ধরে থাকা একজন ইজরায়েলের সৈনিকের ছবিতে লেখা ছিল– ‘দেখো, এটা গাজার প্রথম প্রাইড ফ্ল্যাগ!’ এই ভিডিও কলুষিত এক ধারণার জন্ম দেয় যে, সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষ বোধ হয় রামধনু পতাকার অস্তিত্বকে প্যালেস্তিনীয় মানুষের হত্যার চেয়ে বেশি মূল্য দেয়– যাদের বাড়িঘর এবং দেহাবশেষ ওই সৈনিক আর তার রামধনু পতাকার নিচে চাপা পড়ে রয়েছে!
অন্যদিকে, প্যালেস্তিনীয় সমাজে যে-কারণেই হোক একটি প্রতিকূল এবং সমকামবিদ্বেষী পরিবেশ বিরাজ করে। তা সত্ত্বেও সমকামী-রূপান্তরকামী প্যালেস্তিনীয় মানুষ প্রায়শই ‘সমকামী-বান্ধব স্থান’গুলিতে সংগঠিত হয়ে নিজেদের কৌশলগত পরিকল্পনাগুলি সার্থক করে। সেসব কুইয়্যার-বান্ধব স্থানের তথ্য সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্পূর্ণ মৌখিকভাবে ছড়ানো হয়।
ইজরায়েলি এবং প্যালেস্তিনীয় সমকামী এবং রূপান্তরকামী মানুষের মধ্যে প্রতিনিধিত্বগত স্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। ইজরায়েলে সমকামী অধিকারে অগ্রগতি, সামাজিক মনোভাবের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন, এবং কুইয়্যার-সংস্কৃতির উত্থান ঘটেছে বলে ধরা হয়। অবশ্য আলোচকরা বলেন, এই পরিবর্তন শুধুমাত্র তেল আভিভে ঘটেছে, ইজরায়েল রাষ্ট্রের সর্বত্র নয়। তেল আভিভ একটি পৃথক ভৌগোলিক স্থান, যা রাষ্ট্রকে কুইয়্যার-বান্ধব হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যবহৃত হয়, অন্যদিকে অন্যান্য অঞ্চল জায়নবাদী আদর্শনির্ভর এবং সমকামী-বিদ্বেষ সেসব স্থানে যথেষ্ট বিদ্যমান।
সমকামিতা-রূপান্তরকামিতার একটি ‘পশ্চিমি আদর্শ’ আছে, যা যৌন সংখ্যালঘু মানুষের ‘ক্লোসেট’ (অন্তরাল) থেকে বের করে আনার কথা বলে এবং এই আদর্শই বিশ্বব্যাপী হতে চায় দেশ-কাল-শ্রেণি ও সংস্কৃতির ঊর্ধ্বে গিয়ে। সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষের প্রতি সেই আদর্শ ইজরায়েলও ভাসিয়ে রাখে। কিন্তু সে-আলোচনায় অনেক সময় প্যালেস্তাইনের প্রগতিশীল আইনগুলির কোনও উল্লেখ থাকে না– যেমন, জর্ডানিয়ান দণ্ডবিধি থেকে পায়ুকামকে শাস্তিযোগ্য ‘অপরাধ’ হিসাবে অপসারণ করা হয়েছিল সেই ১৯৫৭ সালে! ইজরায়েল, মারাত্মক ‘সমকামী-বান্ধব’ বলে যারা প্রচার করে, তারা কি জানে না সমকামী প্যালেস্তিনীয়দের জন্য ইজরায়েলে কোনও মানবাধিকার নেই? এমনকী, ইজরায়েলের সৈনিকরা বহু সময় সমকামী-রূপান্তরকামী প্যালেস্তিনীয়দের শুধু যে যথেচ্ছ অত্যাচার করেছে তা নয়, প্যালেস্তাইনের বিরূদ্ধে তাদের ব্যবহারও করেছে ‘প্রকৃত’ যৌন পরিচয় ফঁাস করে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে।
‘হামাস’-এর সদস্যদের সমকামী হওয়ার জন্য মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার খবর সত্যি হোক না হোক– এটা যেমন ঘটনা যে প্যালেস্তাইন সেদিন অবধি মুক্ত নয়– যত দিন সেই সমাজের সব মানুষ, এমনকী যৌনসংখ্যালঘু মানুষের মুক্তি নেই– তেমনই এ-ও সত্য যে, সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষের সবরকমের সামাজিক অধিকার প্রদান করা সত্ত্বেও ইজরায়েলের তরফে ঘটানো গণহত্যালীলা কম অধিক গর্হিত অপরাধ নয়!
(মতামত নিজস্ব)
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.