Advertisement
Advertisement

Breaking News

sexual harassment

যৌন নির্যাতনে লিঙ্গ-পরিচয়ের ভূমিকা

নারীর দ্বারা পুরুষ বা নারীর নির্যাতন সম্ভব?

sexual harassment on gender identity | Sangbad Pratidin
Published by: Kishore Ghosh
  • Posted:December 11, 2023 2:58 pm
  • Updated:December 11, 2023 2:58 pm  

নারীর দ্বারা পুরুষ বা নারীর নির্যাতন সম্ভব? সম্প্রতি একটি মামলার সূত্রে এমন প্রতর্ক মাথা তুলেছে।
লিঙ্গ-নিরপেক্ষ যৌন নির্যাতন আইন প্রসঙ্গে আলোচনা আগেও হয়েছে, কিন্তু তা কার্যকর কতটা হয়েছে? যৌন নির্যাতনের ক্ষেত্রে ক্ষমতার সমীকরণই আলোচ‌্য, যৌনতা বা লিঙ্গ নয়, এই বক্তব‌্যও প্রাসঙ্গিক নয় কি? লিখছেন শতাব্দী দাশ।

সম্প্রতি এ-দেশে এক নারী আরেক নারীকে যৌন নির্যাতনে উসকানির দোষে অভিযুক্ত করতে চেয়ে সুপ্রিম কোর্টকে (Supreme Court) ফাঁপরে ফেলেছেন। সর্বোচ্চ আদালত ভেবে দেখার সময় চেয়েছে। ‘উসকানি’-র অভিযোগেই আদালতের হতচকিত অবস্থা। আইপিসি ৩৭৫ ও ৩৭৬ অনুযায়ী, যৌন নির্যাতনে নারীর ভূমিকা শুধুমাত্র ভুক্তভোগীর, কারণ নির্যাতকের ক্ষেত্রে ‘ম্যান/হি’ ও নির্যাতিতর ক্ষেত্রে ‘উওম্যান/শি’ শব্দগুলি ব্যবহৃত হয়েছে। অবশ্য যদি নির্যাতিতর বয়স আঠারোর কম হয়, তবে ‌‘পকসো’ অনুযায়ী নির্যাতকের পরিচয় (নির্যাতিতর পরিচয়ও) লিঙ্গনির্ভর নয়।

Advertisement

এই নির্দিষ্ট মামলাটিতে না-থেমে, আমরা যৌন নির্যাতনে নারী ও পুরুষের ভূমিকার এই পূর্ব-নির্দিষ্ট দ্বিত্বের বিষয়টি খতিয়ে দেখতে পারি। কিছু উন্নত দেশে যৌন নির্যাতনের আইন লিঙ্গ-নিরপেক্ষ। আমাদের দেশেও বিভিন্ন মহলে সেই দাবি আছে। ২০২২ সালে কেরলে একটি ডিভোর্সের মামলা চলাকালীন বিচারক বলেন, ‘লিঙ্গসাম্যের কথাই যদি ওঠে, তবে লিঙ্গ-নিরপেক্ষ ধর্ষণ আইন নয় কেন?’ প্রেক্ষিত অনুযায়ী কথাটি ছিল অপ্রাসঙ্গিক। অনেক ক্ষেত্রে ধর্ষণের মিথ্যা অভিযোগ করেন নারী, এরকম কিছু তিনি বলতে চাইছিলেন। মেয়েরা যদি ‘মিথ্যা অভিযোগ’ করতে চায়, তবে লিঙ্গ-নিরপেক্ষ আইন থাকা সত্ত্বেও তা করতে পারে।
অন্যদিকে, পুরুষ অধিকার-কর্মীরা এই দাবি প্রায়শ তোলেন, বিশেষত, ভার্মা কমিশনের অনুরূপ প্রস্তাব খারিজ হওয়ার পর। ধর্ষণকে এ-দেশের নিরিখে খতিয়ে দেখে, ২০১৩ সালে ভার্মা কমিশন যা যা প্রস্তাব দেয়, তার প্রায় সবই গৃহীত হয়, শুধু ১) বৈবাহিক ধর্ষণ ও ২) অ-নারী ব্যক্তির ধর্ষণ ছাড়া। মজার কথা, পুরুষ-অধিকার কর্মীরা পুং-ধর্ষণকে আইনের আওতায় আনার থেকেও বেশি কাঠখড় পুড়িয়েছিলেন বৈবাহিক ধর্ষণের আইন বানচাল করতে।

 

[আরও পড়ুন: ঠিক যেন সিনেমা! খুনের দায়ে জেলে, আইন পড়ে নিজের মুক্তি আদায় যুবকের]

২০১৮-’১৯ সাল নাগাদ একবার রাজ্যসভায় বিল পেশ হয়েছিল ধর্ষণ আইনকে লিঙ্গ-নিরপেক্ষ করার দাবিতে। তা প্রথমেই খারিজ হয়ে যায়। তারও আগে, ২০০০ সালে ল কমিশন এ-বিষয়ে এক রিপোর্ট পেশ করেছিল। তখন আপত্তি করেছিলেন নারীবাদী সমাজকর্মী ও উকিলরা। ফ্ল্যাভিয়া অ্যাগনেস বলেছিলেন, ‘মেয়েদের দ্বারা যৌন হেনস্তা সম্ভব, কিন্তু ধর্ষণ নয়।’ বৃন্দা গ্রোভার বলেছিলেন, ‘কোথাও কখনও এরকম কোনও কেস নথিভুক্ত হয়েছে?’ উত্তর, অবশ্যই, না। রেবেকা জন মনে করেছিলেন, এমনিতেই প্রান্তিক নারীসমাজকে আরও কোণঠাসা করা হবে। ‘ইকুইটি’ বা ন্যায়যুক্ত সমতা, ‘ইকুয়ালিটি’ বা খাতায়-কলমে সাম্যের চেয়ে বেশি কার্যকর– এই ভেবেই তঁারা এসব বলে থাকবেন। আমাদের সংবিধানের সাম্যবাদী চরিত্র সত্ত্বেও, একই সংবিধানের ১৫(৩) ধারা অনুযায়ী নারী ও শিশুদের জন্য আলাদা আইন থাকতেই পারে।
কিন্তু তথাকথিত পুরুষ অধিকার-কর্মীরা লিঙ্গ-নিরপেক্ষ যৌন নির্যাতন আইনের ধুয়ো তুলে নারীবিদ্বেষ ছড়াচ্ছেন– এটা যেমন সত্যি, তেমনই আরেক সমান্তরাল সত্য এ-ও হতে পারে যে, কোনও কোনও পুরুষ, তঁারা আপেক্ষিকভাবে সংখ্যায় যতই গৌণ হোন, ধর্ষিত হন। বয়স ১৭ বছর ৩৬৪ দিন হলে পকসো অনুযায়ী আইন সুরক্ষা দেবে, কিন্তু আঠারো বছর হলে নয়–এ ন্যায়সংগত নয়।

ধর্ষণ আইনের দ্বৈতবাদী ভাষা থেকে প্রথমে যে-প্রশ্ন মনে আসা স্বাভাবিক, তা হল, ট্রান্স ব্যক্তি তাহলে সুরক্ষা পান কীভাবে? বস্তুত, সুরক্ষা তঁারা পেতে পারেন– ১) ‘ট্রান্সজেন্ডার পার্সন প্রোটেকশন অ্যান্ড রাইটস অ্যাক্ট’ (২০১৯)-এর দ্বারা, যা ধর্ষণ আইনের তুলনায় নিতান্তই দঁাতনখহীন। ২) ট্রান্সসেক্সুয়াল নারী হয়তো ৩৭৫ ও ৩৭৬ অর্থাৎ সাধারণ ধর্ষণ আইন ব্যবহার করতে পারেন, যদি ধর্ষক পুরুষ হয় (‘হয়তো’, কারণ তঁাকে নারীত্ব প্রমাণ করতে হতে পারে বিরোধী উকিলের সন্তুষ্টির জন্য)।ওদিকে, আইপিসি ৩৭৭ ধারাটির বলে আগে সমকামিতা বে-আইনি ছিল। বস্তুত, এই ধারায় নারী-পুরুষ ও পশুর উপর শিশ্নপ্রবেশ-কেন্দ্রিক, অ-প্রাকৃত যৌনতা নিষিদ্ধ ও শাস্তিযোগ্য ছিল (‘অপ্রাকৃত’-র সংজ্ঞা স্পষ্ট নয়)। সমকামিতাকে যখন অপরাধমুক্ত করা হল, তখন বলা হল, ‘সম্মতিক্রমে’ উক্ত প্রাপ্তবয়স্ক মানুষদের সঙ্গে ‘অপ্রাকৃত’ যৌনতা অপরাধ নয়। বলপ্রয়োগ করা হলে এই আইন এখনও প্রযুক্ত হতে পারে।

কিন্তু তার জন্য ব্যক্তিকে নারী-পুরুষ দ্বিত্বের খোপে নিজেকে অঁাটাতে হবে, আর নির্যাতককে পুরুষ (শিশ্নবিশিষ্ট) হতে হবে। তাহলে পুরুষের উপর পুরুষ বলপূর্বক যৌনতা করলে ৩৭৭ ধারা অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য। সংখ্যাতাত্ত্বিক বিচারে পুরুষের ধর্ষণের অধিকাংশই পুরুষের করা। আশ্চর্যভাবে, নতুন করে যে ভারতীয় ন্যায় সংহিতা, সুরক্ষা সংহিতা, সাক্ষ্য সংহিতা লেখা হচ্ছে– তার খসড়ায় ৩৭৭ ধারার অনুরূপ কিছু পাওয়া যাচ্ছে না। যদি তা চূড়ান্ত পর্যায়েও না থাকে, তবে পুরুষরা আরও অসুরক্ষিত হবেন।
বাকি থাকল আরও দু’টি সম্ভাবনা। নারীই যদি নারীকে ধর্ষণ করেন? লেসবিয়ান সম্পর্কেও অন্তরঙ্গ সঙ্গী কর্তৃক নির্যাতন থাকে। তঁাদের সমাজেও থাকে যৌন নির্যাতন। না, এক্ষেত্রে প্রতিকার নেই।

শেষত, নারীর দ্বারা পুরুষের ধর্ষণ। যা নথিভুক্ত নয়, তা কখনও ঘটেনি, এমন যুক্তি নারীবাদীদের জন্যই আত্মঘাতী হতে পারে। পুরুষের ক্ষমতাহীন অসহায়তার আত্মছবি তার পৌরুষের ইমেজের পক্ষে এতই লজ্জার হতে পারে, যে, নথিভুক্তিকরণ সম্ভব হয়নি, এমনও হতে পারে। হতে পারে, তঁারা ধর্ষিত হলে, বলে উঠতে পারেন না। বললে, হেসে উড়িয়ে দেওয়া হয়।

 

[আরও পড়ুন: সংসদ থেকে বহিষ্কার কাণ্ড: সুপ্রিম কোর্টে মামলা দায়ের মহুয়ার]

নারী-কর্তৃক নয়, কিন্তু ধর্ষিত, এমন পুরুষের সঙ্গে সাক্ষাতের বেশ কিছু অভিজ্ঞতা বর্তমান লেখকের আছে। আবার এমন স্বল্পসংখ্যক ঘটনার অভিজ্ঞতাও আছে, যেখানে নারীর যৌন অগ্রসরতায় পুরুষ বিব্রত হচ্ছেন এবং ধর্ষণের বা নির্যাতনের না হলেও, ‘কনসেন্ট ভায়োলেশন’-এর অভিযোগ করছেন। নারীমাত্রেই অন্যের সীমানা লঙ্ঘনকারী হবেন না, এমন ‘বায়োলজিকাল ডিটারমিনিজম’ সত্যিই নেই। আর পুং-শিশুর যৌন নির্যাতনের অপরাধে পুরুষদের মতো নারীরাও দোষী। শৈশবে যৌন নির্যাতিত বহু পুরুষেরই প্রাপ্তবয়সে যৌনবিমুখতা বা অতি-যৌনতা দেখা যায়। অর্থাৎ, লিঙ্গ-নির্বিশেষে নির্যাতনের প্রভাব মারাত্মক রকমেরই পড়ে। তাহলে সমাধান কী? কোন পথে পুরুষ ও যাবতীয় অ-নারী মানুষের ধর্ষণকে শাস্তিযোগ্য করা যায়, যাতে নারীও ক্ষতিগ্রস্ত না হয়?

ভাবনার কাজটি খানিক এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল কিন্তু ভার্মা কমিশনই। তা শক্তিশালী ধর্ষণ আইনের আওতায় বৈবাহিক ধর্ষণকে আনার সুপারিশের পাশাপাশি আরও বলেছিল, ‘নির্যাতিত’ যে কেউ হতে পারে। আর নির্যাতক?

নির্যাতক মূলত পুরুষ– যদি না নারী বা অন্য কোনও লিঙ্গ ওই বিশেষ ক্ষেত্রে পুংলিঙ্গের নির্যাতিতর চেয়ে বেশি ক্ষমতাশালী হয়। ওরকম বিশেষ ক্ষেত্রে পুরুষ ছাড়া অন্যদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ করা যাবে। মানে, ভার্মা কমিশন বিশ্বাস রেখেছিল, ধর্ষণ যতটা না যৌনতা-বিষয়ক, তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষমতার প্রদর্শন। সমাজে সাধারণত পুরুষ ক্ষমতাবান। কিন্তু বিশেষ ক্ষেত্রে, গৃহকর্ত্রী পরিচারকের চেয়ে, অধ্যাপিকা ছাত্রর চেয়ে, অফিসের নারী-বস অধস্তন পুরুষের চেয়ে বেশি ক্ষমতাবান। এমন ক্ষেত্রে অ-পুরুষ ব্যক্তিকেও অভিযুক্ত করার অধিকার থাকুক, কমিশন বলেছিল।

বিষম সমাজে ধর্ষণ আইন লিঙ্গ-নিরপেক্ষতার চেয়েও বেশি লিঙ্গ-সংবেদনশীলতার দাবি করে। ক্রমে লিঙ্গচর্চার আওতায় আসছে পুরুষ, পৌরুষ, পৌরুষের সামনে ব্যক্তিপুরুষের অসহায়তা। এই পথেই আলো আছে, পারস্পরিক ঘৃণায় নয়।

(মতামত নিজস্ব)
লেখক সমাজকর্মী, প্রাবন্ধিক
[email protected]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement