Advertisement
Advertisement

তবে কি অবলুপ্তির পথে আন্দামানের প্রাচীন সেন্টিনেলিজরা?

সভ্যতা ও ঘৃণার মিথোষ্ক্রিয়া।

Sentinelese tribe towards extinction
Published by: Monishankar Choudhury
  • Posted:November 27, 2018 9:23 am
  • Updated:November 27, 2018 9:23 am  

সুতীর্থ চক্রবর্তী: ডিঙি নৌকায় বসে জন অ্যালেন চাওয়ের শেষ মুহূর্তের ডায়েরিটা খুব তাৎপর্যপূর্ণ। চাও মৃত্যুর আগে লিখে গিয়েছেন, তাঁর মৃত্যুর জন্য যেন সেন্টিনেলিজদের দায়ী না করা হয়। মৃত্যু অনিবার্য জেনেও ২৭ বছরের মার্কিনি ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন আন্দামানের ওই সবুজ দ্বীপটায়। সভ্য মানুষের অ্যাডভেঞ্চারের নেশা। উত্তর সেন্টিনেল দ্বীপে যেমন ৬০ হাজার বছর ধরে ওই জনজাতির মানুষরা প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে আছে, তেমন সভ্য মানুষও কয়েকশো বছর ধরে জীবনকে তোয়াক্কা না করে অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় পৃথিবীকে আবিষ্কার করে চলেছে। সেন্টিনেল দ্বীপে এর আগেও জনজাতির তিরে মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। অ্যালেন চাওয়ের সেসব জানা ছিল। তবুও তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।

[রথযাত্রা চলাকালীনই প্রচারে জোর, রাজ্যে চারটি জনসভা করবেন মোদি]

Advertisement

আমাদের দেশের আইনের চোখে অ্যালেন অপরাধী। উত্তর সেন্টিনেল দ্বীপে যাওয়া দেশের আইনে অপরাধ। যে সাতজন জেলেকে ২৫ হাজার টাকা ঘুষ দিয়ে অ্যালেন সেন্টিনেল দ্বীপে পৌঁছেছিলেন, তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পুলিশ ও কোস্ট গার্ডের চোখে ধুলো দিয়েই অ্যালেন পৌঁছেছিলেন নিষিদ্ধ দ্বীপে। এই অপরাধের মূল্য চুকিয়েছেন প্রাণ দিয়ে। কিন্তু মানুষ যে অজানাকে জানার নেশায় যুগ যুগ ধরে এইরকম অ্যাডভেঞ্চারই চালিয়ে যাবে, তা আমাদের ফের স্মরণ করিয়ে দিয়ে গেলেন মার্কিন তরুণ। জেলেদের কাছ থেকে আমরা যেটুকু জানতে পেরেছি এবং অ্যালেনের শেষ মুহূর্তের ডায়েরি যে কথা বলছে, তাতে তিনি নাকি সেন্টিনেলিজদের মধ্যে খ্রিস্টধর্ম প্রচার করতে চেয়েছিলেন। আমরা জানি না, অ্যালেন কোন ভাষায় ওই সেন্টিনেলিজদের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন? ৬০ হাজার বছর ধরে যাদের কাছে সভ্যতার আলো পৌঁছায়নি, তারা যিশুখ্রিস্টকেই-বা চিনত কী করে?

আন্দামানের যে জনজাতিগুলি রয়েছে, তার মধ্যে আদিম যুগে পড়ে রয়েছে জারোয়া ও সেন্টিনেলিজরা। এরা দু’দলই হিংস্র। জারোয়াদের সঙ্গে অবশ্য ইদানীং সভ্য জগতের একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। সেনা প্রহরায় হলেও জারোয়াদের দ্বীপে এখন সভ্য মানুষের প্রবেশাধিকার রয়েছে। জারোয়াদের সঙ্গে আন্দামানে গবেষণারত নৃতাত্ত্বিকদেরও যোগাযোগ গড়ে উঠেছে। সেন্টিনেলিজরা এখনও ৬০ হাজার বছর আগের সময়েই পড়ে রয়েছে। যেটাকে আমরা ‘প্রস্তরযুগ’ বলে থাকি। এখনও এরা আগুন জ্বালতে পারে না। উত্তর সেন্টিনেল দ্বীপে ফলমূল ও পশু-পাখির যকাঁচা মাংস খেয়ে এরা দিনযাপন করে।
জারোয়াদের সঙ্গে বাঙালিদের পরিচয় ঘটেছিল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কালজয়ী রচনা ‘সবুজ দ্বীপের রাজা’-র হাত ধরে। কাহিনিতে সেই সবুজ দ্বীপের রাজা যিনি, আন্দামানের সেলুলার জেল পালানো স্বাধীনতাসংগ্রামী গুণদা তালুকদার, রহস্যকাহিনির প্রধান চরিত্র কাকাবাবুকে এক জায়গায় বলেছিলেন, ‘জারোয়ারা তোমাদের সভ্যতাকে ঘৃণা করে।’ বস্তুত তাই। এই জারোয়া ও সেন্টিনেলিজরা মানুষের সভ্যতাকে ঘৃণা করে বলেই নিজেদের দূরে রেখেছে। পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্তে সমস্ত জনজাতির মানুষই ধীরে ধীরে আধুনিক সভ্যতার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেছে। মানবসভ্যতার সুফলগুলি তারা গ্রহণ করেছে। কোথাও কোথাও হয়তো প্রাথমিকভাবে সভ্য মানুষের সঙ্গে তাদের সংঘাত ঘটেছে, কিন্তু ধীরে ধীরে মিথোষ্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তারা মূলস্রোতে মিশে গিয়েছে। ব্যতিক্রমী জারোয়া ও সেন্টিনেলিজরা। আরও নির্দিষ্ট করে সেন্টিনেলিজরা। আগেই বলেছি, জারোয়াদের সঙ্গেও এখন কিছু কিছু ক্ষেত্রে মানুষের যোগাযোগ ঘটছে। প্রাথমিকভাবে তারা যতটা হিংস্র ছিল, এখন সেটা কমেছে। সভ্য মানুষের সঙ্গে তাদের একটা যোগাযোগের ভাষাও গড়ে উঠেছে। সাতের দশকে যখন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ‘সবুজ দ্বীপের রাজা’ যখন লিখছেন, তখনও জারোয়ারা এই সেন্টনেলিজদের মতোই ছিল। এখন তারা সভ্য মানুষের উপহারও গ্রহণ করছে। কিন্তু সেন্টিনেলিজরা এখনও কোনওরকম যোগাযোগ গড়ে তুলতে নারাজ।

গল্পে-উপন্যাসে ও লোককথায় জারোয়াদের সম্পর্কে যে মিথগুলি তৈরি হয়েছিল, তা এখনও ষোলোআনা সত্যি এই সেন্টিনেলিজদের ক্ষেত্রে। ‘সবুজ দ্বীপের রাজা’ একসময় যে শিহরন তুলেছিল, খবরের কাগজে অ্যালেন চাওয়ের কাহিনি সেইরকমই অনুভূতির জন্ম দিল। জনজাতির বিষমাখানো তির শেষপর্যন্ত অ্যালেনের প্রাণ কেড়েছে। তাঁর মৃতদেহ পড়ে রয়েছে কোনও সোনাবেলায়। পরিস্থিতি এমনই যে, পুলিশ ও কোস্টগার্ডের নিরাপত্তা রক্ষীরা সেখানে পা ফেলতে ভয় পাচ্ছে। ২০০৬ সালে একইভাবে দুই ধীবর সেন্টিনেলিজদের তিরে প্রাণ হারিয়েছিলেন। তাঁদের একজনের দেহ উদ্ধার করা যায়নি। সেই সময় কোস্টগার্ডের এক অফিসার হেলিকপ্টার নিয়ে গিয়ে কয়েকবার চেষ্টা চালিয়েছিলেন ওই দেহ উদ্ধার করার। তাঁর হেলিকপ্টারের দিকেও ঝাঁকে ঝাঁকে সেন্টিনেলিজদের বিষাক্ত তির ছুটে এসেছিল। সেন্টিনেলিজরা সভ্যতাকে এতটাই ঘৃণা করে যে, এরা কোনও উপহার গ্রহণ করতেও রাজি নয়। অনেকবার চেষ্টা হয়েছে তাদেরকে উপহার দেওয়ার। জারোয়াদের একসময় কোনও উপহার পৌঁছে দিলে তারা সেটা গ্রহণ করে প্রতিদান হিসাবে কিছু ফিরিয়ে দিত। আন্দামান দ্বীপে বহু পর্যটকেরই অভিজ্ঞতা রয়েছে জারোয়াদের নানা উপহার দেওয়ার।

[বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যু প্রতিভাবান ব্যাডমিন্টন তারকার]

ভারত সরকারের বরাবরই নীতি– আন্দামানের এই দুই জনজাতি, যারা সভ্যতার আলোয় আসতে নারাজ, তাদের আপন মনে থাকতে দেওয়া হোক। যদি তারা নিজেদের মতো ফলমূল, কাঁচা মাছ-মাংস খেয়ে সভ্য মানুষের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে বাঁচতে চায়, তাহলে সেভাবেই তারা বেঁচে থাকুক। কিন্তু সত্যি কি সেটা সম্ভব হচ্ছে? সেন্টিনেলিজদের সংখ্যা এখন ৪০ থেকে ৫০-এ নেমে এসেছে বলে জানা যাচ্ছে। যে কোনও একটা রোগের ঝাপটাতেই এই সংখ্যা শূন্যে চলে যেতে পারে। ভারত সরকার এইসব দ্বীপে যাওয়া এখনও নিষিদ্ধ রেখেছে। অ্যালেন চাওয়ের পরিণতি বোঝাল যে, এছাড়া সরকারের কাছে বিকল্পও কিছু নেই। কিন্তু এইভাবে কতদিন? জারোয়ারা সভ্য মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে হয়তো নিজেদের বিলুপ্তির পথ থেকে রক্ষা করতে পারবে। সেন্টিনেলিজদের ভবিতব্য নিশ্চিত করেই একেবারে বিলুপ্তির পথে চলে যাওয়া। সুনামির সময় মনে হয়েছিল এরা নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। পরে অবশ্য দেখা গেল, এরা সুনামির বিরুদ্ধে লড়াই করে নিজেদের রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছে। তবে সমুদ্রের মধ্যে সবুজ দ্বীপে আজ দূষণকে ঠেকানো সম্ভব নয়। পাখির কলরব থাকলেও, ঝরনার জল আগের মতোই বয়ে চললেও সবুজ দ্বীপেও পৌঁছে যাচ্ছে সভ্যতার দূষণ। যে ‘অ্যাসিড রেইন’ অন্যত্র হচ্ছে সেটা তো ওখানেও হচ্ছে। সেন্টিনেলিজদের আপনমনে থাকতে দিলে কি তারা সভ্যতার এই দূষণ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারবে? ভারত সরকার নয়ের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চালিয়েছিল। এখন নাকি সেই চেষ্টা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তাহলে ৬০ হাজার বছরের প্রাচীন এই জনজাতির অবলুপ্তি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখাই কি সভ্য মানুষের এখন একমাত্র কাজ?

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement