সরোজ দরবার: অবশেষে বৈধতা মিলল। দুর্ভাগ্য এই যে, যা প্রকৃতিতে সহজাত, তাকেও বৈধতার অনুমোদন আদায় নিতে করে হল লড়াই করে, যেভাবে দুর্ভাগা হয় সেই দেশ যেখানে বীরের প্রয়োজন হয়। তবু চলতি ব্যবস্থায় এটাই দস্তুর। তবে শেষমেশ যা সহজাত তাকেই প্রকৃতিবিরুদ্ধ বলে চালিয়ে দেওয়া এবং প্রান্তিকতার চোরাগলিতে ঢুকিয়ে দেওয়ার এই রাজনীতি কোথাও না কোথাও পরাস্ত। সুখের বিষয় এটাই। আর কিছুই নয়, কিছু অপমানে কুঁকড়ে যাওয়া মুখে আজ জ্যোৎস্না পড়বে অনাবিল। চাঁদের গায়ে চাঁদ আজ আর অপ্রকাশ্য নয়।
আসলে বেগমজান আর রব্বুর লেপের একপাশ যখন খানিকটা চকিতে উঠেই নিচে নেমে গেল, তখনই যেন ঈঙ্গিত দিয়ে গেল, এই মোটা লেপের আড়াল আর অন্ধকার চিরকালের নয়। কাম্যও নয়। ইসমত চুগতাই-এর সেই ‘লিহাফ’ গল্প নিয়ে তো বিস্তর বিতর্ক। প্রকাশকাল থেকেই তা সমালোচনা আর অভিযোগের কাঠগড়ায়। বিপরীত লিঙ্গভিত্তিক যৌনতার যে সীমানা অতিক্রমণের উদ্ভাস উঠে যাওয়া লেপের পরিসরটুকুতে ছিল, তাকেই বারবার প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে। যা বুঝিয়ে দেয় এ সমাজ কিছুতেই তা মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। বেগমজান-রব্বুর তাই লেপের আড়ালই দস্তুর, কিন্তু ওই আড়ালটুকু খানিকটা সরিয়ে দেওয়ার জন্য চুগতাইকে আদালতে হাজিরা দিতে হয়েছে। সেই আদালতই যেন এই দীর্ঘদিনের জঙ্গম লেপখানা টান মেরে ফেলে দিল দূরে। যা স্বস্তি দেবে ইন্দিরা আর রাণুকে। বেগমজান-রব্বুর মধ্যে যৌনতায় শ্রেণি অতিক্রমেরও জোরাল বক্তব্য ছিল। তাও তো সহজ নয়। শুধু যৌনতাকে আধার করেই দুই ছক ভাঙতে চেয়েছিলেন ইসমত। জগদীশ গুপ্তের রাণুকে অবশ্য শ্রেণিবৈষম্যের চৌকাঠ পেরোতে হয়নি। ভালবাসার মানুষ হিসেবে সে বেছে নিতে পেরেছিল তার শ্রেণিরই সঙ্গীকে। কিন্তু যে স্বাধিকারপ্রমত্ততায় ইন্দিরাকে সে রাতে পাশে নিয়ে শুতে চেয়েছিল, তা যেন কোনও অনুমোদনেরই অপেক্ষা করে না, তা চাওয়া স্রেফ নিয়মরক্ষার খাতিরে। এবং অবশেষে ইন্দিরা যখন বলে- ‘যেন স্বামী আর স্ত্রী, সে আর আমি’- সেই অকপট বয়ান চমকে দেয় বইকি। মনের মানুষকে নিজের করে না পাওয়া এবং যৌনতায় নিজের পছন্দকে স্বীকৃতি দেওয়ার নিরিখে এই দুই নারী সেদিন সত্যিই ‘অরূপের রাস’ নামিয়ে এনেছিল। সেখানে খেলা করে নিখাদ ভালবাসা।
বিপরীত লিজ্ঞের যৌনতায় এই ভালবাসাকে এক ও একমাত্র ফ্যাক্টর হিসেবে না ধরে সেখানে গুঁজে নেওয়া হয়েছে সৃষ্টির উপযোগিতাকেও। মেকলে সাহেবও সম্ভবত এর উপর ভিত্তি করেই সেই সমকামিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন। অবশ্য তাঁর উদ্দেশ্য ছিল আপন দেশকে সুরক্ষিত করা। উপনিবেশে এসে তথাকথিত ভিন্ন যৌনতার স্বাদ নিয়ে দেশের লোক যাতে মেতে না ওঠে, সে কারণেই আইনের রক্ষাকবচ ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল ঔপনিবেশিক ভারতের শরীররেও। যার উপর ভিত্তি করে আবার আমাদের সর্বোচ্চ আদালত দীর্ঘদিন সমকামিতকে ব্রাত্য করে রেখেছিল। জগদীশ গুপ্ত তাঁর গল্পে এই সৃষ্টি পর্বটি সমাধা করেও যৌনতার স্বাধীনতাকে জায়গা দিয়েছিলেন। রাণুর বাচ্চা হয়েছিল। কিন্তু বাচ্চার মা হওয়া মানেই তার নিজে যৌনতাবোধ বা প্রেফারেন্স সে বিসর্জন দিয়েছে, তা নয়। শুধু মেয়ের বিয়ে ঠিক হওয়ার সময়, রাণুর রূপে মুগ্ধ হয়ে বেয়াই যখন পণ নেওয়ার প্রস্তাব মুলতবি করেছিলেন, তখন চোখে জল এসেছিল রাণুর বাবার। কেন এসেছিল তা অবশ্য তিনি খোলসা করেননি। এই না-পারাটুকু, এই চোখের জলের মধ্যে যে প্রকৃতি-বিরুদ্ধতার ভয় ছিল, আজ থেকে তা হয়তো খানিকটা কাটল।
সৃষ্টি আর আনন্দকে যে সর্বদা এক সমীকরণের এপার ওপারে থাকতেই হবে তার কোনও মানে নেই। তবে সেটাকেই নিয়ম করে তোলা এক ধরনের আগ্রাসন। অর্থাৎ যেখানে সৃষ্টির আভাস নেই, সেখানে আনন্দের কোনও মূল্য নেই। শুধু সমকামিতা কেন, যে কোনও যৌনতা, যা শুধু আনন্দের নিমিত্তই, তাকে ব্রাত্য করে রাখাই এই আগ্রাসী ব্যবস্থার প্রচলিত ছক। রাধার যৌনতাও তাই স্বীকৃত নয়। এদিকে আমাদের অতীত বলছে এতদ সত্ত্বেও সমকামিতা যে ছিল না তা কিন্তু নয়। শাস্ত্রে-পুরাণে একাধিক ক্ষেত্রে তার উদাহরণ আছে। বিশেষজ্ঞ -পণ্ডিতরা তা সময়ে সময়ে তুলে এনে দেখিয়েওছেন। সে অগ্নি-সোমের সম্পর্ক হোক কিংবা কার্তিকের জন্মবৃত্তান্ত- সমকামিতার এরকম নিদর্শন ভূরি ভূরি আছে। কিন্তু আমরা কখনো নিজেদের মত প্রতিষ্ঠা করতে ‘এটা শাস্ত্রে আছে, মহাভারতে আছে’ বলে হইহই করি, সেই একই জায়গা থেকে অন্য উদাহরণ উঠে এলে আবার তা উপেক্ষাও করি। এই নীরবতা উপেক্ষা ও প্রক্ষিপ্তকরণের রাজনীতিও দীর্ঘদিন সমকামিদের অন্য যৌনতা বা প্রান্তিক যৌনতা বলে ঠেলে সরিয়ে রেখেছে। ভাবখানা এরকম- যাকগে, আছে যখন থাকগে। কিন্তু এই রায়ে আইনি অধিকার সুরক্ষার পাশপাশি অন্তত এটুকু নিশ্চিত করার দায়িত্ব সকলেরই যে, কোনও যৌনতাই আর প্রান্তিক নয়। প্রান্তিক বলে সহানুভূতি নয়, বরং মূলস্রোতের সমানুভূতিরই অনুশীলন প্রয়োজন এ মুহূর্তে।
একদিকে বহু অবদমনের ইতিহাস। অন্যদিকে মুক্তির আনন্দ। ঠিক একইভাবে একদিকে এই উপেক্ষার ইতিবৃত্ত, অন্যদিকে প্রসারিত বৃত্ত। এই সব স্থানাঙ্ক একযোগে মিলিয়ে ফেলা সহজ নয়। রামধনু তাই উঠেছে ঠিকই। কিন্তু মনে রাখতে হবে, তা যেন ক্ষণস্থায়ী না হয়ে যায়। মননের আকাশ রঙের সে লীলাপুলক ধারণে সক্ষম না হলে, ব্যর্থ হবে সবটাই। চুগতাই, জগদীশ গুপ্ত, কমলকুমার মজুমদাররা সেই মননের আকাশটিই তৈরি করে দিতে চেয়েছেন বহুদিন ধরে। জিতিয়ে দিয়েছেন তাঁদের চরিত্রদের, বুঝিয়ে দিয়েছেন আকাশের আসলে কোনও সীমা থাকে না। এখন এই প্রসারিত বৃত্তে সকলের মূলস্রোত হয়ে ওঠাতেই প্রকৃত রামধনু ফোটা। সে রং যেন আমাদেরই অবজ্ঞায় আবার মিলিয়ে না যায়।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.