রাজদীপ সারদেশাই: বিভেদের এই ঘনঘোর অসময়ে, যেখানে মতামতকে আকার দেয় মূলত হোয়াটসঅ্যাপে ফরওয়ার্ড হওয়া মেসেজ, সে-সময়ে ভারতের প্রতিবাদী কুস্তিগিররা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন, ভারতীয় জনগণের স্তুতিবাক্য কতটা ভঙ্গুর, পলকা! এই সেই জনরাশি, যারা কুস্তিগিরদের আন্তর্জাতিক মঞ্চে পদকজয়ের আনন্দে লাফিয়ে উঠেছিল, তাঁদের জীবনীমূলক সিনেমা নিয়ে হইহই করেছিল, তাঁদের কাছাকাছি পেয়ে ছবি তুলতে এগিয়ে এসেছিল– এবং এখন সেই জনগণই কুস্তিগিরদের নজিরবিহীন প্রতিবাদী অবস্থান থেকে নিপুণ দূরত্ব তৈরি করে ফেলেছে।
এই তো কিছুদিন আগেও কুস্তিগিরদের (Wrestling) দেশমাতৃকার ‘বীরসন্তান’ বলে আখ্যা দেওয়ার হিড়িক উঠেছিল, আর সেই তাঁরাই এখন রাজনৈতিক তরজার উপকরণ হিসাবে আখ্যায়িত হচ্ছেন! গঙ্গায় পদক ভাসিয়ে দেওয়ার হুমকিকে ‘নাটক’ বলে দাগানো হচ্ছে, এমনকী, কেন্দ্রীয় সরকারের অন্ধ-সমর্থকরা তাঁদের ‘দেশদ্রোহী’ তকমা দিতেও ছাড়ছে না। ক্ষমতার বলয়ে থাকা পুরুষ-কৃত যৌন হেনস্তা বিষয়ে জনগণকে সচেতন করার জন্য তাঁদের প্রশংসা করা তো দূর, উল্টে তাঁদের কাছে এহেন অভিযোগের ‘প্রমাণ’ চাওয়া হচ্ছে আগে। আর এভাবে হঠাৎই, নির্যাতিতরাই হয়ে উঠেছেন অভিযুক্ত, আর আসল অভিযুক্ত গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়াচ্ছেন নির্বিঘ্নে।
যে কোনও প্রতিবাদ যখন পথে নেমে আসে এবং তা যদি দীর্ঘায়িত হতে থাকে, অবধারিত যে, সংশ্লিষ্ট রূঢ় রাজনীতির সঙ্গে তা জড়িয়ে পড়বেই। এক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। দিল্লি পুলিশ যে আন্দোলনকারীদের নতুন সংসদ ভবন অবধি মিছিল করতে দেবে না, এ তো জানা কথাই। আশ্চর্যজনকভাবে, এই সেই পুলিশ– সুপ্রিম কোর্ট তাদেরকে কুস্তিগিরদের অভিযোগের ভিত্তিতে এফআইআর রিপোর্ট দায়ের করতে জোর করার আগে অবধি, মাসের পর মাস ইনিয়েবিনিয়ে অপলাপ করে চলেছিল। এবং তা এফআইআর না নেওয়ার উদ্দেশ্যেই। আর পুলিশই কিনা অমানবিকভাবে কুস্তিগিরদের টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে গেল ভ্যানে যেন তাঁরা দাঙ্গাবাজি করছিলেন! এই আন্দোলন থেকে যেসব রাজনৈতিক তরজা উঠে আসছে, তা দিয়ে যেন কোনওভাবেই ঢাকা না পড়ে যায় এই আন্দোলনের মূল সুর ও বক্তব্য, যা গত কয়েক মাসে ঘনিয়ে উঠেছে। উদাহরণস্বরূপ, অলিম্পিকে পদক জয়ী অভিনব বিন্দ্রার বক্তব্যই
ধরা যাক– প্রত্যেক অ্যাথলিটের জন্যই এমন পরিসর দরকার, যা তাকে সুরক্ষিত রাখবে ও ক্ষমতায়িত করবে।
জানুয়ারিতে যখন আন্দোলন শুরু হল যন্তর মন্তরে, মনে পড়ে, সেখানে পৌঁছেছিলাম। এমন এক খেলার পরিবেশ এই দেশে, যেখানে অ্যাথলিটের পরিচয় এলিট ক্রিকেটার না হলে মন্তব্য বা বক্তব্য বা কথার কোনও গুরুত্ব থাকে না, সেখানে অলিম্পিয়ান কুস্তিগিররা যে সাহসিকতার পরিচয় দিলেন, তা অবিশ্বাস্য! কাঁদতে কাঁদতে চোখ লাল হয়ে গিয়েছিল ভিনেশ ফোগতের। তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘যৌন হেনস্তার বিরুদ্ধে সরব হতে এতটা সময় লাগল কেন আপনাদের?’ মনে রাখবেন পাঠক, এই ভিনেশ, একজন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন, যিনি এই প্রতিবাদের মুখ, তাঁর শান্ত উত্তর ছিল এই– ‘আপনি জানেন এমন বিষয়ে সরব হতে গেলে কতটা সময় লাগে? যদি একদম প্রথমেই আমি এই যৌন হেনস্তার অভিযোগ আনতাম বা জানাতাম, তাহলে সবার আগে আমাদের বাবা-মায়েরা আমাদের ট্রেনিং বন্ধ করে দিত, আর তারপর বিয়ে দিয়ে দিত কোথাও। সতি্যটা হল, আমাদের কেরিয়ার শেষ হয়ে যাবে, এই ভয়ে আমরা চুপ ছিলাম।’
আর এই কারণেই, কুস্তিগিরদের প্রশংসা করা প্রয়োজন, হেয় করা নয়। সাক্ষী মালিক এবং ফোগতরা অলিম্পিকে পদক পাওয়া কুস্তিগির। এঁরা কেবলই অ্যাথলিট নন, একইসঙ্গে এই খেলার লাইনে তাঁদের ভূমিকা বাঁক-বদল ঘটানো। তাঁদের মহিমা কেবলই তাঁদের আখড়ার পরিধিতে আটকে থাকেনি। এঁরা সেই পথিকৃৎ নারী, যাঁরা একটা
ক্রীড়া পরিসরকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করেছেন, যা কিনা এতকাল পুরুষশাসিত বা পুরুষপ্রধান ছিল। আন্তর্জাতিক কুস্তির রিংয়ে একজন মহিলা, বিশেষত ভারতীয় মহিলা গিয়ে দাঁড়াচ্ছেন, এটা কেবলই এতকালের গড়পড়তাকে দুমড়েমুচড়ে দিচ্ছে না, একইসঙ্গে শতকপ্রাচীন সংস্কার এবং লিঙ্গবৈষম্যের শিকড়ে গিয়ে আঘাত করেছিল।
প্রান্তিক হরিয়ানার মতো জায়গা থেকে এই মেয়েরা উঠে আসছেন, তাঁদের জীবন-সংগ্রাম যে কী ভয়ংকর ও অপূর্ব, তা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। যুগান্তকারী সংগ্রাম বলতেই হয়। তাঁদের জীবনবৃত্তান্ত নিতান্ত ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’ স্লোগানের থেকে অনেক অনেক বেশি জোর রাখে, এবং অনেক বেশি অর্জন করার ক্ষমতাও।
এই মল্লবীররা দেশের গর্ব এবং লৈঙ্গিক ক্ষমতায়নের প্রতীক হয়ে উঠলেও যে-পরিবর্তন তাঁরা আনতে পারলেন না, তা হল: খেলার প্রশাসনটা যারা চালায় এবং যারা খেলে, তাদের মধ্যেকার ক্ষমতার অসমঞ্জস ভারসাম্য। যে মানুষটির গ্রেফতার দাবিতে এই আন্দোলন তাঁদের, তিনি ব্রিজভূষণ শরণ সিং। ছ’বার সাংসদ হওয়া এক রাজনৈতিক ‘বাহুবলী’। যাঁর কাছে ‘ভারতীয় কুস্তিগির সংস্থা’ ব্যক্তিগত দখলদারির জায়গা, তাঁর অভাব এমন– তিনি যেন ভারতীয় কুস্তিগিরদের ভগবান, সর্বেসর্বা। হতেই পারে, এই অ্যাথলিটরা পদক জিতেছেন, দেশকে গর্বিত করেছেন, কিন্তু এই সাংসদ ভারতীয় ক্রীড়া প্রাঙ্গণে রীতিমতো দাপুটে চরিত্র হয়ে থেকেছেন।
আরও বড় কথা, ব্রিজভূষণ কেবলই বিজেপি সাংসদ নন। একই সঙ্গে উত্তরপ্রদেশের কেন্দ্রীয় অঞ্চলে তিনি যথেষ্ট প্রভাববিস্তারী রাজনৈতিক মুখ, গত দু’-দশকেরও বেশি সময় ধরে। উত্তরপ্রদেশের রাজনীতিতে রীতিমতো কঠিন সময় যাওয়ার কালে, যখন বেশিরভাগ নেতাই জটিল মণ্ডল-মন্দির তরজায় হিমশিম খাচ্ছিলেন, পরিস্থিতির কী দিশা দেবেন বুঝতে পারছিলেন না, সেই অবস্থাতেও ব্রিজভূষণ তাঁর রাজনৈতিক-বাণিজ্যিক রাজত্ব বাড়িয়ে গিয়েছিলেন অর্থবল এবং পেশিবহুল রাজনীতির জোর খাটিয়ে। তাঁর কেরিয়ারে রয়েছে আরও কিছু অন্ধকার। ‘টাডা’-র কাছে
তিনি গ্রেফতার হয়েছিলেন আন্ডারওয়ার্ল্ড ডন দাউদ ইব্রাহিমের কিছু জরুরি জিনিসপত্র আশ্রয় দেওয়ার জন্য। এমনকী, ক্যামেরার সামনে স্বীকারও করেছেন, তাঁর রাজনৈতিক বিরোধী পক্ষের একজনকে খুন করেছিলেন। এসবের পরেও, তাঁর অজেয় ক্ষমতার খাতিরে মোদি সরকারের কেউ কখনওই তাঁকে কেউ কখনও ঘাঁটানোর বা তাঁর নামে আওয়াজ তোলার সাহসটুকুও পায়নি।
আর ঠিক সেই কারণেই, ভারতীয় ক্রীড়ার ইতিহাসে মল্লবীরদের এই আন্দোলন এক যুগান্তকারী ঘটনা। বহু বহু কাল ধরে, আমাদের অ্যাথলিটরা এই ক্ষমতাবান আধিকারিকদের বিরুদ্ধে কিছু বলার সাহস জোগাতে পারেননি। প্রথমত, মেয়ে বলে তাঁদের মুখে কুলুপ এঁটে দেওয়া হত। আধিকারিকরা যেখানে পাঁচতারা অভিজাত হোটেলে গিয়ে থাকতেন, সেখানে অ্যাথলিটরা গুমটি ঘরে একসঙ্গে ছোটখাটো হোটেলে থাকতে বাধ্য হতেন, কারণ সেই আয়োজনই তাঁদের করে দেওয়া হত। যেমন, ১৯৭৮-এ, ব্যাংককে অনুষ্ঠিত হওয়া এশিয়ান গেমসের সময়, বহু খেলোয়াড়ই সেখানকার নিকটবর্তী এক গুরুদ্বারের খাবার খেয়ে দিন কাটিয়েছিলেন। তাঁদের জন্য আলাদা করে খাবারের আয়োজন করেনি কর্তৃপক্ষ। আরেক ইভেন্টে, এক ক্রীড়া অধিকর্তা, গোটা টিমের ট্র্যাকসুটের জন্য দিল্লির আজাদ মার্কেট থেকে পুরনো রদ্দি কম্বল নিয়ে
এসেছিলেন ইভেন্টে রওনা দেওয়ার আগে শেষ মুহূর্তে!
অলিম্পিক-সংক্রান্ত খেলাগুলোর পরিসরে বিপুল বদল আসতে শুরু করল ২০১০ কমনওয়েলথ গেমসের পর থেকে, যেবারে ভারত বেশ অনেকগুলো পদক জিতল। নিয়মনিষ্ঠ, সুপ্রশিক্ষণ-সংবলিত পদক্ষেপ, যেমন সম্প্রতি ক্রীড়ামন্ত্রকের সাম্প্রতিক ‘অলিম্পিক পোডিয়াম স্কিম’ প্রকল্পের মতো আয়োজনের ফলে অনেক অনেক সুযোগ-সুবিধার দরজা খুলে গিয়েছে। শুধু কুস্তিতেই নয়, ব্যাডমিন্টন, ভারোত্তোলন, বক্সিং বিভিন্ন ক্রীড়া ক্ষেত্রে মেয়েরা বিশেষ করে ঝলসে উঠছেন রীতিমতো। এমনকী, বিশ্ব-চ্যাম্পিয়নও হচ্ছেন। যার ফলে, খেলা এবং লিঙ্গ– এই দুই পরিসরেই তথাকথিত ভাবভঙ্গিমা বদলে গিয়েছে। একই সঙ্গে মহিলা ক্রিকেটেও যে বিপুল সাফল্য দেখা দিয়েছে, সেটাও কিছু কম প্রণোদনা দেয়নি এই পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে।
কিন্তু, এই সম্মান বা জয় কেবল খেলার ময়দানে পেয়ে কী হবে? সতত জীবনের কুরুক্ষেত্রেও তো প্রয়োজন। মোদ্দা কথা, এই সম্মানের লড়াই-ই বর্তমানে কুস্তিগিরদের আন্দোলনের হেতু।
যে-সাংসদের বিরুদ্ধে এই ভয়ংকর অভিযোগগুলি উঠেছে, তাঁকে প্রশ্ন অবধি করা যাচ্ছে না কেন? কেন এখনও অবধি ‘পকসো’ আইন বলবৎ করা হচ্ছে না? কেন কুস্তিগিরদের সঙ্গে সংলাপে আসতে ক্রীড়ামন্ত্রীর এত নিস্পৃহ ভাব? কেন এত সংখ্যক নারী ও শিশু উন্নয়ন মন্ত্রীর মুখে কোনও টুঁ শব্দ নেই? কেন এমনকী, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী অবধি কিছু বলছেন না? গণতন্ত্রের দেশে প্রতিবাদ করা মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়ে। প্রতিবাদের ধরন-ধারণ নিয়ে অনেকেই ভিন্নমত পোষণ করতে পারেন, কিন্তু এই আন্দোলন সম্মিলিত সহবেদনার যথেষ্ট দাবি রাখে। অলিম্পিয়ানরা যেখানে সন্ত্রাস চালানোর অভিযোগে অভিযুক্ত হচ্ছেন, ঠিক একই সময়ে সেই অভিযুক্ত সাংসদ ভিআইপি অতিথি হিসাবে পৌঁছচ্ছেন নতুন সংসদ ভবনের উদ্বোধনে। এসব দেখে বিস্ময় জাগে– সতি্যই কি ন্যায় প্রতিষ্ঠা পাবে কোনও দিন?
পুনশ্চ এই আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কয়েকজন অলিম্পিক তারকা, যেমন পদক জয়ী নীরজ চোপড়া এবং অভিনব বিন্দ্রা কুস্তিগিরদের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। কিন্তু, অনিল কুম্বলে ছাড়া একজন ক্রিকেটারের তরফেও কোনও মন্তব্য বা বক্তব্য দেখতে পাওয়া গেল না। তাঁদের বলছি– সময় হয়েছে, এবার আপনারাও স্ট্রেট ব্যাটে আপনাদের মন্তব্যগুলি বাউন্ডারির বাইরে পাঠান তো দেখি!
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.