শিশুদের দিকে তাকালে আতঙ্ক হয়, তাদের শিক্ষার আপাদমস্তক অবকাশহীন যান্ত্রিকতার শিকল দিয়ে বাঁধা, তিন-চতুর্থাংশ শিক্ষকের মনে এখনও তিলমাত্র ভালোবাসা নেই, বিবেক জিনিসটি কবে অন্তর্হিত হয়েছে, কারও মনে পড়ে না। তাও ‘ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’ হিসাবে শান্তিনিকেতনের স্বীকৃতি আমাদের আশ্বস্ত করে। লিখলেন চিন্ময় গুহ।
শিখার দ্বারাই শিখা জ্বলিয়া ওঠে। -রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
‘ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’ হিসাবে শান্তিনিকেতনের স্বীকৃতি আমাদের নুয়ে পড়া সমাজ জীবনে কিছুটা নতুন আশ্বাস জোগাল। তাহলে এই কলঙ্কশীলিত দিনগুলিতে পৃথিবী এখনও সুন্দরের মূল্য বোঝে? সব শূন্য তবে শূন্য নয়! ঐতিহাসিক গৃহগুলি (‘শান্তিনিকেতন’ গৃহ, উদয়ন, মন্দির, বিভিন্ন ভবনগুলি), দৃশ্যপট ও প্রান্তর এবং শিল্পের নানা আঙ্গিক (যথা নৃত্য, সঙ্গীত, ভাস্কর্য, ছবি) তথা এই প্রবহমান শিক্ষাগত ও শৈল্পিক ঐতিহ্যের আন্তর্জাতিক মূল্যকে এই সম্মান প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু এগুলি নয়, এগুলির তাৎপর্য হল আসল। সেই তাৎপর্য হল রবীন্দ্রনাথের ভাবনায় শিক্ষার মুক্তি, চেতনার বিকাশ, আনন্দের রসায়ন– যা শান্তিনিকেতনের বাড়ি, ভবনগুলি ও আকাশে-বাতাসে ছড়িয়ে আছে। বিশ্বভারতী এই সমন্বয়-ভাবনার মূর্ত রূপ। তাঁর ভাষায়, ‘সমগ্রের সামঞ্জস্য’।
মনে হয় না, রবীন্দ্রনাথ ছাড়া বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে আর কোনও কবি বিশ্বের সঙ্গে সংযোগের এই দর্শনকে রূপায়িত করার অঙ্গীকার নিতেন। ক’জন বুঝেছি যে, তাঁর কবিতার মতোই সৃজনকর্মের মধ্যে সেরা কোহিনূর হল বিশ্বভারতী? অথচ সেটির ন্যূনতম মূল্য বুঝলাম না আমরা, সম্ভবত বোঝেননি জওহরলাল নেহরুর পর একজন আচার্যও। হয়তো বিশ্ব ঐতিহ্যের চিহ্ন হিসাবে এই ঘোষণা আমাদের অন্ধ আয়না থেকে এক লহমার জন্য মুক্তি দেবে, শিক্ষার পঙ্কশয়ন থেকে মুখ তুলে তাকাতে সাহায্য করবে। বর্তমানে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার শতবর্ষ পরে রবীন্দ্রভাবনার এই স্বীকৃতিকে কীভাবে দেখব আমরা, স্বপ্নের সৌধ হিসাবে, না ধ্বংসাবশেষ?
নিজের তিক্ত অভিজ্ঞতার পর ছেলেমেয়েদের শিক্ষার শুরুতে ‘শিক্ষার হেরফের’ (১৮৯৩) নামে যুগান্তকারী প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন জীবনের সঙ্গে শিক্ষার অসংলগ্নতার কথা: ‘জীবনের এক-তৃতীয়াংশ কাল যে শিক্ষায় যাপন করিলাম, তাহা যদি আমাদের জীবনের সহিত অসংলগ্ন হইয়া রহিল এবং অন্য শিক্ষালাভের অবসর হইতেও বঞ্চিত হইলাম, তবে আমরা কিসের জোরে একটা যাথার্থ্য লাভ করিতে পারিব?’
‘আমাদের দেহ সাড়ে তিন হাতের মধ্যে বদ্ধ, কিন্তু তাই বলিয়া ঠিক সেই সাড়ে তিন হাত পরিমাণ গৃহ নির্মাণ করিলে চলে না। স্বাধীন চলাফেরার জন্য অনেকখানি স্থান রাখা আবশ্যক, নতুবা আমাদের স্বাস্থ্য ও আনন্দের ব্যাঘাত হয়।’
‘এখন বিধাতার নিকট এই বর চাহি, আমার ক্ষুধার সহিত অন্ন, শীতের সহিত বস্ত্র, ভাবের সহিত ভাষা, শিক্ষার সহিত জীবন কেবল একত্র করিয়া দাও। আমরা আছি যেন–
পানীমে মীন পিয়াসী
শুনত শুনত লাগে হাসি।
আমাদের পানিও আছে পিয়াসও আছে দেখিয়া পৃথিবীর লোক হাসিতেছে এবং আমাদের চক্ষে অশ্রু আসিতেছে, কেবল পান করিতে পারিতেছি না।’ (‘শিক্ষার হেরফের’, ‘সাধনা’, পৌষ ১২৯৯)
১৯০৮ সালেই শান্তিনিকেতন বক্তৃতামালার শুরুতে ছিল জাগরণের মন্ত্র: ‘উত্তিষ্ঠত, জাগ্রত’। সকালবেলায় সমস্ত রাত্রির গভীর নিদ্রা ভেঙে যাওয়ার কথা, ‘প্রকাণ্ড জড়তার কুণ্ডলীর পাক’ থেকে, ‘কুহকের আবেষ্টন’ থেকে মুক্তির আহ্বান। ‘চেতনার দ্বারা চেতনাকে’ পাওয়ার মন্ত্র, যা দিয়ে মনের বিকাশকে উদ্বোধিত করতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ: ‘সমগ্রের সঙ্গে প্রত্যেকের যোগ যত রকম করিয়া যত দূর ব্যাপ্ত হইতে থাকে ততটাই প্রত্যেকের বিকাশ।’
বারুচ স্পিনোজার মতো তিনি মেলাতে চেয়েছিলেন। আমরা তো প্রাণের ভেতর প্রাণকে খুঁজছি। খুঁজছি অন্তর্নিহিত জীবন।
‘আমরা নৃতত্ত্ব অর্থাৎ ethnology-র বই যে পড়ি না তাহা নহে। কিন্তু… পুঁথি সম্বন্ধে আমাদের কত বড়ো একটা কুসংস্কার জন্মিয়া গেছে, পুঁথিকে আমরা কত বড়ো মনে করি এবং পুঁথি যাহার প্রতিবিম্ব তাহাকে কতই তুচ্ছ বলিয়া জানি। কিন্তু জ্ঞানের সেই আদিনিকেতনে একবার যদি জড়ত্ব ত্যাগ করিয়া প্রবেশ করি তাহা হইলে আমাদের ঔৎসুক্যের সীমা থাকিবে না।’
(‘ছাত্রদের প্রতি সম্ভাষণ’, ‘বঙ্গদর্শন’, ১৩১২)
এর কিছু পরেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর মূল চিন্তাকে আবার প্রকাশ করলেন–
‘জলের দ্বারাই জলাশয় পূর্ণ হয়, শিখার দ্বারাই শিখা জ্বলিয়া ওঠে, প্রাণের দ্বারাই প্রাণ সঞ্চারিত হইয়া থাকে। মানুষকে ছাঁটিয়া ফেলিলেই সে তখন আর মানুষ থাকে না, সে তখন আপিস-আদালতের বা কল-কারখানার প্রয়োজনীয় সামগ্রী হইয়া উঠে; তখনি সে মানুষ না হইয়া মাস্টার-মশায় হইতে চায়; তখনি সে প্রাণ দিতে পারে না, কেবল পাঠ দিয়া যায়।’
(‘শিক্ষাবিধি’, ‘প্রবাসী’, ১৩১৯)
‘শিক্ষাব্যবস্থায় আমরা সেই গুরুকে খুঁজিতেছি যিনি আমাদের চিত্তের গতিপথকে বাধামুক্ত করিবেন।’ শিক্ষা কমিশন আর নতুন শিক্ষাবিধির প্রবক্তাদের বলি, রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘প্রণালীর বটিকা’ দিয়ে কিছু হবে না। (ঐ) তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন, ‘বর্তমান শিক্ষাপ্রণালীই যে আমাদের ব্যর্থতার কারণ, অভ্যাসগত অন্ধ মমতার মোহে সেটা আমরা কিছুতেই মনে ভাবিতে পারি না। ঘুরিয়া ফিরিয়া নূতন বিশ্ববিদ্যালয় গড়িবার বেলাতেও প্রণালী বদল করিবার কথা মনেই আসে না; তাই নূতনের ঢালাই করিতেছি সেই পুরাতনের ছঁাচে।’ (‘অসন্তোষের কারণ’, ‘শান্তিনিকেতন’, জ্যেষ্ঠ ১৩২৬)
এর উত্তর হল শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী। অর্থ বুঝেছেন কেউ? বুঝতে চেয়েছেন কখনও? শুধু ‘সাধু, সাধু’ বললে তো হবে না। আমরা জানলামই না রবি-বাউল এসেছিলেন মশাল নিয়ে আমাদের এই ভাঙা ঘরে! অশিক্ষা, ইতরামি, পরশ্রীকাতরতা, রাজনীতির পাঁক, বাগাড়ম্বর আর শূন্যগর্ভ আস্ফালনের এই জয়যাত্রায় অনন্তের রসায়ন– ‘chemistry of the sublime’– কোন গহ্বরডিহায় গিয়েছে হারিয়ে?
শিশুদের দিকে তাকালে আতঙ্ক হয়, তাদের শিক্ষার আপাদমস্তক অবকাশহীন যান্ত্রিকতার শিকল দিয়ে বাঁধা, তিন-চতুর্থাংশ শিক্ষকের মনে এখনও তিলমাত্র ভালবাসা নেই, বিবেক জিনিসটি কবে অন্তর্হিত হয়েছে কারও মনে পড়ে না। শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের পৃথিবী তোলপাড় করা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরেও আমরা একই তিমিরে মুহ্যমান। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়– ‘স্তূপ উঁচা করিতেছি, নির্মাণ করিতেছি না।’ আজও ভাবছি দৈবাৎ এক ভৈরবী রাগিণী এসে আমাদের এই কালনিদ্রা থেকে জাগিয়ে তুলবে। দিন কেটে যায়, অপেক্ষায় অপেক্ষায়।
১৯২৩ সালের ২ জুন, যখন বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার পর বছর ঘোরেনি, যদুনাথ সরকার সেই নতুন প্রতিষ্ঠানে ‘exact knowledge’-এর অভাবের অভিযোগ তোলেন: ‘এই বিদ্যালয় কেবল যে নিষ্ফল তাহা নহে, ইহার ফল বিষময়।’ এর উত্তরে রবীন্দ্রনাথ আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণের মতো লেখেন–
‘একথা আপনার জানা আছে যে, যথোচিত পদ্ধতিতে আমি নিজে শিক্ষালাভ করি নাই। মনে করিতে পারেন সেই অশিক্ষাবশতই জ্ঞানাণ্বেষণের বিহিত প্রণালীকে আমি অবজ্ঞা করি।’
(চিঠিপত্র ১৫)
এখনও বিশ্ববিদ্যালয়ের করিডর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ভাবি, আমি কি যোগ্য হতে পারলাম? পারিনি। কেমব্রিজে গবেষণা করতে গিয়ে, ক্রিস্টোফার মার্লো পঠিত চোদ্দো শতকে নির্মিত করপাস ক্রিস্টি কলেজে দেখেছি, শ্রেণিকক্ষের নিচু দরজা। প্রবেশ করার আগে মাথা নিচু করো। ক্লাসে ঢোকার আগে প্রতিদিন নিজেকে বলি, ‘যোগ্য হও, ছাত্রছাত্রীদের যোগ্য হও।’ নিজেকে প্রস্তুত করো, আলো জ্বালাতে হবে যে। ‘Night is the darkest before dawn and the coming of dawn is inevitable…’ ‘It was the hour before the Gods awake.’ (Savitri)
নানা কারণে, বিশেষ করে চটজলদি সাফল্যের লোভ ও আত্মশ্লাঘার কারণে, আমাদের শিক্ষাসমাজের অধিকাংশের সংকীর্ণতা আজ এক দুশ্চিকিস্য কর্কট রোগে আক্রান্ত। ভেন্টিলেশনে আছি, তবু বুঝতে পারছি না যে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবনার জগৎ শেষ হয়ে আসছে। সৃজনের বিস্ময়কর রহস্যলীলাকে উদ্বোধিত করার মন আমরা হারিয়ে ফেলছি।
এই অভাগা দেশকে ফেলে বিদেশে চলে যাওয়া যে সবসময় বিরাট কৃতিত্বের তা নয়, কখনও কখনও অকৃতিত্ব ও লজ্জারও। জানি, এই দেশ এখন মুক্তচিন্তার বধ্যভূমি, তবু লড়াই ছাড়লে তো চলবে না। প্রতিরোধ শুরু করতে হবে আপন জমিতে দাঁড়িয়ে।
প্রায়ই দেখেছি, শিক্ষক কক্ষে ও বিভাগীয় মিটিংয়ে ছাত্রছাত্রীদের প্রতি অযোগ্যতম অধ্যাপকের অশ্রদ্ধা প্রকাশ প্রায় নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। সম্ভব হলে শূন্য দিতে প্রস্তুত। তাঁদের গান ‘তাসের দেশ’-এর: ‘চলো নিয়ম-মতে।/ দূরে তাকিয়ো নাকো, ঘাড় বাঁকিয়ো নাকো!/চলো সমান পথে।’ ব্যতিক্রম যে নেই, তা নয়, কিন্তু ব্যতিক্রম শুধু নিয়মকেই প্রতিফলিত করে। তার উপর আছে ছোট ছোট ক্ষমতার বৃত্ত (রম্যাঁ রলাঁকে লেখা কালিদাস নাগের লেখা চিঠি পড়ে জেনেছি, শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্রনাথের সময়ই এগুলি সক্রিয় ছিল), যা ছাত্রদের বিভ্রান্ত করে। অধিকাংশ অধ্যাপককে কখনও বলতে শুনিনি যে, তঁারা যথেষ্ট ভাল করে পড়াতে পারেননি, যা আমি অহরহ মনে করে লজ্জা পেয়েছি! খাতা দেখায় অনেক ক্ষেত্রে যে বিদ্বেষ, অবহেলা, উদাসীনতা ও সচেতন অবিচার দেখেছি, তা বারবার বলা সত্ত্বেও পরিবর্তিত হয়নি। কখনও সহকর্মী-সহকর্মিণীকে বলেছি, নিজের সন্তানদের কথা ভাবুন। ভাবেননি। কাজেই শিক্ষাব্যবস্থার অবক্ষয়ের মূলে শুধুই রাজনৈতিক দলগুলির মোড়লি নয়, আমাদের শিক্ষককুলের অবদানও কিছু কম নয়। শুধু বড়-বড় কথা বলে, ফুকো-দেরিদা আউড়ে চিঁড়ে ভিজবে না।
অনেক ক্ষেত্রেই তঁারা ছাত্রছাত্রীদের সেই জমিটুকু দিতে রাজি নন, যা তাদের বনস্পতিতে পরিণত করতে পারবে। দেখেছি, সর্বোত্তম ছাত্রকেও অতীতের এক বিভাগীয় প্রধান শংসাপত্র দিতে রাজি হননি। আমরা তো বিদ্যালয়ের বিভাগে-বিভাগে নিয়মাবলি মুখস্থ করা কেরানি চাইনি, এমনকী পাঠ্যক্রম-শেষ-করা শিক্ষক চাইনি, ‘শিক্ষাগুরু’ চেয়েছি। তাই ‘ইউজিসি’ যা নির্মমভাবে করতে চেয়েছে, সেই শিক্ষক-কেরানির পরিবর্তে, দৈবাৎ প্রদীপ হাতে শিক্ষাগুরু পেয়ে গেলে ছাত্রছাত্রীরা হাতে স্বর্গ পায়। আমাদের সৌভাগ্য, এই নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে এমন কয়েকটি জোনাকি মাঝে মাঝে জ্বলে। কিন্তু তাতে কি কনকপ্রভা গাছকে বঁাচানো যায়? শিক্ষণের ‘সুদূরপ্রসারিত মরুময়তা’ দুঃখী ছাত্রছাত্রীকে ঠেলে দিয়েছে লেখাপড়ার কালোবাজারের দিকে। ঋত্বিক ঘটকের নীতার মতো তারা বলতে চেয়েছে, ‘দাদা, আমি বঁাচতে চাই!’ কিন্তু শুনবে কে? যে বেঁচেছে, সে একা বেঁচেছে।
শান্তিনিকেতন আর-একটি তপোবন বানাতে চেয়েছিল। ‘চুনসুড়কির জয়যাত্রা’-কে রুখতে, দিতে চেয়েছিল আরণ্যকের সাধনার বার্তা। এখন সেটিও রসিকতা মাত্র। করোনা যখন পৃথিবীর টুঁটি টিপে ধরেছিল, তখন রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাদর্শনের আধুনিকতা স্পষ্ট হয়েছে, কিন্তু চুনসুড়কির জয় আমরা অক্ষুণ্ণ রেখেছি। এখন তাতে যুক্ত হয়েছে কম্পিউটারের আস্ফালন, যা গবেষণাকে নিয়ন্ত্রিত করতে চাইছে।
‘বিদ্যা মিলাইব কিসের সঙ্গে, বিচার করিব কী দিয়া?’ গত ৭৫ বছরে নেতা থেকে তরুণ অধ্যাপক, কেউই একবারও ভাবিনি আমাদের লক্ষ্য কী। বীজ থেকে অঙ্কুরকে, অঙ্কুর থেকে বৃক্ষকে মুক্তিদান করা গেল কি না, সেই অমোঘ জিজ্ঞাসা থেকে আমরা শিক্ষকেরা যত দূরে সম্ভব পালিয়ে বেঁচেছি। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘সংশয়কে আবৃত করে’, ‘নিজের অজ্ঞতা সম্বন্ধে অজ্ঞানতার মতো অজ্ঞান আর তো কিছু নেই।’ আমি দেখেছি, যিনি ইংরেজি বিভাগে ভাষাবিদ্যা পড়ান, তঁাকে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের ভাষাভাবনা নিয়ে বলতে হলে পলায়ন করতে হবে। কেউ পারিবারিক দুঃখের শোধ তুলেছেন ছাত্রদের উপর।
শিক্ষানীতিকে পাশ্চাত্যের ছঁাচে ঢালতে গিয়ে আমরা নিজেদের পায়ে বারংবার কুড়ুল মেরেছি। ফলে স্তূপ উঁচু হয়েছে, নির্মাণ হয়নি। ইংরেজির পণ্ডিত অধ্যাপককে দেখেছি উইলফ্রেড আওয়েনের কবিতা পড়েছেন, কিন্তু আওয়েনের মৃত্যুর পর রবীন্দ্রনাথকে লেখা তঁার মা-র চিঠির খবর রাখেন না!
আন্তোনিও গ্রামশি ‘জেলখানার নোটবই’-তে ‘ইন্টেলেকচুয়াল’-দের সম্পর্কে লিখতে গিয়ে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, এঁরা যে আলাদা এক শ্রেণি, সেটি একটি মিথ। একদিক থেকে প্রতিটি মানুষই আসলে সম্ভাব্য ইন্টেলেকচুয়াল, কারণ তঁাদের চিন্তাশক্তি আছে, সেটিকে ব্যবহার করার সম্ভাবনা আছে; কিন্তু তঁারা বুদ্ধিজীবী নন, কারণ তঁাদের ‘সামাজিক’ ভূমিকা বুদ্ধিজীবীর নয়। ‘গতানুগতিক’ (traditional) বুদ্ধিজীবীর বাইরে আছেন ‘আঙ্গিক’ (organic) বুদ্ধিজীবী, যঁারা ভাবতে পারেন, প্ররোচিত করতে পারেন, ধাক্কা দিতে পারেন, সংযুক্ত করতে পারেন। শিক্ষককে ভুললে চলবে না যে, তিনিও আসলে বুদ্ধিজীবী, তিনি এটা পারেন।
সে-যুগে এর উদাহরণ ডিরোজিও, এ-যুগে এর উদাহরণ শঙ্খ ঘোষ।
শিক্ষক প্রায়ই ভুলে যান যে তিনি জীবনমুখী সত্তা। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হেনরি মরলি থেকে বিধুশেখর শাস্ত্রী, ক্ষিতিমোহন সেন বা অজিত কুমার চক্রবর্তী, শান্তিনিকেতনে শ্রেষ্ঠ মনীষীদের কথা মনে পড়বে। এই ঘনায়মান অন্ধকারেও জীবন ও শিক্ষাকে যিনি ‘মেলাতে’ পারেন অমিয় চক্রবর্তীর কবিতার মতো, বিশ্বাস জাগাতে পারেন, বারবার নিভে গেলেও জ্বালাতে পারেন আলো, পারেন আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে। এই স্খলমান পৃথিবীতে আজও শিক্ষাকে বঁাচানোর মূলধন একটি সেকেলে গুণ: শ্রদ্ধা। আমি নিজে অতি তুচ্ছ বলেই শ্রদ্ধা করেছি, ভালবাসা দিয়েছি, অর্জন করেছি তার একশো গুণ। এই আপাত ভালবাসাহীন সময়ে, ছাত্রছাত্রীরা উজাড় করে দিয়েছে, ফুলে ভরে দিয়েছে আমার ক্ষুদ্র ডালি। আজও সমাজের তরুণেরা একটু আগুনের জন্য অপেক্ষায়, তারপর তারা স্বাতী নক্ষত্র পর্যন্ত পৌঁছবে। ‘শৃণ্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রাঃ’। এ মিথ্যে হতে পারে না।
১৯৩৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন সভায় বিদ্যাসাগরের পর আমাদের শ্রেষ্ঠ শিক্ষাভাবুক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ভাষায় প্রদত্ত প্রথম সমাবর্তন
বক্তৃতায় বলেছিলেন–
‘আজ আমাদের অভিযান নিজের অন্তর্নিহিত আত্মশত্রুতার বিরুদ্ধে; প্রাণপণ আঘাত হানতে হবে বহুশতাব্দীনির্মিত মূঢ়তার দুর্গভিত্তি-মূলে। আগে নিজের শক্তিকে তামসিকতার জড়িমা থেকে উদ্ধার করে নিয়ে তারপরে পরের শক্তির সঙ্গে আমাদের সম্মানিত সন্ধি হতে পারবে। নইলে আমাদের সন্ধি হবে ঋণের জালে, ভিক্ষুকের জালে আষ্টেপৃষ্ঠে আড়ষ্টকর পাকে জড়িত। নিজের শ্রেষ্ঠতার দ্বারাই অন্যের শ্রেষ্ঠতাকে আমরা জাগাতে পারি, তাতেই মঙ্গল আমাদের ও অন্যের। দুর্বলের প্রার্থনা যে কুণ্ঠাগ্রস্ত দান সঞ্চয় করে সে দান শতছিদ্র ঘটের জল, যে আশ্রয় পায় চোরাবালিতে সে আশ্রয়ের ভিত্তি।–
…দূর করো চিত্তের দাসত্ববন্ধ,
ভাগ্যের নিয়ত অক্ষমতা,
দূর করো মূঢ়তায় অযোগ্যের পদে
মানবমর্যাদাবিসর্জন,
চূর্ণ করো যুগে যুগে স্তূপীকৃত লজ্জারাশি
নিষ্ঠুর আঘাতে।
নিঃসংকোচে
মস্তক তুলিতে দাও
অনন্ত আকাশে
উদাত্ত আলোকে,
মুক্তির বাতাসে।’
বিশ্বায়ন-উত্তর রিক্তবর্ষণ পৃথিবীর সংকীর্ণতা, রাজনীতির সংকট, দুর্নীতি, ভালবাসাহীন শিক্ষাপদ্ধতি, আর অশুভের উদ্বোধন শিক্ষায় আছড়ে পড়বে, বেরিয়ে আসবে সরীসৃপ। কিন্তু প্রকৃত শিক্ষক তো আয়নার সামনে একা। তামাটে আকাশে চুপ করে তাকিয়ে থাকা দু’-একটি তারার মতো। শান্তিনিকেতনে শিক্ষা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের দর্শন-মন্ত্র ছিল– মনের রুদ্ধদ্বার খুলে শিক্ষাকে সত্য এবং প্রাণের জিনিস করে তোলা। এখনও একজন তা পারেন: শিক্ষক। কিন্তু সংস্কারের কঠিন আস্তরণ ভেদ করে দুঃখের বেদনা তার মনে বাজবে কি?
(মতামত নিজস্ব)