দুলাল দে: তখন সবে চুক্তি হয়েছে, মোহনবাগান ইন্ডিয়া প্রাইভেট লিমিটেডের সঙ্গে ক্যালকাটা স্পোর্টস অ্যান্ড গেমস প্রাইভেট লিমিটেডের।
চারিদিকে জল্পনা, নতুন দলের নাম কী? মোহনবাগানের (Mohun Bagan) লোগো, জার্সির রং, সব অপরিবর্তিত থাকবে তো? ঠিক এই সময়েই একদিন কথা হচ্ছিল বাইচুং ভুটিয়ার সঙ্গে। যখন থেকে ইস্টবেঙ্গলে (East Bengal) খেলছেন, সেই সময় থেকে আরপিএসজির চেয়ারম্যান সঞ্জীব গোয়েঙ্কার (Sanjiv Goenka) সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বাইচুংয়ের। পরে এটিকে—তে উপদেষ্টাও ছিলেন। ফলে সঞ্জীব গোয়েঙ্কাকে অত্যন্ত কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতায় নির্ভর করে বাইচুংয়ের ব্যাখ্যা ছিল, “মোহনবাগানের মতো এরকম ঐতিহ্যপূর্ণ ক্লাবের কোটি কোটি সমর্থকের হৃদয়ের মালিক হওয়ার জন্যই সঞ্জীব গোয়েঙ্কা এই গাঁটছড়াটা বেঁধেছেন। যা—ই করুন, মোহনবাগানের নাম কিছুতেই বদলাবেন না। কারণ, ‘মোহনবাগান’, এই নামটাই হচ্ছে সঞ্জীব গোয়েঙ্কার আসল ইউএসপি। এখন থেকে মোহনবাগান দলটা তাঁর।”
কিন্তু ঘটনাচক্রে দেখা গেল, মোহনবাগানের নামের আগে ‘এটিকে’ শব্দটি বসে গিয়েছে। অনেকে বলবেন, দুটি ক্লাবের সংযুক্তিতে নাম হয়েছে এটিকে মোহনবাগান (ATK Mohun Bagan)। যুক্তিটা একদমই ঠিক না। ২০১৮—তে দুটি কোম্পানির চুক্তির সঙ্গে সঙ্গে আইএফএ—তে চিঠি দিয়ে বলে দেওয়া হয়, ‘এটিকে’ নামে যে ক্লাবটি ছিল, তা আর থাকছে না। ফলে এটিকে নামক ক্লাবটির তখনই অবলুপ্তি ঘটে। নতুন দলের নাম ঠিক করতে গিয়ে মোহনবাগান ইন্ডিয়া প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি দিল তাদের ‘মোহনবাগান’ ব্র্যান্ডকে। আর ক্যালকাটা স্পোর্টস অ্যান্ড গেমস প্রাইভেট লিমিটেড দিল তাদের ‘এটিকে’ ব্র্যান্ডকে। নতুন দলের নাম হল, ‘এটিকে মোহনবাগান’।
আইএফএতে এটিকে নামক ক্লাবের অবলুপ্তির সঙ্গে সঙ্গে এটিকে বলে কোনও ক্লাবই আর ভূভারতে রইল না। এটি শুধুমাত্র একটি ব্র্যান্ড। যেমনটা ইউবির সঙ্গে মোহনবাগানের চুক্তির সময়, ইউবির পক্ষ থেকে ‘ম্যাকডাওয়েল’ ব্র্যান্ডটাকে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এএফসির জন্য মোহনবাগান নামের আগে সিইএসসি, কিংবা স্পেনসার বা নিজের অন্য কোনও প্রোডাক্টের নাম সঞ্জীব গোয়েঙ্কা এখন ইচ্ছে করলেই ব্যবহার করতে পারবেন না। তা হলেই ক্লাব লাইসেন্সিং আটকে দেবে এএফসি। যে কারণে, অন্য কোনও ব্র্যান্ড মোহনবাগান নামের আগে ব্যবহার করতে না পেরে এটিকে ব্র্যান্ডটাকে জুড়ে দিয়েছেন আরপিএসজি কর্ণধার।
যিনি ফুটবলের জন্য প্রতিবছর বিপুল আর্থিক লোকসান করেও আইএসএলের সেরা দল বানাচ্ছেন, তিনি যে তাঁর ব্র্যান্ড ব্যবহার করতে চাইবেন, এটা অন্তত স্বাভাবিক ঘটনা। এতে আপত্তিরও কিছু নেই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ‘এটিকে’ শব্দটি ব্যবহার না করে দলের নাম যদি শুধুই ‘মোহনবাগান’ রাখতেন, তা হলে সঞ্জীব গোয়েঙ্কা কোটি কোটি মোহনবাগান সমর্থকদের হৃদয়ের মণিকোঠায় থাকতেন, না বাইরে?
যেরকমভাবে এটিকে মোহনবাগান দলটা তাঁর। ঠিক একইভাবে মোহনবাগান দলটাও তো তাঁরই থাকত। বদলে যুবভারতীতে গ্যালারির যে জায়গায় এটিকে মোহনবাগান বিরোধী ব্যানার, টিফোগুলি দেখা যায়, সেখানে হয়তো সঞ্জীব গোয়েঙ্কার গলায় মালা পরানো বড় বড় কাট আউট দেখা যেত। স্বাধীনতার ইতিহাস বহনকারী ‘মোহনবাগান’ ব্র্যান্ড আপনার হাতে আসার জন্য বসে আছে। আপনি তা ছেড়ে, ‘এটিকে মোহনবাগান’ নিয়ে খুশি থাকতে চাইছেন!
বিশ্বাস করুন, দল চালানোর ক্ষমতা কার হাতে, সমর্থকরা এগুলি কিছুই দেখতে চান না। মোহনবাগান দল সঞ্জীব গোয়েঙ্কার হাতে থাকলে কোথাও, কোনও সবুজ—মেরুন সমর্থকের বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই। দিনের শেষে সমর্থকরা শুধুই দেখতে চান, দারুণ দল গড়ে মোহনবাগান চ্যাম্পিয়ন হল কি না। আর মরশুমে ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে দেখা হলে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীকে হারাতে পারছে কি না। আর এই দুটি কাজই আপনার যোগ্য নেতৃত্বে দারুণভাবে করছে এটিকে মোহনবাগান। তবু সবুজ—মেরুন সমর্থকরা কিছুতেই এই দলটার সঙ্গে একাত্ম হতে পারছে না। কারণ, দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত যে নাম, সেই মোহনবাগান নামের আগে—পরে অন্য কিছু আর হয় না কি!
ধরুন, দলটার নাম মোহনবাগান না হয়ে যদি মৌরি স্পোর্টিং হত? আপনি কি ‘এটিকে’ দলটার অবলুপ্তি ঘটিয়ে মৌরি স্পোর্টিংয়ের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধতে আদৌ আগ্রহী হতেন? শৈশব থেকে আপনি নিজেও একজন আদ্যোপান্ত মোহনবাগানি। তাই যে মুহূর্তে মোহনবাগান ফুটবল দলটা চালনা করার সুযোগ এল, সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়েছেন। কারণ, আপনি জানেন, মোহনবাগান ফুটবল দলটা হাতে থাকা মানেই, কোটি কোটি সমর্থকের আবেগ, অনুভূতির নিয়ন্ত্রণও আপনার হাতে। বিশ্বাস করুন, আপনার হাতে ফুটবল দলের দায়িত্ব দেখে সমর্থকরাও খুশি। কারণ, দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পপতির হাতে মোহনবাগান ফুটবল দলের ভবিষ্যৎ পুরোপুরি সুরক্ষিত। আপনি নিজেও জানেন, ‘মোহনবাগানের’ মতো ১৩৩ বছরের বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ডের মালিকানা এখন আপনার হাতে। ৬ বছরের ‘এটিকে’ ব্র্যান্ডটাকে ১৩৩ বছরের ঐতিহ্যের আগে জুড়ে না দিলে বিশ্বজুড়ে মোহনবাগান সমর্থকরা আপনাকে মাথায় তুলে রাখবেন।
আইএসএলের প্রথম বছরে এটিকে দলটাকে সবাই কলকাতার দল হিসাবেই ভাবত। মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল, মহামেডানের বাইরে এটা যে বাংলার তৃতীয় দল, এরকমটা কেউ ভাবেনি। আইপিএলে কেকেআর যেরকম কলকাতার দল। আইএসএলে এটিকে ছিল ঠিক সেরকম। শুরুতে মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল, মহামেডান, সব সমর্থকই যুবভারতী ভরিয়ে তুলেছিল এটিকে ম্যাচে।
কিন্তু চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর এক সাংবাদিক সম্মেলনে যেই বললেন, এটিকের জনপ্রিয়তা মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গলের থেকেও বেশি, ব্যস, কলকাতার তিন প্রধানের সমর্থকরা ভেবে নিলেন, এটিকে শুধুই কলকাতার দল নয়। তাদের প্রতিপক্ষ দল। ঠিক তখন থেকেই ‘এটিকে’ শব্দটাকে আর মেনে নিতে পারে না মোহনবাগান—ইস্টবেঙ্গল। ফলে এটিকে মোহনবাগান নিয়ে আপনি যত ভাল দলই গড়ুন না কেন, সবুজ—মেরুন সমর্থকরা কিছুতেই একাত্ম হতে পারছেন না। আর মন থেকে যেটা না আসে, দলের উপর জাঁকজমকের যতই আবরণ পরানো হোক না কেন, সমর্থকরা কিছুতেই হৃদয় থেকে অনুভব করবেন না। অথচ আপনি ফুটবলের জন্য যা করছেন, বাংলার ফুটবল ইতিহাসের পাতায় চিরকালীন থেকে যাবেন।
হয়তো আপনার সুযোগ্য নেতৃত্বে এটিকে মোহনবাগান একদিন এএফসি চ্যাম্পিয়ন্স লিগও জিতবে। কিন্তু সেখানে হৃদয়ের ভালবাসা থাকবে না। থাকবে কর্পোরেটের আধুনিকতার মোড়ক। সবুজ—মেরুন সমর্থকরা আপনাকে মোহনবাগান ফুটবল দলের চেয়ারম্যান দেখতে চাইছেন। আপনাকে বরণ করে নেওয়ার জন্য বিছিয়ে রেখেছেন হৃদয়ের আসন। ফুটবলকে ঘিরে আপনার স্বপ্নের সঙ্গী হতে চাইছেন সবাই। ‘মোহনবাগানকে’ আপনার বিশ্বস্ত হাতে সুরক্ষিত দেখার জন্য সবুজ—মেরুন সমর্থকরা যে কোনও শর্তে রাজি। আপনি শুধু প্রকৃত ‘মোহনবাগানি’ হয়ে উঠুন। ‘এটিকে মোহনবাগানি’ নয়।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.