Advertisement
Advertisement

Breaking News

Salil Chowdhury

উদ্বাস্তু বাঙালি জীবনের স্বর হয়ে উঠেছিলেন সলিল চৌধুরী

জন্মশতবর্ষে পা দিলেন কিংবদন্তি সুরকার।

Salil Chowdhury marks his birth centenary
Published by: Biswadip Dey
  • Posted:November 22, 2024 2:16 pm
  • Updated:November 22, 2024 2:16 pm  

জন্মশতবর্ষে পা দিলেন সলিল চৌধুরী। তাঁর গান উদ্বাস্তু বাঙালি জীবনে জড়িয়ে থেকেছে। যারা কোনওদিন পূর্ববঙ্গে ফিরতে পারেনি, কিংবা যায়নি, কিন্তু বাঙাল ভাষা ও আদবকায়দায় একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ সংস্কৃতিকে ধারণ করেছে, তাদের ‘স্বর’ হয়ে উঠেছিলেন তিনি। লিখছেন ভাস্কর মজুমদার

শীতের সকাল! চারিদিক ধোঁয়া-ধোঁয়া। কারণটা কুয়াশাও হতে পারে, আবার গৃহস্থ বাড়ির উনুনের ধেঁায়াও হতে পারে। শাল গায়ে বাজারের ব্যাগ হাতে এক প্রবৃদ্ধ গলি দিয়ে বাড়ি ঢোকার মুখটায় আটকে গেলেন। লেটার বক্সে একটা চিঠি এসেছে– বিয়ের কার্ড-সহ। ভদ্রলোক চিঠি নিয়ে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করলেন। উঠোনে পরিবারের নানা সদস্য। শরিকি বাড়ি। বাচ্চাদের নামতা পড়ার শব্দ আসছে, কেউ জোরে কথা বলছে, কেউ উনুনে হাওয়া করছে, কেউ খবরের কাগজ পড়ছে, কেউ উঠোন নিকোচ্ছে, একটি মহিলাকণ্ঠ পূর্ববঙ্গীয় ভাষায় কিছু অনুযোগ করেই চলেছে।

Advertisement

বৃদ্ধটি উঠোন পেরিয়ে, একটি ছেলে (তার গায়েও শাল), যে কয়েকটি বাচ্চাকে জড়ো করে পড়াচ্ছে– তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন– ‘তর ভায়ে কই?’ ছেলেটি ঘরের দিকে নির্দেশ করতে, বৃদ্ধ পর্দা তুলে দেখলেন, একটি ছেলে হাফপ্যান্ট, আদুর গায়ে, এই শীতের সকালে, বুকডন দিচ্ছে। ভদ্রলোক সেই ছেলের উদ্দেশে বললেন, ‘তর নামে একটা বিয়ার চিঠি আইসে। কার বিয়া?’ আর এই বিখ্যাত সিনে-দৃশ্যের পুরোটা জুড়ে একটি চেনা বাংলা গান বাজছে– যেন আবহে রেডিও চলছে। গানটি ছিল– ‘মেঘ কালো, অঁাধার কালো…’!

আমি যে-বন্ধুর সঙ্গে সিনেমাটি দেখতে গিয়েছিলাম, সে সমবয়স্ক হলেও, আমাকে ‘তুমি’ সম্বোধনে কথা বলে। তার প্রশ্ন, ‘গানটা কার বলো তো?’ আমি বলি, ‘কার?’ বন্ধুর উত্তর, ‘সলিল চৌধুরীর। আমাদের বাড়িতে তঁার প্রচুর গান চলে।’ সলিল চৌধুরীকে তখনও আমি গানের স্রষ্টা হিসাবে চিনি না। বুঝিও না। তঁাকে আমরা চিনি বরং নাচ দিয়ে। তিনি সে-সময় আমাদের ‘সলিলদা’! কী করে?

আসলে, ছোট থেকে প্রায় মাধ্যমিক-বেলা পর্যন্ত যে-নাচের ইস্কুলে আমার যাতায়াত ছিল, তার কর্ণধার মহিলা, যঁাকে আমরা সকলে ‘নাচের দিদি’ বলতাম, তিনি প্রায়শই বলতেন সলিল চৌধুরীর সঙ্গে তঁার হৃদ্যতার কথা। ‘সলিলদা আমাদের প্রোগ্রাম কখনও বাদ দিতেন না’, ‘সলিলদা নিজে বলতেন– অ্যাই, তোমরা ওই গানটার উপর নাচ কম্পোজ করো’, কিংবা ‘আমি সবাইকে বলে রাখতাম তোরা ভাল করে প্রোগ্রাম করিস, কারণ সলিলদা হুট করে হয়তো এসে উপস্থিত হবে, পর্দা উঠলেই দেখা যাবে ফার্স্ট রো-তে বসে আছেন!’ ইত্যাদি।

শুনে আমাদের মনে হত, সলিল চৌধুরী বোধহয় বড় কোনও নৃত্যবিশারদ ছিলেন। বহুকাল টের-ই পাইনি– ক্লাবে, ক্লাবে– নানা জায়গার অনুষ্ঠানে, ‘ও আলোর পথযাত্রী’ কিংবা ‘উজ্জ্বল একঝঁাক পায়রা’ অথবা ‘হেই সামালো ধান হো’ গানগুলো আমরা যখন দল বেঁধে নেচে বেড়াচ্ছি, সেগুলো তৈরি করেছিলেন ওই সলিল চৌধুরীই। জীবনে সামনাসামনি দেখা না-হলেও নাচের দিদির ‘সলিলদা’ অজান্তে আমাদেরও ‘সলিলদা’ হয়ে গিয়েছিলেন!

সলিল চৌধুরীর সাংগীতিক জিনিয়াস নিয়ে, তঁার রাজনৈতিক চেতনা নিয়েও কম আলোচনা হয়নি। কিন্তু সেই প্রতিভা-বিচ্ছুরণের দু’-একটা ফুলকি বাংলা সৃজনশীল নৃত্যকেও প্রভাবান্বিত করেছিল নিঃসন্দেহে। ‘রানার ছুটেছে তাই ঝুমঝুম’, ‘অবাক পৃথিবী অবাক করলে তুমি’ আমরা কত না মঞ্চে মঞ্চে দেখেছি! সেই ইতিহাসের কথা ভুলে গেলে চলে না। সলিল চৌধুরী অনেক সময় অদৃশ্য হয়েও বাঙালির জীবনে জড়িয়ে থেকেছেন। বিশেষত, উদ্বাস্তু বাঙালি ও তাদের পরের প্রজন্মে। যারা কোনও দিন পূর্ববঙ্গে ফিরতে পারেনি, কিংবা যায়ওনি, কিন্তু বাঙাল ভাষা ও আদবকায়দায় একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ সংস্কৃতিকে ধারণ করেছে, তাদের ‘স্বর’ হয়ে উঠেছিলেন।

আমাদের বাড়িতে দারিদ্র ছিল। ছোটবেলায় অনেক সময় পুজো-পার্বণে একটা জামা হত বা হত না। আমাদের কেউ মনে রাখত না। কিন্তু ওই যে অন্তরা চৌধুরীর কণ্ঠ মাইকে বাজত– ‘কঁাদছ কেন আজ ময়না-পাড়ার মেয়ে/ নতুন জামা-ফ্রক পাওনি বুঝি চেয়ে/ আমার কাছে যা আছে সব তোমায় দেব দিয়ে/ আজ হাসি-খুশি মিথ্যে হবে তোমাকে বাদ দিয়ে…’– ওতে আমাদের অভাবী ছোটবেলায় স্নেহের প্রলেপ পড়ত।

কিংবা, বাড়িতে-বাড়িতে লতা মঙ্গেশকরের মিঠে গলায় যখন ‘পা-পা-মা-গা-রে-সা তার চোখের জটিল ভাষা’, ‘না যেও না রজনী এখনও বাকি’, ‘অন্তবিহীন কাটে না আর কেন বিরহের এই দিন’ শোনা যেত– সেই সময় গোটা একটা গোষ্ঠী– জীবনযুদ্ধে ক্লান্ত, শীর্ণ যেন শুশ্রূষা পেত। টালিগঞ্জ, অশোকনগর, নেতাজিনগর, বাঘাযতীন, হরিদেবপুর, চেতলায় থাকা আমাদের মতো পরিবারের কাছে রবীন্দ্রনাথ কিংবা তঁার গান ততটা সুলভ ছিল না– ‘এলিট’ ছিল যেন বা। তার থেকে অনেক কাছাকাছি ছিলেন সলিল চৌধুরী। অথচ তঁার সুর সহজ ছিল না। গানের গলা ভালো না হলে খালি গলায় সেসব গান গাওয়া মুশকিলই ছিল। অথচ, যথেষ্ট কঠিন হওয়া সত্ত্বেও এত কোমলভাবে ছিন্নমূল বাঙালি সমাজে কী করে তঁার গান-সুর মিশে যেতে পারল, ভাবলে অবাক হতে হয়।

সলিল চৌধুরীর জন্মশতবর্ষ শুরু হয়েছে। ১৯৯৫ সালে যখন উনি মারা যান, তখন আমরা প্রায় শৈশবে। কলকাতার বুকে তঁাকে কাজ করতে, শিল্পসৃষ্টি করতে, আমরা সরাসরি দেখিনি। কিন্তু তঁার কথা ও সুর প্রজন্মের-পর-প্রজন্ম বাহিত হয়েছে। ব্যক্তিগত জীবনে জেরবার সহকর্মীর কলার টিউনে শুনছি বাজছে– ‘না জানে কিঁউ হোতা হ্যায় ইয়ে জিন্দেগিকে সাথ’ চলছে। তার সন্তানটি অটিস্টিক। সে বলছে– ‘এই গানটা আমায় শান্তি দেয়।’ রূপান্তরকামী এক বন্ধু, যে তখনও অন্তরালবর্তী, লুকিয়ে বাড়িতে নারীপোশাক পরে আয়নার সামনে নাচে যখন– তখন তঁার আশ্রয় ‘হায় হায় প্রাণ যায়’! পাড়ার এক দিদি, যিনি গায়িকা হতে চেয়েছিলেন, কিন্তু মা-বাবা আর অনেকগুলো ভাইবোনের সংসারের জোয়াল টানতে গিয়ে গায়িকা হওয়া হয়নি, তার কেউ বিয়েও দেয়নি, গ্রীষ্মকালে লোডশেডিং হলে সেই দিদিকে ব্যালকনি থেকে মিহি গলায় গাইতে শুনতাম– ‘না মন লাগে না/ এ জীবনে কিছু যেন ভাল লাগে না’।

সলিল চৌধুরী আমাদের ছোট-ছোট জীবন জুড়ে ছিলেন, জুড়েছিলেন। তঁাকে যে আমরা খুব শনাক্ত করতে পারতাম, তা নয়। কিন্তু সলিল-সুর বয়ে যেত আমাদের সেই নিস্তরঙ্গ, ব্যর্থ জীবনের মধ্য দিয়ে। সিনেমার যে-দৃশ্যটির কথা বলে লেখা শুরু করেছিলাম, সেটি ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘তিতলি’ সিনেমার। কিন্তু আবহের গানটি সলিল চৌধুরীর ছিল না। ছিল নচিকেতা ঘোষের। আমার বন্ধু জানত, সবই সলিল চৌধুরীর। এ-ও সলিল চৌধুরীর বিরাট মাহাত্ম্য।

(মতামত নিজস্ব)

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement