Advertisement
Advertisement

Breaking News

Sagardighi

সাগরদিঘির শিক্ষা, জেতা আসনে হেরে আখেরে লাভ তৃণমূলেরই

এই আসনটি কোনওকালেই তৃণমূলের নিশ্চিত দুর্গ ছিল না।

Sagardighi bypoll results may be a good learning curb for TMC | Sangbad Pratidin
Published by: Subhajit Mandal
  • Posted:March 15, 2023 8:19 pm
  • Updated:March 15, 2023 8:19 pm  

কিংশুক প্রামাণিক: সাগরদিঘি তৃণমূলের হাতছাড়া হল বলে ‘গেল গেল’ রব তোলার কোনও কারণ নেই। একটি ভোট কখনও বিচারের মাপকাঠি হতে পারে না। মুর্শিদাবাদ জেলার এই আসনটি কোনওকালেই তৃণমূলের নিশ্চিত দুর্গ ছিল না। ২০১১ সাল থেকে তিনবার প্রয়াত সুব্রত সাহা (Subrata Saha) জিতেছিলেন বটে, কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে, বরাবর ভাগ্য তাঁর সহায় হয়েছিল। সব ক’টি জয় হয় কষ্টার্জিত, নতুবা নানা সমীকরণের ফসল।

অতএব, এই উপনির্বাচনের রায় দিয়ে সংখ্যালঘু ভোটের গতিমুখকে যেমন বিচার করা ঠিক হবে না, তেমনই সাগরদিঘিকে ‘মডেল’ ভাবারও কোনও কারণ নেই। সোজা কথাটি সোজা করেই আবার বলে দেওয়া ভাল যে, বাংলায় আজ এই মুহূর্ত পর্যন্ত সিংহভাগ সংখ্যালঘুর আস্থা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Mamata Banerjee) প্রতিই অনড়। তাদের সামনে বিকল্প নেতৃত্ব এখনও কেউ নেই। এখানে বঞ্চনা, পাওয়া-না পাওয়া কোনও বিষয় নয়। দিল্লিতে যতক্ষণ বিজেপি (BJP) ক্ষমতায় থাকবে, ততক্ষণ এই আস্থার হেরফের হবে বলে মনে হয় না।
কাজেই সাগরদিঘির রাজনৈতিক অভিঘাত নিয়ে আলোচনা হতে পারে, কিন্তু এই ভোট কোনও পূর্বাভাস দিতে পারবে না। মজা হল, জেতা আসন হেরেও আখেরে লাভ হল তৃণমূলেরই। এই ধাক্কা তাদের সতর্ক করবে। সংযত করবে। আরও জাগ্রত করবে। ভুল থাকলে সংশোধনের সুযোগ দেবে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সামাজিক প্রকল্পের সাফল্য ও ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তায় একছত্র ক্ষমতা তৃণমূলের (TMC)। ফলত, সব স্তরের ভোটে তাদের জয়জয়কার। লাগাতার সাফল্যের একটা খারাপ দিকও থাকে। সংগঠনে মেদ জমে। আচরণে আলস্য আসে। বিরোধিতা না থাকলে লড়াই করার অভ্যাস চলে যায়।

Advertisement

[আরও পড়ুন: কূটনীতির ট্রাপিজ, ইউক্রেন যুদ্ধে কীভাবে নিরপেক্ষ থাকবে ভারত?]

তাই বলা যায়, একের পর এক ভোটে জিতে যে সন্তুষ্টি শাসকদলের মধ্যে বাসা বাঁধছিল, তা কাটিয়ে দিতে পেরেছে সাগরদিঘির মানুষ। বুথস্তর পর্যন্ত কর্মীরা বুঝতে পারছে, সর্বত্র জিতে বসে আছি বলে গা-ছাড়া দেওয়ার উপায় নেই। ক্ষমতা যত পোক্ত হোক, নতুন কোনও ভোট মানেই নতুন যুদ্ধ। বিরোধীদের কখনও দুর্বল ভাবার দরকার নেই। জিততে গেলে মানুষের সঙ্গে থাকতে হবে। মানুষ নিজের অভিজ্ঞতার উপর দাঁড়িয়ে ভোট দেয়। সন্তুষ্ট না হলে, মানুষ তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে। স্বভাবতই বিরোধী শিবির যতই উল্লসিত হোক, পঞ্চায়েত ভোটের আগে এই ফলকে সামনে রেখে ঘর গুছিয়ে নেওয়ার সুযোগ পেয়ে গেলেন তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ফাঁকফোকর মেরামতি করেই তিনি যেতে পারবেন গ্রাম সংসদ দখলের ভোটে।

যে কথা শুরুতে বলছিলাম। একটু তথ্য পরিসংখ‌্যান নিয়ে পড়াশোনা করলেই দেখা যাবে, সাগরদিঘি কখনওই তৃণমূলের নিশ্চিত আসন ছিল না। ১৯৫২ সাল থেকে বাম জমানার আগে পর্যন্ত এখানে জিতে এসেছে কংগ্রেস। তারপর বামফ্রন্টের টানা জয়। প্রয়াত সুব্রত সাহা ২০১১ সালে পরিবর্তনের ভোটে তৃণমূলের টিকিটে প্রথম জেতেন। তবে সেবার কংগ্রেসের সঙ্গে তৃণমূলের জোট ছিল। যদিও সুব্রতবাবুকে হারাতে গোঁজ প্রার্থী দেওয়া হয়। তিনি ২২ হাজার ভোট কেটে নেন। মাত্র ৪ হাজার ভোটে জেতেন তৃণমূল প্রার্থী। সেই ভোটে ৩৮ শতাংশ ভোট পায় তৃণমূল।

Sagardighi bypoll results may be a good learning curb for TMC

২০১৬ সালের নির্বাচনেও ভোট কাটাকাটির সুযোগে জিতেছিলেন সুব্রতবাবু। তিনি পেয়েছিলেন ৪৪,৮১৭টি ভোট। অঙ্কের অনুপাতে মাত্র ২৬.২৩ শতাংশ। তবু জিতলেন কীভাবে? কারণ, এখানে কংগ্রেস প্রার্থী পান ৩৯,৬০৩টি ভোট। শতাংশর হিসাবে ২৩.১৮। সিপিএম প্রার্থী পান ৩৯,৩৮৫। ২৩.০৫ শতাংশ। একজন নির্দল প্রার্থীও ৩১ হাজার ভোট পান। তার শতাংশ প্রায় ১৯। এই জগাখিচুড়ি দশার মধ্যেও সুব্রত সাহা (Subrata Saha) নেহাত ভাগ্যবান। তিনি এগিয়ে থেকে ম্যাচ জেতেন। ২০২১ সালের বিধানসভা ভোট অবশ্য অন্য আঙ্গিকে হয়। বিজেপিকে ঠেকাতে মুসলিম ভোট বাংলার সর্বত্র তৃণমূলের দিকে ঢলে পড়ে। কিন্তু সাগরদিঘিতে মুসলিম ভোট পুরোটা পায়নি তৃণমূল। কংগ্রেস প্রার্থী পান ৩৬,৩৪৪টি ভোট।

[আরও পড়ুন: মহার্ঘ ভাতা নিয়ে আন্দোলন, ঘোলা জলে মাছ ধরার চেষ্টা?]

মজা হল, জোট থাকলেও সিপিএমের ভোট কংগ্রেস পায়নি। সেই ভোট বিজেপির দিকে চলে যায়। ২০১১ সালে যে বিজেপি সাগরদিঘিতে মাত্র ৪,২২০টি ভোট পেয়েছিল, তারা ২০২১ সালে পেল ৪৪,৯৮৩টি ভোট। সুব্রত সাহা পান ৯৫,১৮৯টি ভোট। জয়ের অঙ্ক ৫০ হাজার দেখালেও বিরোধীদের ভোট যোগ হলে লড়াই হত হাড্ডাহাড্ডি। অর্থাৎ, তথ্য বলছে সাগরদিঘি নিয়ে তৃণমূলের উদ্বেগের কিছু নেই। বরং ধাক্কাটা তাদের কাজে লাগবে।

এর পরও নবাবের জেলার এই বিধানসভা ক্ষেত্রে শাসকের পরাজয় নিয়ে হইচই হওয়ার কয়েকটি কারণ আছে। প্রথমত, এটি ছিল উপনির্বাচন। সাধারণভাবে উপনির্বাচনের ফল শাসকদলের পক্ষে যায়। সেখানে জেতা আসন হাতছাড়া হয়ে গেল। দ্বিতীয়ত, নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে যখন রাজ্য তোলপাড়, তখন এই ফল শাসকের বিরুদ্ধে জনরায় বলে প্রচার করছে বিরোধীরা। তৃতীয়ত, তৃণমূল প্রার্থীকে হারাতে নিচুতলায় তিন দলের জোট বাঁধার প্রবণতাও লক্ষ করা গিয়েছে। যদিও এই জোট নিয়ে মমতা নিজেও জ্ঞাত ছিলেন। তিনি প্রকাশ্যেই বলছেন, তাঁকে হারাতে রাম-বাম-শ্যাম অর্থাৎ বিজেপি (BJP), সিপিএম ও কংগ্রেস এক হয়েছে। এই প্রবণতায় বাম-কংগ্রেস ভবিষ্যতে কতটা লাভ করবে, সময় বলবে।

Sagardighi bypoll results may be a good learning curb for TMC

এই ফলে আরও লক্ষণীয় হল, বাংলার বিজেপির পিছু হঠা অব্যাহত। গত বিধানসভা ভোটে শ্যামাপ্রসাদের মাটি দখল করতে সর্বশক্তি নিয়ে নেমেছিলেন বিজেপির শীর্ষনেতারা। যত অস্ত্র আছে সব প্রয়োগ করা হয়েছিল। তাঁরা সফল হননি। বাম-কংগ্রেস শূন্য। এরপর থেকে দেখা যাচ্ছে, বিজেপি কোনও ভোটেই জিততে পারছে না। দু’টি জেতা আসন উপনির্বাচনে হেরেছে। ছয় বিধায়ক এক সাংসদ-সহ বেশ কিছু নেতা দলত্যাগ করেছেন। পুরভোটে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে বাম-কংগ্রেস। সাগরদিঘিতেও বিজেপি তৃতীয়। পেয়েছে মাত্র ১৪ শতাংশ ভোট। অর্থাৎ, প্রধান বিরোধী ভোটে বিজেপির দিক থেকে সরে যাচ্ছে জোটের দিকে। এটা খুব বড় বার্তা সাগরদিঘিতে।

কেউ কেউ মনে করছেন, সাগরদিঘির এই ফল অধুনালুপ্ত পাঁশকুঁড়া লোকসভা আসনের ফলকেও যেন মনে করিয়ে দিল, যে রায়ের রাজনৈতিক অভিঘাত ছিল সাংঘাতিক। কমিউনিস্ট পার্টির স্বনামধন্য নেত্রী গীতা মুখোপাধ্যায়ের মৃতু্যর পর ২০০০ সালে ওই আসনে উপনির্বাচন হয়। মমতার নতুন দল তখন ১৯৯৯ সালের লোকসভা ভোটে আটটি আসন জিতে কংগ্রেসকে (Congress) পিছনে ফেলে দিয়েছে। বাংলার পরিবর্তনের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে তৃণমূলনেত্রীকে ঘিরে। সেই সময় সবাইকে অবাক করে বামদুর্গে জিতে যান তৃণমূল প্রার্থী বিক্রম সরকার। এর ফলে মমতা আরও আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। তৃণমূলের সংগঠন বাড়তে থাকে। গভীর চিন্তায় পড়ে আলিমুদ্দিন স্ট্রিট। মমতার উত্থানে সিপিএম সতর্ক হয়। দুঁদে নেতা প্রয়াত অনিল বিশ্বাস (Anil Bishwas) বুঝতে পারেন গড়বেতা, কেশপুর, পিংলা, ডেবরা, শিহর, খানাকুল, আরামবাগ, কোতুলপুর, সব হাতের বাইরে চলে গিয়েছে। মমতা মুখ্যমন্ত্রী হয়ে যাবেন। সেই শুরু তৃণমূলকে ঠেকানো। বলা যায়, পাঁশকুঁড়া ফলে সতর্ক হয়েছিল বলেই ২০০১ সালে বিধানসভা ভোট কৌশলে জিতে নেয় সিপিএম (CPIM)।

পরিবেশগত কোনও মিল না থাকলেও সেই উপনির্বাচন ও এই উপনির্বাচনে মিল অবশ্যই একটা আছে। তা হল, সেদিন যেমন পাঁশকুঁড়া থেকে ক্ষতটা অনিল বিশ্বাসরা বুঝেছিলেন, তেমনই সাগরদিঘির ফলাফল থেকে ক্ষত কোথায় টের পেলেন মমতাও। বিরোধী দলগুলি কী কৌশল করছে, তা-ও তাঁর জানা হয়ে গেল। স্বভাবতই পঞ্চায়েতের অঙ্ক এবার মাথা ঠান্ডা রেখে ভেবেচিন্তে কষতে পারবেন তৃণমূলনেত্রী। দলকে বার্তা দিতে পারবেন, জেতা আসনে আসলে তৃণমূল হারেনি। সাগরদিঘির ফল দিয়েছে শিক্ষা।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement