ঋত্বিক আচার্য: আমেরিকার বিখ্যাত গল্ফ তারকা ওয়াল্টার হাগেন বলেছিলেন, “No one remembers who came in second”। অর্থাৎ প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয়কে কেউ মনে রাখে না। আর সেই দ্বিতীয় হওয়ার সম্ভাবনা কার্যত উড়িয়ে দিল রাশিয়া। গত জুনেই শুরু করে ১১ অগাস্ট মানে নির্ধারিত দিনের একদিন আগেই তারা জানিয়ে দিল Covid-19 ভ্যাকসিন তৈরি।
বিগত কয়েক সপ্তাহ ধরেই চলছিল চূড়ান্ত ঘোষণার প্রস্তুতি। তুলনা চলছিল মহাকাশযান স্পুটনিকের সেই সাফল্যের সঙ্গেও। মঙ্গলবার গোটা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন ঘোষণা করেন, চূড়ান্ত পর্যায়ে সাফল্য পেয়েছে তাঁদের ভ্যাকসিনটি। তারপর থেকেই পৃথিবীজুড়ে এনিয়ে চলছে আলোচনা, সমালোচনা। কীভাবে আমেরিকা, ব্রিটেন বা চীনকে পিছনে ফেলে এত দ্রুত এগিয়ে গেল রাশিয়া? তবে কি বিশ্বের করোনা ভ্যাকসিনের বাজারটা চলে আসবে তাদের দখলেই? চমকের এখানেই শেষ নয়, বিশ্বাসযোগ্যতা প্রমাণ করতে রাষ্ট্রপতি পুতিনের মেয়ে মারিয়া অথবা ক্যাটরিনার শরীরে প্রয়োগ করা হয়েছে এই ভ্যাকসিন।
বিশিষ্ট চিকিৎসক, বিজ্ঞানী অথবা রাজনীতিবিদ- সকলেই একটি বিষয়ে একমত যে এই ভ্যাকসিন নিশ্চিতভাবে নিরাপদ। নাহলে নিশ্চয়ই রাষ্ট্রপতির মেয়ে এই ভ্যাকসিন নিতেন না। মজার বিষয় হল দেশবাসীর জনমত, আস্থা এবং সুরক্ষা সুনিশ্চিত করতে রাষ্ট্রনায়কদের, বিজ্ঞানীদের ও সেলিব্রিটিদের নিজেদের অথবা নিজেদের ছেলে-মেয়ে বা পরিচিত পরিসরে এই ধরনের প্রয়োগের নীতি একেবারেই নতুন নয়। ৩০০ বছরেরও বেশি পুরনো এই ইতিহাস। এই প্রয়োগের ফল যে সবসময় ইতিবাচক হয়েছে এমনটাও নয়।
অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুর দিক। ভ্যাকসিন তখনও আসেনি। গুটি বসন্তে বিধ্বস্ত ইউরোপ, আমেরিকা, এশিয়ার বিভিন্ন দেশ। ভয়ানক এই রোগে আক্রান্ত প্রতি দশ জন মানুষের মধ্যে মৃত্যু হচ্ছে অন্তত তিনজনের। প্রাণে বাঁচলেও স্থায়ীভাবে থেকে যাচ্ছিল দৃষ্টিশক্তি হারানো অথবা অন্যান্য জটিল শারীরিক সমস্যা। ১৭১৬ সালে তৎকালীন তুরস্কে নিযুক্ত ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত লর্ড মন্টেগুর স্ত্রী মেরি মন্টেগু তাঁর তুরস্কর বান্ধবীদের ও তাঁদের সন্তানদের উপর প্রয়োগ করালেন গুটি বসন্ত আক্রান্ত রোগীর দেহে সৃস্টি হওয়া ফোঁড়া থেকে নেওয়া পুঁজ। যার প্রয়োগে তাঁর বান্ধবীরা ও তাঁদের সন্তানরা সাময়িকভাবে সংক্রমিত হলেও সেরেও উঠেছিলেন খুব তাড়াতাড়ি। আর সেই সঙ্গে তারা গুটি বসন্তের হাত থেকে স্থায়ী সুরক্ষা পেয়েছিল। এই পদ্ধতিই ভ্যারিওলেশন পদ্ধতি বলে পরিচিতি পায় পরবর্তীতে।
এই ঘটনার প্রায় ২০ বছর পরের ঘটনা। ডঃ বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন, যিনি একধারে বিশিষ্ট বিজ্ঞানী, রাজনীতিবিদ এবং জনস্বাস্থ্য আধিকারিক। আমেরিকার পেনসিলভেনিয়াতে গড়ে তুলেছিলেন হাসপাতাল। রীতিমতো প্রচার চালাতে থাকেন গুটি বসন্তের ভ্যারিওলেশনর। ১৭৩৬-এ জনগণের মধ্যে আস্থা গড়ে তুলতে ভ্যারিওলেশনের প্রয়োগ করেন নিজের ৪ বছরের সন্তানের উপর। ফল হয় মারাত্মক। মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়ে তাঁর সন্তান। নিজের আত্মজীবনীতে এই ঘটনা নিয়ে অসম্ভব আত্মগ্লানি প্রকাশ করেছিলেন ডঃ ফ্রাঙ্কলিন।
১৭৬৩-এর পন্টিয়াসের যুদ্ধ। সম্ভবত ইতিহাসের প্রথম জৈব যুদ্ধ। গুটি বসন্ত আক্রান্ত রোগীদের ব্যবহার করা কম্বল গোপনে ব্রিটিশরা পৌঁছে দেয় মার্কিন আদিবাসীদের কাছে। যার ফলে ১৭৬৪ সালে ওহিও নদী সংলগ্ন এলাকাতে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়লো গুটি বসন্ত। সাল ১৭৭৭। চলছে আমেরিকার মুক্তিযুদ্ধ। আবারও জৈবযুদ্ধ হলে যাতে মুক্তিযোদ্ধাদের কিছুটা হলেও বাঁচানো যায়, তাই বিপদের সম্ভাবনাকে মাথায় রেখেও জর্জ ওয়াশিংটন চালু করতে বললেন গুটি বসন্তের ভ্যারিওলেশন।
১৭৪৯ সালের ১৭ মে ইংল্যান্ডের গ্লোচেস্টরশায়ারে জন্ম হয় আধুনিক ভ্যাকসিনের জনক এডওয়ার্ড জেনারের। মেধাবী ছাত্র জেনার চিকিৎসাবিদ্যা শিখলেন চিকিৎসক জন হান্টারের কাছ থেকে। একটা কথা সে সময় লোকমুখে প্রচলিত ছিল। গোয়ালাদের নাকি গুটি বসন্ত হয় না। মানুষের যেমন গুটি বসন্ত হত তেমনই গরুর হয় গো-বসন্ত। সেই গো-বসন্ত সংক্রমিত হতে পারে মানুষের মধ্যেও। যার ফলে মানুষের সামান্য উপসর্গ দেখা দিলেও সেরে যায় খুব শীঘ্রই।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল এইসব মানুষের নাকি আর গুটি বসন্ত হয় না। এই কথা জানার পর থেকেই চিন্তামগ্ন ডাক্তার জেনার। একদিন বিকেলে নিজের চেম্বারে রোগী দেখছেন তিনি। সারা নামের এক মহিলা এসেছেন। হাতে বড় বড় ফোঁড়া নিয়ে, যা থেকে পুঁজ গড়াচ্ছে। ডাক্তার জেনার জানতে পারলেন ওই গোয়ালিনীর এই সংক্রমণ সম্ভবত হয়েছে গরুর দুধ দোয়াতে গিয়ে। আর দেরি না করে ডাক্তার ফোঁড়া থেকে খানিকটা পুঁজ রেখে দিলেন। বাগানের মালির ৬ বছরের ছেলের উপর প্রয়োগ করলেন সেই পুঁজ। রোগের সামান্য লক্ষণ দেখা দিল ছেলেটির শরীরে। কয়েকটা বিনীদ্র রাত কাটালেন ডাক্তার। সেরে উঠল ছেলেটি। এবার তাকে মুখোমুখি করানো হল গুটি বসন্তের সংক্রমণের। সম্পূর্ণভাবে রোগমুক্ত থাকল ছেলেটি। এরপর প্রয়োগ চালালেন বিস্তর। নিজের ছেলের উপরেও প্রয়োগ করলেন এই ভ্যাকসিন। প্রায় প্রত্যেক ক্ষেত্রেই পেলেন সাফল্য। রয়েল সোসাইটিতে তার জমা দেওয়া এ বিষয়ে গবেষণাপত্র প্রথমে অনেকেই যথার্থ মনে করেননি। ডাক্তার জেনারকে নিয়ে চলে অভিজাত মহলে বিস্তর অবজ্ঞা। তবে দমে যাননি ডাক্তার জেনার, চালিয়ে যেতে থাকেন নিজের কাজ।
ইতিমধ্যে ইতিহাসের অন্যতম বিতর্কিত ফরাসী শাসক নেপোলিয়ান বোনাপার্ট আগ্রহ প্রকাশ করলেন এই ভ্যাকসিন নিয়ে। সেনা বাহিনীকে এই ভ্যাকসিন নেওয়ার নির্দেশ জারি করেন তিনি। শোনা যায়, সদা সন্দেহ বাতিকগ্রস্থ এই শাসক নিজেও নেন এই ভ্যাকসিন। ডাক্তার এবং বিজ্ঞানী জেনারের সঙ্গে এতটাই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল এই শাসকের যে যুদ্ধ বন্দি দু’জন ব্রিটিশ সেনার রাতারাতি মুক্তি মেলে জেনারের এক চিঠিতেই। ১৭৯৮ সালে ডাক্তার জেনার সারা বিশ্বের কাছে বই আকারে প্রকাশ করলেন তাঁর বিস্তৃত গবেষণা। নাম “এনকোয়ারি ইনটু কজ অ্যান্ড ইফেক্ট অফ দ্য ভ্যারিওলি ভ্যাকসিন।” আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ পায় পৃথিবীর প্রথম ভ্যাকসিন। সাধারণ ব্রিটিশ নাগরিকদের জেনারের এই ভ্যাকসিন নেওয়ার ব্যপারে উৎসাহিত করতে থমাস ডিমসডেলে, জর্জ রোমের মতো ডাকসাইটে ব্রিটিশ রাজনীতিবিদরা একে একে নিতে থাকেন এই ভ্যাকসিন। ডাক্তার জেনারের মৃত্যুর প্রায় ১৭ বছর পর ১৮৪০ সালে গোটা ব্রিটেনে বিনামূল্যে দেওয়া শুরু হয় এই ভ্যাকসিন।
বিংশ শতাব্দীতে পুরো বদলে যেতে থাকে বিশ্বের আর্থিক ও সামাজিক রূপরেখা। ভ্যাকসিন প্রয়োগ করে অতিমারীকে ঠেকাতে না পারলে যে কোনও দেশের আর্থসামাজিক উন্নতি করাটা কঠিন, তা ক্রমেই বুঝতে পারেন রাষ্ট্রনায়করা। সেলেব্রিটিদের সামনে রেখে ভ্যাকসিনের প্রয়োগ ও প্রচার চালালে তার জনমানসে প্রতিক্রিয়া যে বেশ ইতিবাচক হবে তা ক্রমেই পরিষ্কার হয়। ১৯৫৬ সালে একটি জনসভায় বিশ্বখ্যাত সংগীত শিল্পী ও অভিনেতা এলভিস প্রিসলি নিজের শরীরে প্রয়োগ করতে দেন পোলিও রোগের ভ্যাকসিন। যার হাত ধরে সারা মার্কিন মুলুকে শুরু হয় পোলিও ভ্যাকসিনেশন। এরপর সারা পৃথিবীজুড়ে সেলেব্রিটিরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে সমর্থন করে এসেছেন ভ্যাকসিনের, বাদ যায়নি আমাদের উপমহাদেশও। Covid-19 ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রেও ৩০০ বছরেরও আগে থেকে চলতে থাকা নীতি যে আজও জনমানসে একইরকম প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে, তা আবারও প্রমাণিত হল পুতিনকন্যার নিজের দেহে ভ্যাকসিন প্রয়োগের ঘটনাতে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.