ভোটের আবহে হিন্দু-মুসলমান নাগরিকত্ব, রামমন্দির, ৩৭০-সবই প্রচারের মহার্ঘ। অর্থনীতি, বেকারত্ব, আর্থিক অসাম্য, দারিদ্র-তবে ব্যাকফুটে? লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল।
দিল্লি ফেরার পথে কলকাতা বিমানবন্দরে কফি খেতে ইচ্ছে হল। সারি-সারি কফি শপ। একটা ছোট কফির দাম ২৫০ টাকা। ক্যাশে দঁাড়িয়ে থাকা ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলাম, কফির দাম বাড়িয়ে দিয়েছ? ওর নাম আবদুল। সে বলল, এই ২০২৪-এর জানুয়ারি মাস থেকে দাম বেড়ে গিয়েছে। আগে দাম ছিল ২০০। এখন ২৫০। দেখলাম, মিথ্যে বলছে না। অন্যান্য কফি শপেও একইভাবে চা-কফির দাম বেড়েছে ৫০ টাকা। কিন্তু কেন? কর্মরত সব ছেলেমেয়ে-ই বলল, বাজার খুব খারাপ। এয়ারপোর্ট কর্তৃপক্ষকেও অনেক টাকা ভাড়া দিতে হয়। ওরাও ভাড়া বাড়াচ্ছে। তবে অামাদের স্যালারি বাড়ছে না। খুব কম টাকা পাই আমরা। সকাল থেকে
রাত পর্যন্ত দঁাড়িয়ে দঁাড়িয়ে চা-কফি, কেক-প্যাটি বিক্রি করছি।
কফিতে সবে চুমুক দিয়েছি– সংস্থার ইউনিফর্ম পরিহিত আর-একজন কফিবিক্রেতা এসে বললে, আপনি জয়ন্ত স্যর না? আমি বললাম, হঁ্যা তুমি? সে বলল, স্যর, আমি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস কমিউনিকেশনের স্টুডেন্ট ছিলাম। আপনি আমাদের ক্লাস নিতেন।
–তুমি স্নাতক কোর্সটা কমপ্লিট করেছিলে?
–হঁ্যা স্যর। আমি গ্র্যাজুয়েট হলাম মাস-কম নিয়ে। কিন্তু কোথাও কোনও চাকরি পেলাম না। তাই কনট্র্যাক্টে এই চাকরি পেয়ে ঢুকে গেলাম। কিন্তু খুব কম টাকা, স্যর। তাই এই চাকরিও
ছেড়ে দিচ্ছি।
–কী চাকরি করবে?
সে বলল, এয়ারপোর্টের সাফাইকর্মী হব। ওখানে অ্যাপ্লাই করেছি। সাফাইকর্মীদের বেতন এখানকার চেয়ে বেশি।
যা হোক, আড়াইশো টাকার কফি সঙ্গে জিএসটি দক্ষিণা চোকালাম। অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানও সঞ্চয় করলাম অনেকটা। আর দিল্লি পৌঁছে ভাবছিলাম, এই আর্থিক চিত্রটি কি শুধু কলকাতা বিমানবন্দরে? সারা দেশের অন্য রাজ্যগুলোর অবস্থা কি ফাটাফাটি? দিল্লির পাঞ্জাবি ভাষায়, ‘বল্লে-বল্লে’? কিন্তু দিল্লি এসে খান মার্কেট গ্রেটার কৈলাসের অভিজাত বাজারগুলোয়, এমনকী, দিল্লির বিমানবন্দরেও দেখলাম একই চিত্র।
দিল্লিতে কর্মরত মার্কিন আর্থিক লগ্নি ও গবেষণা সংস্থার এক উপদেষ্টার সঙ্গে ক’দিন আগে দেখা হয়েছিল। সেই অর্থনীতিবিদ মানুষটি বিপুলভাবে মোদি-ভক্ত। তঁাকে জিজ্ঞেস করলাম, এখন দেশে ভোট চলছে। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ যেন। কিন্তু শেয়ারবাজার ঊর্ধ্বমুখী, রোজ ইংরেজি গোলাপি কাগজগুলোতে ‘লিড স্টোরি’ সেনসেক্স রেকর্ড টাইম-আপ। সোনার দাম নববর্ষের মুখে বেড়েছে অনেকটা। কিন্তু চাকরি নেই। পিএইচডি করে ‘স্টারবাক্স’-এ কফি বিক্রির কাজ করছেল যুবক-যুবতী। ছদ্ম বেকারত্ব। তা, ওই ভদ্রলোক বললেন, আমাদের সমীক্ষা বলছে, ভারতের জনসংখ্যার শতকরা দশভাগ মানুষ অতি ধনী। তাঁরা বাজারের দামি পণে্যর উপভোক্তা। ‘টেসলা’ কোম্পানি ২ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে আসছে দিল্লি। ইলন মাস্কের কোম্পানি চিনে না-গিয়ে ভারতে আসছে। আবার, ‘মার্সিডিজ বেঞ্জ’ সংস্থা জানাচ্ছে টেসলা আসার আগে এই আর্থিক বর্ষে তাদের গাড়ি বিক্রির বহর কম নয়। ২০২৩ সালে ১৭,৪০৮টি মার্সিডিজ গাড়ি ও এসইউভি বিক্রি করেছে তারা। ২০২২-এর তুলনায় শতকরা দশভাগ বৃদ্ধি। অথচ সার্বিকভাবে অটোমোবাইল কোম্পানিগুলো তো মুখ থুবড়ে পড়েছে। এই গাড়ি-শিল্পে প্রায় ৫০ লক্ষ লোক কাজ করছে। ‘অটোমোবাইল কম্পোনেন্ট ম্যানুফ্যাকচারারস অ্যাসোসিয়েশন’ (এসিএমএ) বলছে– গাড়ি বিক্রির ব্যবসায় যদি এই মন্দা চলে, তাহলে দশ লাখ লোকের ছঁাটাই অনিবার্য। ঋণ ফেরতও পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে গাড়ির ক্ষেত্রে। ব্যাঙ্কগুলো ডিলারদের গাড়ি কেনার জন্য ঋণ দেওয়া বহুলাংশে বন্ধ করছে।
সেই মার্কিনপ্রেমী ও মোদিপ্রেমী ওই বিশেষজ্ঞ আরও বললেন, এ-দেশের দশভাগ ধনী, কিন্তু ৫০ ভাগ মানুষ মধ্যবিত্ত। তাদের জীবন সুখ-দুঃখ– দুই ভাইকে নিয়ে। জীবনদর্শন– কভি খুশি, কভি গম। ওদিকে মার্কিন সমীক্ষা রিপোর্ট বলছে, বাকি শতকরা ৪০ ভাগ মানুষ আছে এক ভয়াবহ আর্থিক কষ্টে। দারিদ্র চরমে। কর্মহীনতা। প্রধানমমন্ত্রী এখন তাই সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দিচ্ছেন আর্থিক উন্নয়নে। লগ্নি বাড়াতে হবে।
৪০ ভাগ গরিব মানুষকে টেনে তুলতে হবে।
‘দ্য ইকোনমিস্ট’ পত্রিকা লিখছে, কেন ভারতের এলিট সম্প্রদায় মোদিকে পছন্দ করে? কিন্তু আদতে গরিব মানুষের ভালবাসা পাওয়ার জন্যই তো মোদি ও বিজেপি ২০২৪ ভোটপ্রচারে সোচ্চার। ভারতীয় ব্যাঙ্ক কর্তারাও বলছেন, মোদি-ই নাকি আবার আসবেন। এলে, শেয়ারবাজার চড়চড় করে আরও উঠবে। ব্যাঙ্কে যঁারা মিউচুয়াল ফান্ডে রিস্ক এবং নন-রিস্ক ইনভেস্টমেন্ট করেন, তঁারাও তো তাই চান। যদি একটা খিচুড়ি সরকার হয় তবে তো স্থায়িত্বের গঙ্গাপ্রাপ্তি হবে। তখন তো অর্থনীতিরও অবস্থা হবে শোচনীয়।
যত দেখছি ও শুনছি, হিসাব মিলছে না। বারবার ‘গ্রাউন্ড জিরো’-তে দেখছি চাকরি নেই। নিজের যোগ্যতা ডিগ্রি, প্রতিভা, কর্মদক্ষতাকে শিকেয় তুলে অর্থ রোজগারের জন্য যা হোক তা হোক একটা চাকরি করতে হচ্ছে। এ কীসের সুশাসন? এই কী রামরাজ্য? স্বর্ণযুগ?
‘ওয়ার্ল্ড ইনইকু্যয়ালিটি ল্যাব’-এর সাম্প্রতিকতম তথ্য বলছে, ভারতে ধনী ও দরিদ্রের মধে্য আর্থিক বৈষম্য অতীতের সমস্ত রেকর্ড ছাড়িয়ে গিয়েছে। দেশের জাতীয় সম্পদের ৪০ শতাংশ রয়েছে দেশের ১ শতাংশ ধনকুবেরের হাতে। ১৯২২ থেকে ২০২৩ ‘দ্য রাইজ অফ দ্য বিলিওনিয়ার রাজ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আধুনিক বুর্জোয়াদের নেতৃত্বাধীন ‘কোটিপতিরাজ’ ঔপনিবেশিক শক্তির নেতৃত্বে ব্রিটিশরাজের সময়ের চেয়েও বেশি অসম। ২০১৪-’১৫ এবং ২০২২-’২৩ সালে এই বৈষম্য রেকর্ড পরিমাণ বেড়েছে।
এই গবেষণালব্ধ রিপোর্ট নিয়ে ভোটের সময় বিতর্ক বেড়েছে। বিরোধী শিবির নরেন্দ্র মোদিকে কাঠগড়ায় দঁাড় করাচ্ছে। আবার মোদিপন্থীরা বলছে, এই রিপোর্ট অসত্য ও বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী। অর্থনীতিবিদদের মধে্যও বিতর্ক শুরু হয়ে গিয়েছে। প্রচলিত রসিকতা, দু’জন অর্থনীতিবিদ কখনওই কোনও বিষয়ে একমত হতে পারেন না।
তা বেশ তো! কিন্তু কোনও দলের জার্সি গায়ে না দিয়ে বলছি, সারা পৃথিবীজুড়েই এই আর্থিক অসাম্য বাড়ছে। ক্লাসিকাল মার্কসবাদ বলেছিল, ধনী আরও ধনী হচ্ছে, গরিব আরও গরিব। ব্রিটেনের অবস্থাই দেখুন না কী ভয়াবহ, দেশের প্রধানমন্ত্রীর চাকরি যায়-যায় অবস্থা। জুন মাসে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ভোটে যদি রক্ষণশীলরা পর্যুদস্ত হন, তবে কিন্তু সরকারের পতন হতে পারে। ভোট এগিয়ে আসতে পারে। নারায়ণমূর্তির জামাই ঋষি সুনক অর্থনীতির এই অচলাবস্থার জন্য দায়ী না-হলেও, দায়িত্ব তো নিতেই হবে প্রধানমন্ত্রীকে।
পৃথিবীতে এই আর্থিক বৈষম্য যে-অনুপাতে বাড়ছে, ভারতে তার চেয়ে বেশি। পশ্চিমে এই নয়া বুর্জোয়াতন্ত্রকে বলা হয় ‘প্লুটোক্রেসি’।
অসাম্য বৃদ্ধির পাশাপাশি অনেকে বলছেন সামে্যর ইতিহাস পর্যালোচনা করলেও দেখা যাচ্ছে, সামন্তযুগ থেকে পুঁজিবাদ, পুঁজিবাদ থেকে হালের নিউ ডিজিটাল যুগের সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপটেও সাম্যর কিন্তু ক্রমিক অনগ্রসরতাই দেখা যাচ্ছে। ‘আ ব্রিফ হিস্ট্রি অফ ইকুয়ালিটি’। লেখক টমাস পিকেটি। বইটি ২০২২ সালে
প্রকাশ করে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস বলেছিল, এ বইটি হল এ দুনিয়ায় সামে্যর এক আশাবাদী ইতিহাস। অসাম্য নিয়ে হতাশ হওয়া তো খুব সোজা। অাশাবাদী হওয়া কঠিন। টুকটাক ফোন পাই। অচেনা যুবক-যুবতীরা বলেন, চাকরি নেই। কোনও চাকরি পাওয়া যাবে? তবে কি ঋত্বিক ঘটকের ‘নাগরিক’, মৃণাল সেনের ‘ইন্টারভিউ’, বা সত্যজিতের ‘জনঅরণ্য’-র দিন ফিরে আসছে?
কৃত্রিম মেধার যুগে রোবটরা এখন অাবহাওয়ার খবর পড়ছে। আগামী দিনে তারা-ই হবে অ্যাঙ্কর? যে ভারি ভারি ক্যামেরা আই-পড নিয়ে তিনজন আলোকচিত্রী ভিডিওম্যান সাক্ষাৎকার নিত, এখন সেখানে একজনই যথেষ্ট। বহু ক্ষেত্রে ক্যামেরাপার্সন দরকারই হচ্ছে না। অনেকেই ‘মোজো’-তে পারদর্শী। ‘মোজো’ মানে?
মোবাইল জার্নালিজম। বেশ কয়েক দশক আগে নিউ ইয়র্ক শহরের রাজপথে অানম্যান্ড ভেন্ডর থেকে এক ডলারের কয়েন দিয়ে খবরের কাগজ কিনে রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম। আবার ভয়ও পেয়েছিলাম, আমাদের দেশে হলে তো বহু লোকের চাকরি যাবে! ১৪০ কোটির ভারত ম্যালথসের কাঠগড়ায় বসবাসকারী দেশ। এখনও এয়ারপোর্টে দেখি চকোলেট, কোল্ড ড্রিঙ্কসের অানম্যানড দোকান। হকারতন্ত্রের ফুটপাতে অবশ্য এখনও লাগানো হয়নি।
নির্বাচন চলছে। কেউ শব্দ ক’রো না। চুপ। ভোটের সময় হিন্দু-মুসলমান, নাগরিকত্ব, রামমন্দির, ৩৭০– সবই প্রচারের মহার্ঘ। অর্থনীতি, বেকারি, অসাম্য ও দারিদ্র– ওসব নিদ্রিত। ভোট-ভগবান দারিদ্রর গোলযোগ
সইতে পারেন না।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.