বাংলার ছেলে সাবির মল্লিককে সন্দেহের বশে গোরক্ষক-কৃত পিটিয়ে হত্যার ঘটনা এবং কংগ্রেসের হয়ে ভিনেশের রাজনৈতিক উত্থান– অস্বস্তিতে ফেলেছে বিজেপিকে। হরিয়ানায় হারলে, এ-রাজ্যে আর জি কর আন্দোলনে বিজেপির অংশগ্রহণ প্রশ্নের মুখে পড়বে আরও। লিখলেন সুতীর্থ চক্রবর্তী।
হরিয়ানার মতো একটি ছোট রাজে্যর বিধানসভা ভোট অতীতে কখনওই সর্বভারতীয় রাজনীতির চালচিত্রে জায়গা করে নিতে পারেনি। এবারই পরিস্থিতি অন্যরকম। ৫ অক্টোবর হরিয়ানার ভোটের ফল একসঙ্গে বহু রাজনৈতিক বার্তা নিয়ে সামনে অাসতে চলেছে বলে রাজনৈতিক মহলের ধারণা। অার. জি. কর অান্দোলনের অাবহে উত্তপ্ত বাংলার রাজনীতিতেও এর কিছু অভিঘাত থাকবেই থাকবে। বস্তুত, চরখি-দাদরিতে বাংলার পরিযায়ী শ্রমিক সাবির মল্লিককে গোরক্ষকদের পিটিয়ে হত্যা করার ঘটনা অার. জি. কর নিয়ে হই-হট্টগোলের মধে্যও চাপা পড়ে যায়নি। কুস্তিগির ভিনেশ ফোগতের ভোটে জয়-পরাজয় নারী নির্যাতনের ঘটনার ক্ষেত্রে বিজেপির দ্বিচারিতাকে স্পষ্ট করবে। পাঞ্জাব-হরিয়ানার কৃষক অান্দোলনকে বরাবর সমর্থন জানিয়ে এসেছেন মমতা বন্দে্যাপাধ্যায়। হরিয়ানার মানুষের রায় এই কৃষক অান্দোলনের ভবিষ্যতকে নির্ধারিত করবে।
বিধানসভা ভোটের মধে্য হরিয়ানায় ১৭৪ কিলোমিটার ব্যবধানে গোরক্ষকদের তাণ্ডবে দু’-দু’টি তরতাজা প্রাণ চলে যাওয়া কোনওক্রমেই ছোট ঘটনা নয়। নরেন্দ্র মোদির প্রধানমন্ত্রিত্বকালে গত দশ বছরে ‘গোরক্ষক’ ও ‘গণপটুনি’ শব্দ দু’টি সমার্থক হয়ে গিয়েছে। বিশেষ করে হরিয়ানায় গণপিটুনির ঘটনা মানেই গোরক্ষকদের তাণ্ডব সামনে এসেছে। ২০১৫ সালে হরিয়ানার তৎকালীন বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী মনোহরলাল খট্টর অাইন করে জেলাস্তরে গোরক্ষক বাহিনী নিয়োগের অনুমতি দিয়ে দেন। গত ন’বছরে এই গোরক্ষক বাহিনীর ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে, এদের দ্বারা গোপাচারকারী বা গোমাংস ভক্ষণকারী সন্দেহে কারও প্রাণ কেড়ে নেওয়া একেবারে জলভাত হয়ে গিয়েছে।
দক্ষিণ ২৪ পরগনার বাসন্তীর যুবক সাবির মল্লিকের প্রাণ কাড়া হয়েছে স্রেফ সন্দেহের বশে। অবশ্য এক্ষেত্রে সন্দেহের বশে কথাটাও প্রয়োগ করা যায় কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। হয়তো গোমাংসভক্ষণকারী গুজব ছড়িয়ে সচেতনভাবেই গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়েছে সাবিরকে। চরখি-দাদরি থেকে কিছুটা দূরে রাজধানী দিল্লির অদূরে গরুপাচারকারী সন্দেহে যে যুবককে গুলি করে গোরক্ষকবাহিনী হত্যা করেছে, সে দ্বাদশ শ্রেণির পড়ুয়া। গরুপাচারের সঙ্গে তঁার কোনও সম্পর্কই নেই। বন্ধুদের সঙ্গে গাড়ি নিয়ে ঘুরতে বেরিয়ে সে গোরক্ষকদের শিকার হয়ে যায়। ভোটের মেরুকরণ ঘটানোর জন্যই যে, এই ঘটনাগুলি সংঘটিত হয়েছে, তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। তবে দ্বিতীয় ঘটনাটির ক্ষেত্রে অাত্মঘাতী গোল হয়ে গিয়েছে। অারিয়ান মিশ্র নামে ওই পড়ুয়া ব্রাহ্মণ সন্তান। ‘অারিয়ান’ নামটি দেখে স্বঘোষিত গোরক্ষকরা ভুল করে ফেলেছে। সংবাদমাধ্যমে অারিয়ানের বাবা যে কথাটি বলেছেন, তা খুবই মর্মস্পর্শী। তিনি জানতে চেয়েছেন, মুসলিম হলেই কি খুন করা যায়? হরিয়ানার ভোটের ফলে অারিয়ানের বাবার এই প্রশ্নটির উত্তর মিলবে।
জাতের অঙ্কে বেসামাল বিজেপি হরিয়ানায় যে কোনও মূলে্য হিন্দু ভোট এককাট্টা করতে মরিয়া। তাই গোরক্ষকদের তাণ্ডব থেকে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন, প্রচার শুরুর অাগে শাণ দেওয়া হচ্ছে সব হাতিয়ারে। হরিয়ানায় জাঠ ভোট ২২ শতাংশ। জাঠরা কৃষি বিলের সময় থেকে বিজেপির বিরুদ্ধে। রাজে্যর ২০ শতাংশ তফসিলি সম্প্রদায়ের ভোটও জাঠদের মতো কংগ্রেসের দিকে ঝুঁকে। ৩৫ শতাংশ ওবিসি ভোট কবজা করতে বিজেপি মুখ্যমন্ত্রীর পরিবর্তন করেছে সম্প্রতি। মনোহরলাল খট্টরের জায়গায় এসেছেন ওবিসি নেতা নায়েব সিং সাইনি। হিন্দুত্বকে অস্ত্র করে জাঠ ও তফসিলি সম্প্রদায়ের ভোটের একটি বড় অংশ কি বিজেপি নিজেদের দিকে অানতে পারবে? এই প্রশ্নের উত্তরের মধে্য হরিয়ানার ভোটের ফল কী হবে, তার জবাবও লুকিয়ে রয়েছে।
অলিম্পিকে সদ্য পদক খোয়ানো ভিনেশ ফোগতকে প্রার্থী করে কংগ্রেস মাস্টারস্ট্রোক দিয়েছে। অলিম্পিকে ভিনেশের প্রতি অবিচার হয়েছে, এই আবেগ হরিয়ানাবাসীর মধে্য রয়েছে। ফলে সহানুভূতির হাওয়া মিলতে পারে। কুস্তি ফেডারেশনের প্রাক্তন সভাপতি ব্রিজভূষণ শরণ সিংয়ের বিরুদ্ধে ভিনেশদের লড়াই সার্বিকভাবে অনেক বড় ইসু্য। মহিলা কুস্তিগিরদের উপর যৌন নির্যাতনের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পরেও ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ করতে মোদিরা নারাজ। কেন নারাজ, তার কোনও সদুত্তর গত একবছর ধরে নেই। ভিনেশ প্রার্থী হওয়ার পরেও ব্রিজভূষণ কটাক্ষ করতে ছাড়েননি। ভোটের জন্য তঁাকে বিজেপি সভাপতি অাপাতত চুপ থাকতে বলেছেন বলে খবর। তবে ভোটে ভিনেশের এবং সামগ্রিকভাবে কংগ্রেসের জয় হলে যে, সেটা বিজেপির একটা বড় ধাক্কা হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অার. জি. কর নিয়ে বিজেপির অান্দোলন গড়ার চেষ্টাও সেক্ষেত্রে প্রশ্নের মুখে পড়ে যাবে।
কৃষক অান্দোলনের পর পাঞ্জাবের ভোটে বিজেপির ভরাডুবি হয়েছে। কৃষক অান্দোলনের জের রয়েছে লোকসভার ভোটের ফলেও। হরিয়ানার ফল বিরুদ্ধে গেলে কৃষক সমাজের অাস্থা অারও একটু কমবে মোদির প্রতি। পাঞ্জাব-হরিয়ানার সীমান্তে কৃষকদের বিরুদ্ধে কার্যত যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল বিজেপির সরকার। গণ অান্দোলনের উপর দমন-পীড়নের পরিণতি কী হতে পারে, হরিয়ানার ভোটের ফল থেকে সেই প্রশ্নের উত্তরও অারও একবার মিলবে।
অাসলে ছোট রাজ্য হলেও হরিয়ানার ভোট এসব কারণের জন্য বিপুল রাজনৈতিক গুরুত্ব পয়ে গিয়েছে। হরিয়ানার ফল জাতীয় রাজনীতিতে নতুন মোড়ও অানতে পারে। দীর্ঘ লোকসভা ভোটপর্ব মেটার পর এবার দেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডল মোটেও শান্ত হয়নি। রাজে্য রাজে্য গণ অান্দোলনের পটভূমি তৈরি হচ্ছে। হরিয়ানার পরই ভোট মহারাষ্ট্র, ঝাড়খণ্ড ও দিল্লিতে। এই রাজ্যগুলির ভোটের প্রচারেও লম্বা ছায়া ফেলবে হরিয়ানার ফল। সবমিলিয়ে অাগামী কয়েক মাসে মোদির ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী দেশের রাজনীতিতে কোনও ভূমিকম্প ঘটে কি না, এখন সেটাই দেখার।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.