Advertisement
Advertisement

প্রকাশ্যে স্তন্যদানের অধিকার ও স্বাধীনতা

আমাদের দেশে যে সংস্কৃতি একটি মেয়েকে জ্ঞান হওয়া অবধি লজ্জা পেতে শেখায়, সেখান থেকে আর কী-ই বা আশা করা যায়? অতএব স্তন নিয়ে যে আমাদের লজ্জার সীমা থাকবে না, এ আর নতুন কথা কী? সবার মাঝে যখন শিশু কেঁদে ওঠে খিদেয়, তখন এই একপাহাড় লজ্জা নিয়েই তাকে স্তন্যদান করতে বসে তার মা৷

Right of Breastfeed in public and freedom
Published by: Sangbad Pratidin Digital
  • Posted:August 4, 2016 6:36 pm
  • Updated:August 4, 2016 6:36 pm  

চৈতি মিত্র: প্রকাশ্য স্তন্যদান নিয়ে বিতর্ক অবশ্যই নতুন নয়৷ ব্রাজিলের এই মহিলা সাংসদই প্রথম ক্ষমতাসীন মহিলা নন যিনি স্তন্যদান নিয়ে ট্যাবুর প্রতীকী প্রতিবাদ করেছেন৷ কিন্তু আমাদের দেশে যে সংস্কৃতি একটি মেয়েকে জ্ঞান হওয়া অবধি লজ্জা পেতে শেখায়, সেখান থেকে আর কী-ই বা আশা করা যায়? অতএব স্তন নিয়ে যে আমাদের লজ্জার সীমা থাকবে না, এ আর নতুন কথা কী? সবার মাঝে যখন শিশু কেঁদে ওঠে খিদেয়, তখন এই একপাহাড় লজ্জা নিয়েই তাকে স্তন্যদান করতে বসে তার মা৷ 

ব্রাজিলের রিও ডি জেনেইরো এখন আসন্ন ওলিম্পিকের কল্যাণে নিত্য সংবাদপত্রের শিরোনামে৷ বিশ্বের বৃহত্তম ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করা কি চাট্টিখানি কথা! বহু অর্থব্যয়, আয়োজন, আড়ম্বর লুকিয়ে থাকে এর সাফল্যের পিছনে৷ সুতরাং ব্রাজিল এখন লোকের মুখে-মুখে, সেখানকার আবহাওয়া, সংস্কৃতি, খাবারদাবার, মানুষজন, পালাপার্বণ, রিওর ওলিম্পিক স্টেডিয়াম, দিল্লির সঙ্গে তার ঘড়ির তফাত, মায় রিও শহরটাকে সযত্নে ডানা মেলে আগলে রাখা যিশুখ্রিস্টের ৩০ মিটার উঁচু মূর্তিও সবাই মহা উৎসাহে ‘ফলো’ করছে৷ কিন্তু আজ আমরা ফোকাস করব এক অন্য ব্রাজিলে৷

Advertisement

দিন দশেক আগে ব্রাজিল সম্পূর্ণ অন্য একটি কারণে খবর হয়ে উঠেছিল৷ অনেকেরই চোখে পড়েছে খবরটি, মানে ছবিটি৷ সংবাদপত্রের ভিতরের পাতায় ছাপা ছবিটি এক ব্রাজিলীয় মহিলা সাংসদের, পার্লামেণ্ট অধিবেশন চলাকালীন জাতীয় বিতর্কে অংশগ্রহণ করছেন, আর তাঁর বক্ষলগ্ন শিশুকন্যাটি তাঁর স্তন্যপান করছে পরম তৃপ্তিতে৷ ছবিটি দেখে, বা বলা ভাল উন্মুক্ত নারীবক্ষ দেখে, অনেকে অভ্যাসবশত চোখ সরিয়ে নিয়েছেন, আবার অনেকে অপ্রত্যাশিত এই সুযোগে বার বার পাতা উল্টে ফিরে গিয়েছেন ছবিটিতে৷ যাঁরা আরেকটু গভীরে যেতে অভ্যস্ত, তাঁরা বিষয়টি (ছবিটি নয়) নিয়ে আলোচনা করেছেন, তর্ক-বিতর্ক করেছেন, মত প্রকাশ করেছেন প্রকাশ্য স্তন্যদানের পক্ষে বা বিপক্ষে৷ ব্রাজিলীয় সাংসদ তাঁর সাহসিকতার জন্য সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রশংসিত হয়েছেন, নিন্দিতও৷ কেউ কেউ তাঁর আচরণকে উগ্র নারীবাদের সস্তা চমক বলে তাচ্ছিল্য করেছেন, কেউ আবার বাহবা দিয়েছেন নারী স্বাধীনতার প্রতীকী ভঙ্গিমা বলে৷ এবং প্রায়শই নারীদেহ বা নারী-স্বাধীনতা বিষয়ক আলোচনা যেখানে গিয়ে শেষ হয়, এই বিতর্ক সেই প্রশ্নে গিয়ে পৌঁছেছে–মেয়েদের (এই ক্ষেত্রে মায়েদের) নিজস্ব মত ও পছন্দ অনুযায়ী চলার অধিকারের প্রশ্নে৷ একজন মা তাঁর সন্তানকে কখন, কোথায়, কোন অবস্থায় স্তন্য দেবেন বা দেবেন না, তা নির্ধারণ করার অধিকার সমাজ তাকে আদৌ দিয়েছে কি না–এই প্রশ্ন অবধারিতভাবে উঠে এসেছে এই বিতর্কের হাত ধরে৷

প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় যে, ব্রাজিল বিশ্বের কিছু অতি অল্প সংখ্যক দেশের মধ্যে পড়ে যেখানে স্তন্যদানকে খুব প্রচ্ছন্নভাবে উৎসাহ দেওয়া হয়৷ মাতৃদুগ্ধের উপকারিতা ও কৃত্রিম বা ‘ফর্মুলা’ শিশু পানীয়ের অপকারিতা সম্পর্কে বেশ সুস্পষ্ট ও জোরালো ক্যাম্পেন অনেক বছর ধরেই সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় চলে আসছে এই দেশে৷ ফলস্বরূপ প্রায় পঞ্চাশ শতাংশের বেশি ব্রাজিলীয় মা শিশুর জন্মের পর ছয় মাস অবধি তাদের কেবলমাত্র মাতৃদুগ্ধই পান করান৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই সংখ্যাটা মাত্র ষোলো শতাংশ৷ স্বাস্থ্যের কারণে যে মায়েরা স্তন্যদানে অপরাগ, তাঁদের শিশুদের জন্য গড়ে তোলা হয়েছে দুই শতাধিক ‘দুধ ব্যাঙ্ক’–ইচ্ছুক দাতা-মায়েদের পাম্প করে রাখা দুধ সংগৃহীত করা থাকে এই ব্যাঙ্কে৷ ফর্মুলা ফুড বা ইন্সট্যাণ্ট দুধের বিজ্ঞাপন ব্রাজিলে নিষিদ্ধ বেশ কিছুদিন ধরেই৷ সম্প্রতি প্রকাশ্য স্তন্যদানে উৎসাহ দিতে সাও পাওলো পুরসভা অর্ডিন্যান্স জারি করেছে যে যদি কোনও ব্যবসায়িক বা কর্ম-প্রতিষ্ঠান কোনও মহিলাকে প্রকাশ্য স্তন্যদানে নিরুৎসাহ করার চেষ্টা করে, বা বাধা দেয় তবে তাদের জরিমানা হবে৷

এই সিদ্ধান্তের পিছনে অবশ্য প্রতিবাদের এক লম্বা ইতিহাস আছে৷ বহুবার, বহু শপিং মলে, রেস্তোরাঁয়, পার্কে স্তন্যদানরত বা স্তন্যদানে ইচ্ছুক মায়েদের বাধা পাওয়ার, অপমানিত হওয়ার ইতিহাস৷ যে অপমানের প্রতীকী প্রতিবাদ স্বরূপ চল্লিশ জন মা একসঙ্গে প্রকাশ্যে তাঁদের শিশুদের স্তন্য দেন সাও পাওলোর মিউজিয়ম অফ ইমেজ অ্যান্ড সাউন্ড-এ, যখন এক জনপ্রিয় মডেল সেখানে তাঁর সাত মাসের শিশুকে স্তন্যদান করতে গিয়ে মিউজিয়াম রক্ষীর কাছে অপমানিত হন৷

প্রকাশ্য স্তন্যদান নিয়ে বিতর্ক অবশ্যই নতুন নয়৷ বা ব্রাজিলের এই মহিলা সাংসদই প্রথম ক্ষমতাসীন মহিলা নন যিনি স্তন্যদান নিয়ে ট্যাবুর প্রতীকী প্রতিবাদ করেছেন নিজের কাজের জায়গায়, পুরুষ সহকর্মীদের মধ্যে বসে, তাঁর শিশুটিকে স্তন্যদান করে৷ বছরখানেক আগে, লাতিন আমেরিকারই আরেকটি দেশ, আর্জেণ্টিনায়, শোরগোল পড়ে যায় যখন সেখানকার সাংসদ ভিক্টোরিয়া ডোনডা পেরেজ জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে যোগদান করাকালীন তাঁর আট মাসের শিশুকন্যাটিকে স্তন্যদান করেন৷ অতি দ্রূততার সঙ্গে তাঁর ছবি বৈদ্যুতিন দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে, অর্থাত্‍ ‘ভাইরাল’ হয়ে যায়৷ এবং অচিরেই পেরেজ হয়ে ওঠেন আদর্শ, কর্মরতা নারীর রোল মডেল, যিনি তাঁর মাতৃসত্তা আর কর্মজগৎকে সমান গুরুত্ব দেন৷

নারী আন্দোলনের একটি সুস্পষ্ট বা প্রচ্ছন্ন ধাপ যদি হয় স্তন্যদানের স্বাধীনতা, তারই একটি অনুসারী ধাপ তবে প্রকাশ্য স্তন্যদানের অধিকার৷ আর সেই অধিকারের দাবিকে আরও জোরদার করতে সোশ্যাল মিডিয়াতে গড়ে উঠেছে এক আন্দোলন, যার পোশাকি নাম ‘ব্রেলফি’৷ প্রকাশ্যে স্তন্যদানরত মহিলারা নিজস্বী তুলে পোস্ট করছেন যাতে ভেঙে ফেলা যায় স্তন্যদানের সঙ্গে জড়িত সব সামাজিক জড়তা বা ট্যাবু৷ এই ‘ব্রেলফি’ আন্দোলন প্রতিষ্ঠা করতে চায় কয়েকটি অতি সাধারণ তথ্য, যেমন স্তন্যদান একটি স্বাভাবিক, প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া, এর সঙ্গে কোনও লজ্জা বা অপমান জড়িত নেই, জড়িয়ে নেই কোনও শ্লীলতা-অশ্লীলতার প্রশ্নও৷ স্তন্যদান কোনও কামোত্তেজক আচরণও নয়৷ এটি একটি শিশুর ক্ষুন্নিবৃত্তি ও প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহের প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে মা ও সন্তানের একটা অনিবার্য আত্মীয়তা গড়ে ওঠে৷

আবার এই ব্রেলফি আন্দোলনেরও একটা প্রতি-আন্দোলন গড়ে উঠেছে স্বাভাবিক নিয়মেই৷ ব্রেলফির সমালোচকদের মতে এক্ষেত্রেও একটা স্বাধীনতা বা অধিকারের প্রশ্ন থেকেই যায়৷ একজন মায়ের যেমন স্তন্যদানের (প্রকাশ্যে বা আড়ালে) অধিকার আছে, তেমনই স্তন্যদান না করারও অধিকার আছে৷ কোনও মা শারীরিক বা অন্য কোনও কারণে সিদ্ধান্ত নিতেই পারেন যে তিনি তাঁর শিশুসন্তানকে বোতলের দুধ দেবেন, স্তন্য নয়৷ ব্রেলফি আন্দোলন পরোক্ষভাবে সেই মায়েদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে ও তাঁদের লজ্জিত করে, যাঁরা তাঁদের শিশুদের স্তন্যপান করাতে পারছেন না, বা চাইছেন না৷ এই সূত্রে গঠিত হয়েছে আরেকটি নতুন শব্দ ‘ব্রেশার’–দ্য প্রেশার টু ব্রেস্টফিড৷ স্তন্যদাত্রী মায়েদের চাপে ‘অন্য’ মায়েরা এবার হীনমন্যতায় ভুগছেন, মনে করছেন মাতৃত্বের পরীক্ষায় তাঁরা ব্যর্থ৷ সুতরাং ঘুরে ফিরে আবার সেই নিজস্ব পছন্দের কথা চলে আসছে, যা কি না নারী আন্দোলনের অন্যতম মূল কথা৷

আবার প্রথম ছবিটিতে ফিরে আসি৷ সব ছবিই কিছু বার্তা বহন করে, এই ছবিটিও তার ব্যতিক্রম নয়৷ একথা স্বীকার করতেই হবে যে এমন ‘খোলামেলা’ ছবি দেখতে আমাদের মধ্যবিত্ত ভারতীয় চোখ অভ্যস্ত নয়৷ প্রথমেই তাই একটা চমক লাগে৷ এত ব্যক্তিগত একটা আচরণ এত প্রকাশ্যে? চমকটা কেটে যেতে যা আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তা হল মহিলার সংকোচহীনতা৷ ও স্বাভাবিকতা৷ ওঁর শরীরী ভাষা কোথাও কোনও দ্বিধা, সংকোচ বা জড়তা–সেলফ কনশাসনেস প্রকাশ পায় না৷ একজন আধুনিক কর্মরতা মা, যিনি কাজ (এই ক্ষেত্রে পার্লামেণ্টে ডিবেট) করার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর শিশুকে খাওয়াচ্ছেন–এই নিতান্ত প্রয়োজনীয় মাল্টিটাস্কিং করার বাইরে আর কোনও কিছুই প্রকাশ পায় না তাঁর চোখেমুখে৷ কোনও জনবহুল স্থানে শিশুকে বোতলে দুধ দেওয়ার মতোই স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত তাঁর এই প্রকাশ্য স্তন্যদান৷

আধুনিক, অগ্রসর প্রথম বিশ্ব থেকে সরে এসে চোখ রাখি আমার চারপাশে, আমার পিছিয়ে পড়া, পিছিয়ে থাকা, অথচ প্রাণপণে এগোতে চাওয়া ভারতে৷ সেখানে ছবিটা কি খুব আলাদা? উত্তরটা জটিল এবং আয়রনিক্যাল– হ্যাঁ এবং না৷ হ্যাঁ–আমার দেশে প্রকাশ্য স্তন্যদানের দৃশ্য বিরল নয়, হামেশাই দেখা যায় মা তাঁর কোলের শিশুকে একহাট লোকের মাঝে স্তন্যদান করছেন৷

না–কারণ আমার দেশে প্রকাশ্য স্তন্যদান কোনও নারীবাদী, প্রগতিবাদী, আধুনিক, প্রতীকী প্রতিবাদ নয়৷ নয় কোনও অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি৷ কারণ এখানে কোনও চয়েস, কোনও বেছে নেওয়ার প্রশ্ন নেই৷ এখানে যাঁরা প্রকাশ্যে স্তন্যদান করেন তাঁরা বাধ্য হয়েই করেন৷ কারণ মহিলা হওয়ার সুবাদে রাস্তা-ঘাটে ও পাবলিক প্লেসে যে ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার কথা–সুরক্ষিত ও পরিচ্ছন্ন বিশ্রামকক্ষ ও শৌচালয় বা শিশুকে পরিষ্কার করার ও খাওয়ানোর নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর ঘর–তা আজও অধরা৷ তথাকথিত আধুনিক শহরের ঝাঁ চকচকে শপিং মলে লেডিজ রেস্টরুম এখন প্রচুর, কিন্তু নার্সিং স্টেশন? গালভরা নাম, কিন্তু ঢুকে দেখেছেন কখনও? সরু একচিলতে ঘর ও দেওয়াল আয়না–আর কিছু না৷ বসার জায়গা, বাচ্চাকে শোয়ানোর টেবিল, ব্যাগপত্র রাখার জায়গা–কিচছু না৷ শুধুই গালভরা তকমা–ভেতরটা বিশুদ্ধ দেশি৷ সুতরাং লম্বা সময়ের জন্য যখন মেয়েদের বাইরে থাকতে হয়–ট্রেনে বা বাসে, দোকানপাটে, কাজের জায়গায়–শিশুকে স্তন্যপান করানোর একমাত্র উপায় আঁচল বা দোপাট্টার আড়াল৷ আর তার উপরি পাওনা একরাশ লজ্জার বোঝা৷

অবশ্য যে সংস্কৃতি লজ্জাকে নারীর শ্রেষ্ঠ ভূষণ বলে আখ্যা দিয়েছে, যে সংস্কৃতি একটি মেয়েকে জ্ঞান হওয়া অবধি লজ্জা পেতে, শুধুই লজ্জা পেতে শেখায়, তার কাছ থেকে আর কী-ই বা আশা করা যায়? আমাদের বেড়ে ওঠা, বড় হয়ে ওঠা, বা বলা ভাল মেয়ে হয়ে ওঠার পুরো প্রসেসটাই, যাকে বলে, লজ্জাবনত৷ আমাদের প্রাণ খুলে হাসাটা লজ্জার, খেলাধুলোর ন্যাক থাকাটা লজ্জার, পছন্দসই পোশাক পরতে চাওয়া লজ্জার, খিদে পেলে সেটা প্রকাশ করাটা লজ্জার, আরও বেশি লজ্জার বাথরুম পাওয়া, আমাদের রজোদর্শন, লজ্জার, শরীরোদগমও৷ অতএব স্তন নিয়ে যে আমাদের লজ্জার সীমা থাকবে না, এ আর নতুন কথা কী? সবার মাঝে যখন তার শিশু কেঁদে ওঠে খিদেয়, তখন এই একপাহাড় লজ্জা নিয়েই তাকে স্তন্যদান করতে বসে তার মা–গ্রাম্য, দেহাতী, অনপড় মা, অথবা শহুরে, শিক্ষিত, আধুনিক মাম্মা, দু’জনকেই এখনও আড়াল খুঁজতে হয়৷ প্রথম জনকে লুকোতে হয় লোভী পুরুষদৃষ্টি থেকে, যে দৃষ্টিতে নারীদেহ মানেই ভোগ্যবস্তু, তার ‘চোলি কে পিছে’ লুকনো বস্তু তো আরওই কামনার ধন৷ দ্বিতীয়জনকে লুকোতে হয় ভারতীয় সংস্কৃতিপুষ্ট সমাজের কাছ থেকে, যে সমাজের রুচিতে বাধে একান্ত ব্যক্তিগত ও অন্তরঙ্গ আদান-প্রদানের সাক্ষী হতে৷ তবে রুচিতে বাধে বলে কি আর তাকিয়ে দেখতে বাধে? অতএব স্তন্যদানরত লজ্জায় আড়ষ্ট মায়ের দিকে আড়ে-ঠারে বা সোজাসুজি তাকানো সব শ্রেণির পুরুষের মৌলিক অধিকার আর ভারতীয় নারীর দায় তাদের দৃষ্টিলেহন থেকে নিজেকে রক্ষা করা৷

বিষয়টা নিয়ে চর্চা করতে গিয়ে মনে পড়ে গেল রাজ কাপুরের ‘রাম তেরি গঙ্গা মইলি’ ছবির স্বাস্থ্যবতী নায়িকা মন্দাকিনীর ট্রেনের কামরায় প্রকাশ্য স্তন্যদানের দৃশ্য৷ পুরুষের লোলুপ দৃষ্টি অগ্রাহ্য করে নারীর অন্তর্নিহিত মাতৃসত্তার জয় হিসেবে এই দৃশ্যটি একটি মাইলফলক হতে পারত৷ কিন্তু তা হল না কারণ তার আগেই অতি-স্বচ্ছ, ফিনফিনে সাদা শাড়ি পরিয়ে রাজ কাপুর তাঁর নায়িকাকে জলপ্রপাতের তলায় অনেকক্ষণ ধরে স্নান করিয়েছেন, ক্যামেরার বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে বহু চোখ তাকে লেহন করেছে, উপভোগ করেছে৷ আর সেই মুহূর্তেই সে ভোগ্য বস্ত্ত বা সেক্স অবজেক্ট হিসেবে অবজেক্টিফাইড হয়ে গিয়েছে৷ স্তন্যপানের দৃশ্যটি সেই অবজেক্টিফিকেশন এরই কণ্টিনিউয়েশন৷

মহিলাদের বিষয়ে হিন্দি ছবির এই দ্বিবিভাজন৷ আজ আমার সমাজের ডায়কোটমি–বড় শহরের ছোট বৃত্তে, বিজ্ঞাপন ও মাল্টিপ্লেক্সের পর্দায় সে আধুনিকা খাটো পোশাক, প্রকাশ্যে ধূম ও মদ্যপান, দ্বিধাহীন, যৌনতা, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও ক্ষমতা ইত্যাদি তাকে মুক্ত ও স্বাধীন রূপে পেশ করে৷ আবার ওই ছোট ‘ইন্ডিয়ার’ আড়ালে যে বৃহত্‍ ‘ভারত’, সেখানে কেবলই আড়াল অন্দরে ঘোমটা ও বন্ধ দরজার আড়াল, বাইরে মাঠে প্রাতঃকৃত্য সারতে অন্ধকারের আড়াল, স্তন্যদানে অাঁচলের আড়াল৷ বলাই বাহুল্য এ হেন ভারতে বীরপুরুষদের ভারমুক্ত করতে কোনও আড়াল লাগে না৷ ওটা কেবল মেয়েদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য৷

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement