ফাইল ছবি।
প্রতিবাদের মঞ্চ? গণবিক্ষোভের পরিপ্রেক্ষিতে কী করে ব্যাখ্যা করা হবে সামাজিক মাধ্যমে ভূমিকাকে? মানুষ কি রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ কাটিয়ে সোশাল মিডিয়ায় পরস্পরের আগুনে ভাবনার শরিক হতে পারে? না কি মুক্তচিন্তার নাম করে বিভিন্ন অসহিষ্ণু মতের গোষ্ঠী জন-আন্দোলনকে গ্রাস করতে চায়? লিখলেন কিংশুক বন্দ্যোপাধ্যায়।
আর জি কর (RG Hospital) ইস্যুতে কলকাতায় চলতে থাকা গণ-বিক্ষোভের মূলে কেউ-কেউ সোশাল মিডিয়ার ভূমিকাও দেখছেন। তাঁদের মতে, ৯ আগস্ট ঘটনাটি জানাজানির পরে দাবানলের মতো তা ফেসবুক, এক্স, হোয়াটসঅ্যাপে ছড়িয়ে পড়েছিল। এর দু-একদিনের মধ্যে সোশাল মিডিয়ায়(Social Media) স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে (১৪ আগস্ট, রাত ১১টা ৫৫ মিনিট) মহিলাদের রাস্তায় নেমে ‘জাস্টিস ফর আর. জি. কর’ নামে প্রতিবাদ মিছিলের আহ্বান জানানো হয়। সামাজিক মাধ্যম ছেয়ে যায় ‘মেয়েরা রাত দখল করো,’ ‘দ্য নাইট ইজ আওয়ার্স’, ‘রিক্লেম দ্য নাইট’ নানা পোস্টারে।
যে-প্রশ্নটা ঘুরপাক খেতে শুরু করেছে তা হল, সত্যিই কি সোশাল মিডিয়া ‘তেমনই শক্তিমান’? না কি স্রেফ জনসংযোগের ডিজিটাল মঞ্চ? এখানে স্পষ্টতই দুরকমের মত। একদল যখন বলছে, সোশাল মিডিয়াই এই আন্দোলনের মূল অনুঘটক; তখন আরেক দল ফেসবুক, এক্স ও হোয়াটসঅ্যাপকে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বলে মনে করছে। তাদের মতে – রেডিও, টিভি, সংবাদপত্রও জনমত গঠনে যথেষ্ট শক্তিশালী। তাদের যুক্তি সোশাল মিডিয়া গণ-যোগাযোগের মাধ্যম মাত্র। প্রায়ই দেখা যায়, প্রথমে এক উদ্দেশ্য নিয়ে কথাবার্তা শুরু হয়, কিন্তু যে মুহূর্তে দেখা যায় প্রচুর মানুষ তাতে সাড়া দিচ্ছে, তখন বিভিন্ন মতের সম্মিলিত হট্টমেলা হয়ে যায়। বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহল তাদের স্বার্থসিদ্ধির চেষ্টা চালায়। ফলে, অভিমুখ হারিয়ে আন্দোলন তার যৌক্তিকতা হারিয়ে ফেলে। অনেক বিশেষজ্ঞ তো সোশাল মিডিয়ার সঙ্গে আন্দোলনের (Protest)সরাসরি যোগাযোগও মানতেও চায় না।
আরব বসন্ত
ফেসবুকের (Facebook) মাধ্যমে আন্দোলনের কথা উঠলে – ২০১১ সালে দুনিয়া কাঁপানো ‘আরব বসন্ত’র কথা বলতেই হয়। যে আন্দোলনের নেপথ্যে সোশাল মিডিয়া অনুঘটকের কাজ করেছিল বলে ভীষণভাবে মনে করা হয়। এর গৌরচন্দ্রিকা উত্তর মিশরের (Egypt) প্রাচীন বন্দর শহর আলেকজান্দ্রিয়ায়। ২০১০ সালের জুন মাসে আলেকজান্দ্রিয়ায় বছর ২৬-এর খালেদ মহম্মদ সইদ স্থানীয় পুলিশের মাদক-সংক্রান্ত দুর্নীতি ফাঁস করেন। পরিণতি হল ভয়ংকর। মুবারকের ‘সিক্রেট সার্ভিস’ শহরের এক সাইবার ক্যাফের বাইরে খালেদকে খুন করে রাস্তায় ফেলে রেখে যায়। গুগলের মিশরীয় প্রযুক্তিবিদ ওয়েল ঘোনিম এই হত্যাকাণ্ডর প্রতিবাদে ‘উই আর অল খালেদ সইদ’ নামে ‘ফেসবুক পেজ’ খোলেন। দেখা যায়, লাখ ছয়েক মানুষ সেই পেজ দেখেছে। খালেদের অত্যাচারিত ছবি ইন্টারনেটে ‘ভাইরাল’ (Viral) হয়। পশ্চিমি সংবাদমাধ্যমও আঁচ পেতে শুরু করে যে, খালেদের শোচনীয় মৃত্যু নিছক এক খুন নয়, পুঞ্জীভূত রাগও কোথাও জমা হচ্ছে। যা সত্যি-সত্যি পরের বছরই অগ্ন্যুৎপাত করে। এই সময় ঘোনিম এক্স হ্যান্ডেলে (তখন টুইটার) লিখেছিলেন– ‘আরব দুনিয়ায় ইন্টারনেটই একমাত্র মুক্ত মিডিয়া। কেউ একে নিয়ন্ত্রণ করে না।’
মিশর যখন বারুদের উপর দাঁড়িয়ে, ঠিক তখন তিউনিশিয়ায় (Tunisia) ঘটল আরেকটা ঘটনা। ২০১০ সালের ২০ ডিসেম্বর মধ্য-তিউনিশিয়ার সিদি বউজিদ শহরে পুলিশি জুলুমের প্রতিবাদ করে মহম্মদ বউয়াজিজি নামে বছর ২৬-এর এক ফলবিক্রেতা গভর্নর ভবনের সামনেই আত্মাহুতি দেন। এর পরে তিউনিশিয়ার সোশাল মিডিয়ায় বউয়াজিজিকে নিয়ে লেখা শুরু হল। নিহত বউয়াজিজির স্মরণে ‘ফেসবুক পেজ’ হল। সরকার পেজ ব্লক করার চেষ্টা করলে হিতে-বিপরীত ঘটে। সিদি বউজিদের সীমানা ছাপিয়ে রেশ এসে পড়ল তিউনিশিয়ার রাজধানী তিউনিসে। দলে-দলে শহরের দরিদ্র মানুষ, যারা দেশের ডিক্টেটর বেন আলির শাসনে তিতিবিরক্ত, তারা রাস্তায় নামল। আন্দোলন থামাতে নির্বিচারে গুলি চলল। দেখা গেল, ১৪৭ জন নিহত, শ’পাঁচেক আহত। মানুষের ধৈর্যের বাঁধ আরও ভাঙল, মর্গে যেভাবে মৃতদেহগুলি ফেলে রাখা হয়েছে তা দেখে।
অবস্থা বেগতিক দেখে বেন আলি ১৪ জানুয়ারি দেশ ছেড়ে পালালেন। শুরু হল ‘আরব বসন্ত’-র বিজয়াভিযান। ডেনিস জি. ক্যাম্বেল তাঁর ‘ইজিপ্ট আনশ্যাকল্ড: ইউজিং সোশ্যাল মিডিয়া টু @#:) দ্য সিস্টেম – হাউ ওয়ান ফর্টি ক্যারেক্টরস ক্যান রিমুভ আ ডিক্টেটর ইন এইট্টিন ডেজ’ বইতে লিখছেন, ‘বেন আলির পতনের পরে মহম্মদ বউয়াজিজির আত্মবলিদানকে পুরো আরব দুনিয়া কুর্নিশ জানাতে থাকে। তার পরই দুই পড়শি আলজেরিয়া আর লিবিয়া থেকে পশ্চিম এশিয়ার বাহরিন, সিরিয়া, ইরাক, ইরান, সৌদি আরব আর ইরানে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। এদিকে, মিশর তখন বারুদের উপরে। ১৮ জানুয়ারি আলেকজান্দ্রিয়াতে আহমেদ হাসেম গায়ে তেল ঢেলে আত্মহনন করেন। আসল বিপ্লবের আগুন জ্বলে উঠল তাহরির স্কোয়্যারে।’
২০১১ সালের ২৪ জানুয়ারি মধ্যরাতে হাজারে-হাজারে বিক্ষুদ্ধ জনতার মিছিল চলল পশ্চিম কায়রোর নীল নদের কাসর এল-নীল সেতু পেরিয়ে, পূর্ব কায়রোর মহম্মদ মাহমুদ স্ট্রিট দিয়ে। গন্তব্যস্থান মিশরীয় রাজধানীর কেন্দ্রস্থলে তাহরির স্কোয়্যার (‘লিবারেশন স্কোয়্যার’)। তাহরির স্কোয়্যারে এসেই মহামিছিল যে শেষ হয়ে গেল, তা নয়। ২৫ জানুয়ারি ও পরের ১৭ দিন সারা মিশরের পথ এসে মিশেছিল তাহরির স্কোয়্যারে। কয়েক হাজারের জনসমাবেশ ক্রমশ দশ লক্ষাধিক জনসমুদ্রে পরিণত হয়। এই জনবিদ্রোহ দমন করতে ব্যর্থ মোবারক পদত্যাগ করেন। ঘোনিম পরে একটি সাক্ষাৎকারে খালেদ সইদ নিয়ে তাঁর ফেসবুক পেজ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘সত্যি বলতে কী, ফেসবুক পেজটা যে এতটা কাজ দেবে ভাবিইনি। কিছু করতে হবে এই ভাবনা থেকে এটা করা। তিনদিনে লক্ষাধিক মানুষ পেজটা লাইক করল। তখন তিউনিশিয়া উথালপাথাল। তাই পরবর্তী কয়েক মাস তিউনিশিয়ার খবর জানাচ্ছিলাম। ২৮ দিনের আন্দোলনে তিউনিশিয়ার সরকারের পতন হল। তখন ভাবলাম তাহলে মিশরেও তো এটা হতে পারে। লিখলাম সবাইকে – রাস্তায় নামতে। বললাম, দশদিনে হোসনি মুবারক সরকারকে ফেলতে হবে।’
এই জনআন্দোলন শুরু করতে, বজায় রাখতে সোশাল মিডিয়া কীরকম প্রভাব ফেলেছিল, তা ২০১১-তে কায়রোতে থাকা ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এর সাংবাদিক ডেভিড ডি. কার্কপ্যাট্রিকের লেখাতেও স্পষ্ট। রিপোর্টার হিসাবে ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এ তাঁর বিভিন্ন প্রতিবেদন-সহ এই ‘আরব বসন্ত’ নিয়ে ২০১৮ সালে প্রকাশিত ‘ইনটু দ্য হ্যান্ডস অফ দ্য সোলজার্স’ বইয়ে কার্কপ্যাট্রিক অকপটে লিখেছেন – খবরের মূল ‘সোর্স’ ছিল আন্দোলনকারীদের ফেসবুক পেজ। কোথায়-কখন-কী হচ্ছে, কোথায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে জমায়েত ভাঙতে আসা ফোর্সের সংঘর্ষ হচ্ছে – আসলে ফেসবুক থেকেই মূলত এসব খুঁটিনাটি জানতে পারতেন তিনি।
সত্যিই কার্যকর?
যদিও অনেকে সোশাল মিডিয়ার ভূমিকাকে যোগাযোগের মাধ্যম ছাড়া আর কিছু বলে ভাবে না। আদিল এ. শাহ এবং শেহরিয়ার টি. সর্দার তাঁদের ‘স্যান্ডস্টর্ম: আ লিডারলেস রেভোলিউশন ইন দ্য ডিজিটাল এজ’ বইতে দেখিয়েছেন, শুধু সামাজিক মাধ্যমই ‘আরব বসন্ত’র অনুঘটক নয়। ২০০৮ সালে যখন ফেসবুক বিস্তার লাভ করছে, তখন মিশরের তরুণ প্রজন্মকে ভয়াবহ বেকারত্ব গ্রাস করেছিল। ৮৩ শতাংশ বেকারের গড়-বয়স ২৪। জিনিসপত্রর দাম আকাশছোঁয়া। শেয়ার বাজার হু-হু করে পড়ছে। ২০০৮ সালের গ্রীষ্মে যেখানে কায়রো ও আলেকজান্দ্রিয়ায় শেয়ার বাজারের সূচক ছিল ৮৪৪৯.৬, নভেম্বরে তা কমে দাঁড়ায় ১৫৫৬.৭। বিদেশি লগ্নিকারী সংস্থাগুলো একে-একে মুখ ঘোরাতে থাকে। পরের আঘাত পর্যটনের উপর। ইউরোপ থেকে আসা পর্যটকের সংখ্যা ৩০ শতাংশ কমে যায়। যেহেতু ১২ শতাংশ কর্মসংস্থান পর্যটনের সঙ্গে যুক্ত, তাই পর্যটনে ভাটার প্রভাব সরাসরি গিয়ে পড়ে কর্মসংস্থানে। অর্থাৎ, অর্থনীতির বেহাল দশায় জর্জরিত মিশর আগে থেকেই ধুঁকছিল। ফেসবুক বিক্ষোভকারীদের যোগাযোগ মাধ্যম ছিল মাত্র।
মার্ক জুকারবার্গ (Mark Zuckerberg) তো ‘আরব বসন্ত’র অনুঘটক হিসাবেও ‘ফেসবুক’কে মানতে নারাজ। তাঁর মতে, কোনও তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার পক্ষে এরকম দাবি করা বাড়াবাড়ি। তবে মানুষ যা বলতে চাইছে, সেটা বলতে পারা বেশ বড় ব্যাপার। দুনিয়ার যোগাযোগটা নিচের তলা থেকে করা যাচ্ছে। ‘২০১৫ সালে ডাইজেস্ট অফ মিডল ইস্ট স্টাডিজ’ পত্রিকায় ‘এক্সপ্লেনিং দ্য ইনটেনসিটি অফ আরব স্প্রিং’ নামে একটি গবেষণাপত্র লেখেন অর্থনীতিবিদ-দ্বয় চঙ্গুন ক্রিস্টি বুন এবং ইথান. জে. হোলান্ডার। সেখানে জুকারবার্গের তত্ত্বকেই মান্যতা দিয়ে লেখা হয়েছে – সোশাল মিডিয়ার সঙ্গে আন্দোলনের সরাসরি কোনও সংযোগ তাঁরা খুঁজে পাননি। বিশেষজ্ঞরা আরও বলেছেন – তিউনিশিয়া ও মিশর ছাড়া ‘আরব বসন্ত’ পাকাপাকিভাবে পশ্চিম এশিয়ার কোথাও ছাপ ফেলতে পারেনি। আবার, মিশর ও তিউনিশিয়ায় ফেসবুকের প্রভাব প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞরা এ-ও বলছেন, ওসব দেশে রেডিও, টিভি রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় সরকার যাই বলুক, সাধারণ জনগণের কাছে তার কোনও বিশ্বাসযোগ্যতা ছিল না। তারা বরং ফেসবুক এবং এক্স-কে (X handle) বেশি বিশ্বাসযোগ্য মনে করেছে। আরব দুনিয়ার অন্যত্র সরকারি প্রোপাগান্ডা আন্দোলনের ভাষ্যকে ছাপিয়ে যায়। ফলে বিপ্লব দানা বেঁধে ওঠার আগেই তা বিনষ্ট হয়েছিল।
ফেসবুকের আপাত-ব্যর্থতার প্রযুক্তিগত একটা ব্যাখ্যা অবশ্য ঘোনিম নিজেই দিয়েছেন। তাঁর চোখের সামনেই মিশরে আন্দোলনের রাশ ক্রমশ চলে গিয়েছিল ইসলামি চরমপন্থীদের হাতে। ফলে মিশরেও ‘আরব বসন্ত’ ক্ষণস্থায়ী ছিল। এ-নিয়ে ঘোনিমের ব্যাখ্যা, “ফেসবুক নিউজফিডের চরিত্রটা এমনই যে, ‘কনটেন্ট’ বেশি ‘লাইক’ পাবে, ‘শেয়ার’ হবে। ফলে কোনও বিশেষ গোষ্ঠী যখন তার বিরুদ্ধ-গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বলছে, তখন সেটা স্বাভাবিকভাবে তাদের পক্ষের মানুষ ‘লাইক’ ও ‘শেয়ার’ দিয়ে ভরিয়ে দেয়। এতে কিন্তু মুক্তচিন্তার নাম করে ফেসবুকে বিভিন্ন অসহিষ্ণু মতাবলম্বীদের গোষ্ঠীর বেড়ে ওঠার সুযোগ থাকছে – যার প্রভাব সরাসরি পড়ে বাস্তব আন্দোলনে।” তিনি আরও জানিয়েছিলেন যে, সেনাবাহিনীর সম্বন্ধে যেসব কথা বলেনইনি, সেসব কথা তাঁর মুখে ফেক পেজে বসানো হয়েছিল। পরিণামে, সেনাবাহিনীর জেরার মুখে পড়তে হয়েছিল তাঁকে। সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে সোশাল মিডিয়া যে বিপুল প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে – অস্বীকার করার উপায় নেই। আর, এই বিনিসুতোয় বাঁধা পড়েছে কলকাতা থেকে কায়রো, এক অবিমিশ্র পৃথিবী।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.