মশলা, মসলিন, জাহাজের কাছি, গান-পাউডারের হিসাব আর সনদের বিলিব্যবস্থা ছাড়া ভারতে যে আরও কিছু দেখার থাকতে পারে, তা জানতই না ইউরোপীয় সমাজ, যদি না থাকতেন কিছু ভারত-পাগল সাহেব, যঁাদের মধে্য অবশ্যই চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন উইলিয়াম ফ্রেজার! সৌজন্যে একটি অ্যালবাম। লিখলেন ঋত্বিক মল্লিক।
১৮১০ সাল। ভারতের নতুন ব্রিটিশ কমান্ডর-ইন-চিফের স্ত্রী বেড়াতে এলেন দিল্লিতে। সেবারে তিনি মোগল রাজদরবারের ব্রিটিশ রেসিডেন্ট ডেভিড ওক্টারলোনি-র অতিথি। ঘরে ঢুকেই অবশ্য অঁাতকে উঠতে হল তঁাকে। ওক্টারলোনি বসে আছেন রংদার কুর্তা-পাজামা আর পাগড়ি পরে, ইয়াব্বড় গোঁফ তঁার। সঙ্গে দুই শাগরেদ, তঁাদেরও পেল্লাই গোঁফ। কথায়-কথায় জানা গেল, গরু বা শুয়োরের মাংস খাওয়া একেবারেই ছেড়ে দিয়েছেন প্রতে্যকে। লেডি নাজেন্ট পরে লিখেছেন তঁার ডায়েরিতে, তিনজনকে আদৌ আর ‘খ্রিস্টান’ বলে বোঝা যায় না, পুরোপুরি ‘হিন্দু’ বনে গিয়েছেন সব। ওক্টারলোনি-র পাগলামি অবশ্য ছিল সর্বজনবিদিত। স্থানীয় বাসিন্দারা তাই ‘ওক্টারলোনি’ নামটাকে একটু ঘুরিয়ে ডাকত ‘লুনি আখতার’ (পাগল তারা) বলে। কিন্তু ক্রমশ দেখা গেল, ওক্টারলোনি-র চেয়েও রঙিন চরিত্র হয়ে দেখা দিচ্ছেন লেডি নাজেন্ট কর্তৃক উল্লিখিত ওক্টারলোনি-র দুই শাগরেদের একজন, তঁার নাম উইলিয়াম ফ্রেজার।
ফ্রেজার যখন ভারতে আসেন, তখন থেকেই এই তরুণের উড়ুউড়ু স্বভাব চোখে পড়েছিল অন্য ব্রিটিশ অফিশিয়ালদের। মশলা, মসলিন, জাহাজের কাছি, গান-পাউডারের হিসাব আর সনদের বিলিব্যবস্থা ছাড়া এই ম্যালেরিয়া আর পিলেজ্বরের দেশে যে আরও কিছু দেখার থাকতে পারে, সেটা ভেবে দেখার কথাও কখনও মাথায় আসেনি তঁাদের। ১৮০৫ সালে কলকাতা ছেড়ে যখন তিনি রওনা হলেন দিল্লির পথে, তখনও তঁাকে নিয়ে খুব একটা আশা রাখতেন না উচ্চপদস্থ আধিকারিকরা। সারাক্ষণ শিকার আর গ্রামগঞ্জে ঘুরে বেড়ানো ছাড়া এ-ছেলের আর কী-ই বা করার আছে, বুঝে পেতেন না কেউই। কিন্তু তঁারা তো আর জানতেন না, এই উইলিয়াম ফ্রেজারের ঠাকুরদা জেমস ফ্রেজারও ভারতফেরত এবং পাশ্চাত্য দুনিয়ায় নাদির শাহকে নিয়ে প্রথম ইতিহাসটি তঁারই লেখা!
ফ্রেজার কিন্তু দিল্লিতে এসে প্রমাণ করে দেখালেন, প্রাচ্যপ্রীতি যতই থাক, নিজের কাজটা তিনি জানেন ভালই। স্কটল্যান্ড থেকে তঁারা চার ভাই রওনা হয়েছিলেন বিদেশের বিভিন্ন পদে চাকরি নিয়ে। যদিও একজন ছাড়া কেউই আর শেষ পর্যন্ত দেশে ফিরতে পারেননি, তবু চার ভাই-ই বাবাকে চিঠি লিখতেন নিয়মিত। সে-সময় মোগল সাম্রাজ্যের গোধূলিলগ্ন, অঁাধার ঘনিয়ে আসছে অচিরেই। সন্ধেটুকু নামলেই হল, দিল্লির বিভিন্ন মকবারা আর বাগিচায় রাতের অন্ধকারে তখন ঠগি আর জোচ্চরদের লুটতরাজের সাম্রাজ্য।
ফ্রেজার সে-সময় চিঠিতে লিখছেন, দূর থেকে কাউকে ঘোড়া ছুটিয়ে আসতে দেখলেও অন্তত একশো গজ দূরে সরে যেতে হচ্ছে তঁাকে। কারণ, আগে থেকে কিছুই বলা যায় না, কোন ঘোড়সওয়ারের কী মতলব। চোরাগোপ্তা অস্ত্র চালিয়ে কে কখন যৎকিঞ্চিৎ টাকা লুটে নেওয়ার ফন্দি এঁটে নেবে, সে-বিষয়ে বিশ্বাস করা যাচ্ছে না কাউকেই। দিল্লির একপ্রান্ত থেকে আর-এক প্রান্ত তখন ছুটে বেড়াচ্ছেন ফ্রেজার, সেইসঙ্গে ছুটছে তঁার ব্যক্তিগত পরিচারকের দল। এমনকী, রাতে ঘুমনোর সময়েও তঁাকে গোল করে ঘিরেই নিজের বিছানাটুকু কোনওক্রমে পেতে নিচ্ছে তারা। নৈরাজ্য আর অপরাধের এমনই মাত্রাছাড়া বাড়াবাড়ি। তবে, ফ্রেজার যে শুধু গুলি আর বন্দুকেই ডুবেছিলেন এ-সময়টায়, তেমনটা ভাবলে যথেষ্ট ভুল হবে। শুধু দিল্লি নয়, দিল্লিবাসিনীদের প্রতিও ফ্রেজারের আগ্রহ কিছু কম ছিল না। পুরনো ইতিহাস ঘঁাটলে দেখা যায়, হরিয়ানার বেশ কিছু গ্রামে তখন প্রচুর বাদামি চুল আর নীল চোখের শিশুর ছড়াছড়ি, সৌজন্যে অবশ্যই উইলিয়াম ফ্রেজার।
পারসি এবং হিন্দি ভাষার উপর যথেষ্ট দখল ছিল তঁার। সেই সঙ্গে তঁাকে টানত দিল্লির পুরনো স্থাপত্য আর ধ্বংসাবশেষ। দেশীয় রাজাদের প্রাসাদ থেকে শুরু করে একেবারে দেহাতি গ্রাম্য হাটুরের কুঁড়েঘর পর্যন্ত তঁার অবাধ যাতায়াত ছিল চোখে পড়ার মতো। ‘এ-দেশের কালা আদমিদের সঙ্গে ফ্রেজারের মতো করে আর কেউই মিশতে পারে না। ওকে সবাই বিশ্বাসও করে বন্ধুর মতোই।’– উইলিয়াম ফ্রেজার সম্পর্কে হাজারটা খারাপ কথা রিপোর্টে লেখার পরেও এই বয়ানটুকু দিতে বাধ্য হয়েছিলেন তৎকালীন রেসিডেন্ট চার্লস মেটকাফ। দু’জনের কেউই কাউকে অবশ্য দেখতে পারতেন না মোটে। ফ্রেজারের মতে, মেটকাফ একটা ‘হামবাগ’, অকারণ আভিজাত্যের ফঁাপা বড়াই করার জঘন্য স্বভাবটা ওর যায়নি। আর মেটকাফের মূল আপত্তির জায়গা ছিল ফ্রেজারের ‘বোহেমিয়ান’ জীবনযাপন, আর যার-তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা। যদিও এসব কথায় থোড়াই কেয়ার করতেন ফ্রেজার। প্রাণের ভয়ই তঁার ছিল না, সেখানে চাকরির ভয় তঁার কী করবে! দিল্লির বিশৃঙ্খলা আর অরাজকতা মুছে ফেলার দায়িত্ব মাথায় নিয়ে আনাচকানাচ পর্যন্ত চষে ফেলতেন তিনি। এই যাযাবর জীবনে ইউরোপীয় অভ্যাসের ন্যূনতম অভিজ্ঞানগুলোও ঝেড়ে ফেলতে বেশি সময় লাগেনি ফ্রেজারের। এত অল্প লটবহর থাকত তঁার সঙ্গে যে, তঁার বাবুর্চিও দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল।
তাই বলে ফ্রেজারের ঘোড়াকে কিন্তু কম ওজন বইতে হত না! কারণ, ফ্রেজার নিজের গেরস্থালির জিনিসপত্র প্রায় কিছুই সঙ্গে নিতেন না ঠিকই, তবে যেখানেই যেতেন, দেশীয় নানা জিনিসপত্র মনে ধরত তঁার। আর সেসব তুলে আনতেন থলে বোঝাই করে। কী ছিল না তঁার সংগ্রহে– বাঘের মাথা, হরিণের চামড়ার আসন, রকমারি তির-ধনুক, তূণীর, জল রাখার কঁাসার ঘটি, মিনাকারির কাজ করা ধূপদান, রঙিন কাচের শরাবপাত্র, হাতলে সূক্ষ্ম রুপোর কারুকাজ করা মারণাস্ত্র যমধর, পঁাচ আঙুলের অঙ্গুরীয়মালার মতো দেখতে বাঘনখ, এমনকী রকমারি পঁুথি পর্যন্ত সংগ্রহ করে রাখতেন তিনি! তবে, ফ্রেজারের শ্রেষ্ঠ কৃতিত্ব অবশ্যই ফ্রেজার অ্যালবাম।
দিল্লি, পাটনা, রাজপুতানার শিল্পীদের অনেকেই তখন অর্থানুকূল্যের জন্য সাহেবদের কাছে অঁাকার বরাত নিতেন। যুগোপযোগিতার খাতিরে সেসব জলরঙের ছবিতে এক মিশ্র ঘরানার ছাপ ফুটে উঠছিল ক্রমশ। মিনিয়েচারের সূক্ষ্মতার সঙ্গে এসে যোগ দিয়েছিল পাশ্চাত্য রীতিতে ফোটোগ্রাফিক স্টাইলে মূলানুগ অনুকরণ। আসলে, ভারত তখন ফ্রেজারের মতো ইউরোপীয়ের কাছে অজানা আগ্রহ আর কৌতূহল নিবৃত্তির খনি। ফলে, ভারতের স্থানীয় মানুষ, তাদের পোশাক-আশাক, খাদ্যাভ্যাস, পেশা, অবসরযাপন, গানবাজনা, বাজারহাট, মন্দির-মসজিদ-স্থাপত্য– সবই তাদের কাছে চমকপ্রদ। তাই, এসবের ছবি অঁাকানোর হিড়িক পড়ে গেল তাদের মধ্যে। ‘অক্সিডেন্টাল’ দৃষ্টিভঙ্গি আর ‘ওরিয়েন্টাল সাবজেক্ট’– এ দুয়ের মিলমিশে গড়ে উঠল ‘কোম্পানি পেইন্টিং’-এর নতুন ধারা। ভারতপ্রেমী ফ্রেজারও প্রচুর শিল্পীকে নিয়োগ করলেন ভারতীয় ছবি অঁাকানোর জন্য।
এ-কাজে অবশ্য তঁার ভাই জেমস ফ্রেজার-ও সহায় হয়েছিলেন। দুই ভাইয়ের তদারকিতে ১৮১৫-’২০ পর্যন্ত পঁাচ বছরের মধ্যে গুলাম আলি খান, গুলাম হোসেন খান, জীবন রামের মতো শিল্পী একের-পর-এক ছবিতে তুলে ধরলেন বাজনদার, নর্তকী, ব্যবসায়ী, গ্রামবাসী, সেনাদল, চাকরবাকর আর শহরের স্থাপত্যনকশা। মোগল কায়দা মেনে এসব ছবিতে প্রায়ই পাওয়া যাবে জমকালো বর্ডার, দামি ধাতু আর পাথরের গুঁড়ো দ্রাবকের মধ্যে মিশিয়ে বানানো উজ্জ্বল রং আর কাঠবিড়ালীর লোম থেকে তৈরি করা সূক্ষ্ম তুলির টান। সেই সঙ্গে ইউরোপীয় রীতি মেনে ছবিতে এসেছে আলো-অন্ধকারের মাত্রা বোঝাতে ছায়ার ব্যবহার, মনুষ্যদেহের বর্তুল অংশের ত্রিমাত্রিকতা আর পোশাকের ঝালরে ঝলসে-ওঠা রোদের আভাস বোঝাতে জায়গায় জায়গায় ফ্যাকাসে করে দেওয়া হয়েছে রং। ভারতীয় চিত্ররীতি থেকে বেশ খানিকটা তফাত চোখে পড়ে, ছবিতে ল্যান্ডস্কেপের অনুপস্থিতিতে। সাদা কাগজের উপরে অঁাকা এসব ছবিতে সাবজেক্টটুকুই প্রধান, সাবজেক্টের বাইরে তার চারপাশের প্রকৃতি কিংবা প্রেক্ষাপটকে অপ্রয়োজনীয় বিচারে একেবারে ছেঁটে বাদ দেওয়া হয়েছে ছবি থেকে।
এমনিতে ছুটে বেড়ালেও, দিল্লিতে ফ্রেজার নিজের মনের মতো করে বানিয়েছিলেন ‘ফ্রেজার ঘর’, তঁার ব্যক্তিগত প্রাসাদ। সেখানে যখন আসতেন, থাকতেন রাজার হালেই। ভাই অ্যালেক একবার দিল্লিতে দাদার কাছে থাকতে এসে তঁার দিশি ধানাইপানাই আর আড়ম্বর দেখে হতবাক হয়ে চিঠিতে লিখেছিলেন বাবাকে– “দাদার এখানে শুধু চাকরবাকরই আছে অন্তত ৭০ জন! মেওয়াতি পাহারাদাররা ছাড়াও একদল মুসলিম খানসামা আছে টেবিলে খানা দেওয়ার কাজে, দশজন পালকিবেহারা (যারা আবার দাদার জুতোও পালিশ করে), চারজন তঁাবু খাটায়, একজন কুকুরের দেখাশোনা করে, তিনজন ভিস্তি, মাহুত আর তার শাগরেদ রয়েছে ক’জন, বাবুর্চিরাও আছে তাদের লশকর নিয়ে, জনা দুই ধোপা, দু’জন দরজি, দু’জন পত্রবাহক, একজন নাপিত, এছাড়াও পঁাচটা ঘোড়া আর সাতটা উটের ঘাসিয়াড়া আর দলাইমলাই করার জন্য একদল লোক!” মজার কথা, ফ্রেজার অ্যালবামে কিন্তু এদের প্রত্যেকের ছবি পাওয়া যায়, ফ্রেজারের ব্যক্তিগত সেনাবাহিনীর ছবিও আছে সেখানে।
সেই সঙ্গে আরও একটি অদ্ভুত ছবি প্রায়ই মেলে ফ্রেজার অ্যালবামের বিভিন্ন পাতায়– এক জাঠ রমণী, মুখে কাঠিন্যের ছাপ স্পষ্ট, অসামান্য দেহের বঁাধুনি, অঁাটসঁাট কঁাচুলি থেকে উপচে পড়ছে যৌবন, রঙিন ঘাগরার লহর তুলে সোজাসুজি তাকিয়ে আছে ছবির দিকে। কোনও ছবিতে তার কোলে-কঁাখে দু’-একটি শিশু, যাদের মুখের গড়নে ইউরোপীয় ধঁাচ পরিষ্কার। ছবির বিবরণী থেকে জানা যায়, এ মেয়ের নাম আমিবান। এ-দেশে এসে সাতটি মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন ফ্রেজার, আমিবান তঁার পাটরানি।
এছাড়াও আরও অন্তত পঞ্চাশ রমণীর হারেম ছিল ‘ফ্রেজার ঘর’-এ। আমিবান আর ফ্রেজারের প্রেমের রঙিন গল্পে মশগুল হয়ে থাকত দিল্লির গলিপথ, সেই কানাকানি চলত সম্রাট শাহ আলমের দেওয়ান-ই-খাস পর্যন্তও! যদিও এই লাগামছাড়া প্রেমের ফঁাদেই একদিন প্রাণ হারাতে হয় ফ্রেজারকে। বোনের সঙ্গে আশনাই চলছে ফ্রেজারের, এ খবর শুনে আর মাথার ঠিক রাখতে পারেননি লোহারুর নবাব শামসুদ্দিন আহমেদ খান। তঁারই নির্দেশে একদিন রাতের অন্ধকারে নিজের বাড়ির একেবারে দোরগোড়ায় ফ্রেজারের ওপরে গুলি চালালেন করিম খান, ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হল তঁার। বয়স তখন ৫১।
ফ্রেজারের মৃত্যুর সঙ্গে-সঙ্গে তঁার এত দিনের সংগ্রহও ছড়িয়ে পড়েছিল দেশের বিভিন্ন প্রান্তে, অল্পই গিয়ে পৌঁছেছিল স্কটল্যান্ডে। সেখান থেকেও আবার পৃথিবীর বিভিন্ন সংগ্রহশালায় কখনও বিক্রি, কখনও নিলাম হয়ে যায় কতক ছবি। যেটুকু পাওয়া গেল, সেটুকুকেই দু’-মলাটে এনে প্রকাশিত হয় ১৯৮৯ সালে। এ যাবৎকালে পাওয়া কোম্পানি পেন্টিংয়ের সর্বশ্রেষ্ঠ নিদর্শন ‘ফ্রেজার অ্যালবাম’-এর হারিয়ে যাওয়া আরও কোন-কোন ছবি ভারতপাগল এক বিদেশি তরুণের স্মৃতি হয়ে ইতিহাসের কোনও ধূলিধূসরিত অন্ধকারের আড়ালে দিন গুনছে, তা কেউ কী আর জানে!
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.